নারীকে আরও এগিয়ে নেবে তথ্যপ্রযুক্তি


এবার ৮ মার্চ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হচ্ছে এক নতুন প্রেক্ষাপটে। করোনা অতিমারির সংকট কাটিয়ে যখন মানুষ ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল, তখন অতর্কিতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আবার সব তছনছ করে দিয়েছে। অতীতের আর সব সংকটজনক পরিস্থিতির মতো এবারও করোনার অভিঘাতে নারীরা তুলনামূলকভাবে বেশি আক্রান্ত হয়েছিল। ’৯০-এর দশক থেকে বিশেষ করে ১৯৯৫ সালে বেইজিং চতুর্থ বিশ্ব নারী আন্দোলনের ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী বিশ্ব নারী আন্দোলন, নারীসমাজ নতুন আশার আলো দেখেছিল এবং নতুন পথের সন্ধান পেয়েছিল। জাতীয় ও বৈশ্বিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারী-পুরুষের সমতা, নারীর ক্ষমতায়ন এবং নারী ও কন্যাশিশুর মানবাধিকারের বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছিল। দেশে দেশে নারী আন্দোলন, বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠন সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা ও অ্যাডভোকেসির মাধ্যমে নাগরিক সমাজকে সঙ্গে নিয়ে নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ইতিবাচক প্রাগ্রসর কর্মসূচি বাস্তবায়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়ে অধিকতর উৎসাহ-উদ্দীপনাসহকারে কাজ শুরু করেছিল। উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো তাদের এজেন্ডায় নারীর ক্ষমতায়নকে সচেতনভাবে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। ২০২০ সালে যখন চতুর্থ বিশ্ব নারী সম্মেলনের ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষ্যে দেশে দেশে বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের পর্যালোচনা করা হয়, তখন দেখা যায় নারীর ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে অনেক কিছু অর্জন করা গেলেও তার গতি অত্যন্ত ধীর শুধু নয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে অর্জন হাতছাড়া হয়ে গেছে, আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন এবং সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্তির মাধ্যমে নারী অগ্রসর হলেও পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে নারীর প্রতি প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি বিদ্যমান থাকার কারণে মৌলিক পরিবর্তন সাধনে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। নারীর স্বার্থে যতটুকু আইন ও নীতিমালা প্রণীত হয়েছে, বাস্তবে নারীসমাজ তার সুফল পায়নি। প্রকৃত ক্ষমতায়ন থেকে নারীসমাজ এখনো অনেক দূরে অবস্থান করছে। বেইজিং ঘোষণা ও কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়নের ২৫তম বর্ষপূর্তিতে যখন এসব ইস্যু বৈশ্বিক ও জাতীয় পর্যায়ে আলোচনায় প্রাধান্য পাওয়ার কথা ছিল এবং ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ধারণের ক্ষেত্রে নারী আন্দোলন বিশেষ ভূমিকা রাখবে এমনটাই আকাক্সিক্ষত ছিল, সেসময় করোনা সংকট ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে নারীর এ যাবৎকালের সাফল্যের দরজায় আঘাত হানল। বাংলাদেশের অভিজ্ঞতায় আমরা দেখি, সচেতনতা বৃদ্ধি এবং ধারাবাহিক প্রণোদনাপ্রাপ্তির কারণে প্রাথমিক শিক্ষায় ভর্তির ক্ষেত্রে করোনা-পূর্ববর্তী সময়ে মেয়েরা ছেলেদের চেয়ে এগিয়ে ছিল, করোনার ভয়াল গ্রাসে তারা পিছিয়ে গেল। শিক্ষাজীবন থেকে নারীদের ঝরে পড়ার হার বৃদ্ধি পেল, তারা অধিকতর হারে বাল্যবিয়ের শিকার হলো। সহিংসতা বন্ধে নানা উদ্যোগ থাকা সত্ত্বেও এ সময়ে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি আবারও মনে করিয়ে দিল ঘরে-বাইরে নারী ও কন্যারা কতটা অনিরাপদ। ঘরে এবং ঘরের বাইরে জনপরিসরে, গণপরিবহণে নানা পদ্ধতিতে নানা মাত্রায় ধর্ষণ, গণধর্ষণ, নির্যাতনের কারণে হত্যার শিকার হলো। নারীর জন্য বাস্তব জগতের মতো ভার্চুয়াল জগৎও ভয়ংকর অনিরাপদ হয়ে উঠল। শ্রমবাজারে নারীরা যখন অধিক হারে বিভিন্ন পেশায় অংশগ্রহণ করে দারিদ্র্যদূরীকরণে ভূমিকা রাখছিল, এ সময়ে করোনার অভিঘাতে তারা শ্রমবাজার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল, কর্মসংস্থান হারাল লাখ লাখ নারী, ফলে দারিদ্র্য হ্রাসের হার আবার কমে গেল। দারিদ্র্যের বহুমুখী অভিঘাত নারীর জীবনে নানাভাবে আঘাত হানল। সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রেও নারীরা আরও কোণঠাসা হয়ে পড়ল। করোনার কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্য ও জীবনঝুঁকি মোকাবিলার প্রাধান্য নিয়ে স্থানীয়, জাতীয় ও বৈশ্বিক নীতিনির্ধারকরা নারীর ক্ষমতায়ন ইস্যুকে পেছনে ঠেলে দিল। এর ফলে নারীর অবস্থানের উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের সব ক্ষেত্র আবারও সংকটাপন্ন হতে শুরু করল। বিশ্বব্যাপী নারী আন্দোলন জোরালো দাবি জানাতে থাকল এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য। যেহেতু এ সবই বিশ্বজনীন অভিজ্ঞতা, সেহেতু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নারী আন্দোলনের মধ্যে যোগাযোগ অনলাইনে অব্যাহত থাকল