আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিএনপির বড় বাধা


দীর্ঘ ১৫ বছর ক্ষমতার বাইরে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মোটা দাগে তিনটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দলটি। এর মধ্যে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায় করাই তাদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জ। আর তা বাস্তবায়নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা পুলিশ প্রশাসনকেই মূল বাধা হিসাবে দেখছেন তারা। সেই বাধা মোকাবিলা করে কীভাবে একটি সফল আন্দোলন করা যায় সে রকম পরিকল্পনা আঁটছেন দলটির হাইকমান্ড। নেতাকর্মীদেরও সেভাবে নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আমাদের সামনে মূল চ্যালেঞ্জটাই হচ্ছে নির্বাচনকালীন একটা নিরপেক্ষ সরকার প্রতিষ্ঠা। সেই লক্ষ্যে আমরা রাজপথে আন্দোলন করছি। কিন্তু সেই আন্দোলন মোকাবিলায় অতীতের মতো এবারও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বড় বাধা হিসাবে দাঁড়াতে পারে। সেই বাধা উপেক্ষা করে কীভাবে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া যায় তা নিয়ে আমরা পরিকল্পনা তৈরি করছি। রাজপথের আন্দোলনে যে কোনো বাধা মোকাবিলায় নেতাকর্মীদের করণীয় নিয়ে নানা পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, এবার যত বাধাই আসুক রাজপথের আন্দোলন থেকে নেতাকর্মীরা পিছু হটবে না। কারণ আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। তাই জয়ের বিকল্প ভাবছি না। আশা করি অতীতের মতো প্রশাসন নগ্নভাবে আমাদের কর্মসূচিতে বাধা দেবে না। এবার বাধা দিলেই আমরা রাজপথ ছেড়ে দেব সেটা ভাবার কারণ নেই। বাধা মোকাবিলা করে কীভাবে রাজপথ দখলে রাখা যায় সেই পরিকল্পনাও আমাদের আছে। এবারের আন্দোলনে নেতাকর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও রাজপথে নেমে আসবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচিতে তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। বিএনপির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি আদায়ে এমন আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে যাতে সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। অথবা সংবিধানে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের বিধান সংযোজন করেন। এটা বাস্তবায়ন করতে হলে আমাদের কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এ চ্যালেঞ্জে মূল বাধা হতে পারে ‘দলীয়’ প্রশাসন। বিশেষ করে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকাকেই আমরা সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। অতীতের মতো সামনের আন্দোলন দমনেও সরকার পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করবে এতে কোনো সন্দেহ নেই। ইতোমধ্যে তারা পুলিশ প্রশাসনকে সেভাবে সাজাতে শুরু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর সবার ধারণা ছিল পুলিশ প্রশাসন নিরপেক্ষ আচরণ করবে। কিন্তু তারা এখনো সরকারের আজ্ঞাবহ হিসাবেই কাজ করছেন। বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের হামলা-নির্যাতন করার পাশাপাশি দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা ও গায়েবি মামলা। তারা আরও বলেন, বিএনপির আন্দোলন দমাতে গত পনেরো বছরে এক লাখ ১২ হাজারের মতো মামলা দেওয়া হয়েছে। এসব মামলায় প্রায় ৪০ লাখ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। আগামী দিনের আন্দোলন দমাতে এসব মামলাকে ব্যবহার করা হতে পারে। একইসঙ্গে দেওয়া হতে পারে নতুন নতুন মামলা। তাই রাজপথের আন্দোলন সফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই হতে পারে মূল বাধা। বিএনপি নেতারা আরও জানান, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে দলীয় আচরণ থেকে সরে আসতে নানাভাবে কাজ করা হচ্ছে। যারা নগ্নভাবে সরকারের পক্ষে কাজ করছেন তাদের তালিকা তৈরি করে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠানো হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে কিছুটা হলেও ভয়ের সৃষ্টি হবে। তবে এটা যাতে হিতে বিপরীত না হয় সেদিকেও খেয়াল রাখা হচ্ছে। বিএনপি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় গেলে সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে না এমন নিশ্চয়তাও দেওয়া হচ্ছে। তবে যারা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে বাধা হয়ে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে গণতন্ত্র হরণ করেছে তাদের কোনো ক্ষমা নেই। তাদের আইন অনুযায়ী সমুচিত জবাব দেওয়া হবে। আন্দোলনের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছাতে দল ও জোটের ঐক্য ধরে রাখা বিএনপির কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচনকে সামনে রেখে দলে ভাঙনের চেষ্টা হতে পারে বলে মনে করছেন কেউ কেউ। তাই দলের সব স্তরে ‘চেইন অব কমান্ড’ নিশ্চিত করাকেও চ্যালেঞ্জ হিসাবে দেখছেন হাইকমান্ড। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতি ঘোষণার পর সহিংসতা এড়িয়ে আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া, জামায়াতের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত সম্পর্ক কী হবে সেসব দিকেও বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছেন তারা। জানতে চাইলে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিতে প্রয়োজন একটি নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার। শুধু বিএনপি নয়, দেশবাসীর কাছে এমন একটি সরকার প্রতিষ্ঠাই এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সেটা মোকাবিলায় আমরা কাজ করছি। কিন্তু সহজেই সেই দাবি আদায় করা সম্ভব হবে না। রাজপথের কর্মসূচিতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অতীতের মতো ন্যক্কারজনক বাধা আসতে পারে। সেই বাধা মোকাবিলা করেই এবার সামনে এগিয়ে যাব। এর কোনো বিকল্প নেই। বিএনপির একাধিক নেতা বলেন, আন্দোলনে সফল হলে কিছু বিষয় সামনে আসবে। এর মধ্যে রয়েছে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, মনোনয়ন চূড়ান্ত করা। সমমনা অনেক দলের মাঠপর্যায়ে তেমন সাংগঠনিক শক্তি নেই। কিন্তু ওইসব দলের শীর্ষ নেতারা দেশে-বিদেশে বেশ পরিচিত। তাই তাদের বাদ দিয়ে মনোনয়ন চূড়ান্ত করা কঠিন হবে। তাদের মনোনয়ন দেওয়া হলে সেখানে দলের গুরুত্বপূর্ণ অনেক নেতা বাদ পড়বেন। এতে দেখা দেবে ক্ষোভ ও হতাশা। সবাইকে ম্যানেজ করে মনোনয়ন চূড়ান্ত করাও হাইকমান্ডের সামনে একটি চ্যালেঞ্জ। জানতে চাইলে বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল লেন, এই মুহূর্তে এ সরকারকে ক্ষমতা থেকে বিদায় করাই বিএনপির সামনে সবচেয়ে বড় কাজ। তারা স্বেচ্ছায় দাবি মেনে নেবে না। বিএনপির আন্দোলন বানচালে শেষ পর্যন্ত চেষ্টা চালাবে সরকার। প্রশাসনকে ব্যবহার করে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করতে চাইবে। কিন্তু এবার সেই পরিস্থিতি তৈরি হতে দেওয়া হবে না। যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলা করে আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া হবে।