এবং দৃঢ় হলো। করোনা অতিমারিজনিত সংকট থেকে উত্তরণের জন্য কীভাবে দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত নারীসমাজকে জীবন ধারণের জন্য সহায়তা দেওয়া যায়, শিক্ষাব্যবস্থাকে বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে কীভাবে প্রযুক্তি সহজলভ্যতা ও তা ব্যবহারে ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীদেরও অভিগম্যতা নিশ্চিত করা যায়, শ্রমবাজারে, বিশেষত অনানুষ্ঠানিক শ্রমবাজারে কীভাবে নারীকে টিকিয়ে রাখতে সহায়তা করা যায় এবং নারী ও কন্যার প্রতি সহিংসতার ঘটনা মোকাবিলায় কীভাবে দুর্যোগকালীন জরুরি সেবা দেওয়া যায়-এ সবই যাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সব পর্যায়ের নারীর অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে করোনার বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে জাতীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়, সে লক্ষ্যে এ দেশের নারী আন্দোলন সোচ্চার থেকেছে। বহুমাত্রিক কর্মসূচি গ্রহণের মাধ্যমে নীতিনির্ধারক নাগরিক সমাজসহ সব অংশীজনের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধজনিত কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে এবং বাংলাদেশেও যার আঁচ লেগেছে, তা নারীর জীবনকে আবারও অধিকতর সংকটাপন্ন করে তুলেছে। পাশাপাশি আমরা দেখতে পাচ্ছি, করোনা সংকট থেকে উত্তরণে মানুষ প্রযুক্তিকে পাশে পেয়েছে। বিশেষ করে প্রযুক্তি মানবসমাজকে ঘুরে দাঁড়াতে সহায়তা করেছে। এমনকি নারী সমাজের যে অংশের প্রযুক্তিতে অভিগম্যতা ছিল, তারাও এ সুবিধা পেয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহারে তারা সমান দক্ষতা দেখিয়েছে। বেকারত্ব, দারিদ্র্য থেকে মুক্ত হতে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তাসহ বিভিন্ন কর্মসংস্থান বেছে নিয়েছে। প্রযুক্তির সহায়তায় শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে গেছে, প্রশিক্ষণ কর্মসূচিসহ সরকারের বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা গ্রহণ করতে পেরেছে। প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ঘরে বসেই পেশাগত কাজ চালিয়ে গেছে। প্রযুক্তির মাধ্যমে ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে। প্রযুক্তির নানা নেতিবাচক ব্যবহার মোকাবিলা করেছে। করোনা-পরবর্তী বিশ্বে মানবসমাজকে অগ্রসর হতে হলে প্রযুক্তির ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই-এটি আজ প্রতিষ্ঠিত সত্য। তাই এবারের আন্তর্জাতিক নারী দিবসের যুগান্তকারী আহ্বান- ‘ডিজিট-অল : ইনোভেশন অ্যান্ড টেকনোলজি ফর জেন্ডার ইক্যুয়ালিটি’-নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠায় সবার জন্য প্রযুক্তির ব্যবহার অপরিহার্য। দেশকে অগ্রসর করতে হলে উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নারী-পুরুষের সমতা প্রতিষ্ঠা করতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার থেকে অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে পিছিয়ে রাখলে চলবে না। দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের মাধ্যমে এ ক্ষেত্রে সমতা আনতে হবে। নারী ও কন্যার জন্য তথ্যপ্রযুক্তিতে অভিগম্যতা বৃদ্ধি এবং প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ শ্রমজীবী নারী গড়ে তোলার মাধ্যমে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অংশগ্রহণের জন্য নারীসমাজকে প্রস্তুত করতে হবে, যাতে তারা প্রতিযোগিতামূলক শ্রমবাজারে অংশগ্রহণ করতে এবং টিকে থাকতে পারে। পাশাপাশি তথ্যপ্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে সাইবার জগতে নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সাইবার জগতে নারীর অনিরাপত্তার কারণে নারী ও কন্যারা যাতে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার থেকে বিমুখ না হয়। দেশের অর্ধেক জনগোষ্ঠী নারীকে বর্তমান সময়ের চাহিদামতো তথ্যপ্রযুক্তি জগতে যথাযথ অভিষেকের মাধ্যমে শুধু নারীর ক্ষমতায়ন নয়, দেশকে অগ্রসর করার মতো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীর জন্য বিনিয়োগের পরিকল্পনা থাকতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে আজকে সুযোগ এসেছে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের, যার মাধ্যমে নারীর মানবাধিকার, মানবিক সত্তা, সৃজনশীলতা স্বীকৃত হবে ও প্রতিষ্ঠিত হবে। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে বৈশ্বিক নারী আন্দোলন, মানবাধিকার আন্দোলন, শান্তি আন্দোলন, পরিবেশ আন্দোলনের কর্মীদের মধ্যে অনেক বেশি যোগাযোগ বৃদ্ধি পাবে। মানুষ পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্রে যে কোনো ধরনের সাংঘর্ষিক অবস্থান, নারীর প্রতি সহিংসতা, সাম্প্রদায়িক-সম্প্রীতি বিনষ্ট, যুদ্ধবিগ্রহের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করবে। সমাজের সব মানুষকে সঙ্গে নিয়ে একটি সমতাপূর্ণ বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ে উঠবে। মানবতার জয় হবে-এটাই আজকের দিনে প্রত্যাশা। মালেকা বানু : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