মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে নেই কার্যকর পদক্ষেপ


বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কমছে মূল্যস্ফীতি। এমনকি নিম্নমুখী খাদ্যপণ্যের দামও। কিন্তু উলটো চিত্র বিরাজ করছে বাংলাদেশে। জুনে দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমলেও খাদ্যপণ্যে তা বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাজার ব্যবস্থাপনায় অদক্ষতা এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সঠিক পথে নেই বাংলাদেশ। নেই কোনো কার্যকর পদক্ষেপ। এ কারণে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে এ খাতে। কোভিড-১৯ মহামারি এবং চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে ২০২২ সালে সারা বিশ্বেই মূল্যস্ফীতি বাড়তে থাকে। কিন্তু পরে ধীরে ধীরে তা কমতে থাকে। বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পণ্যের দাম কমে এলেও এর প্রভাব পড়েনি দেশের বাজারে। এদিকে মূল্যস্ফীতির জাঁতাকলে পিষ্ট হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। বাজারে গিয়ে চোখ দিয়ে পানি ঝরছে ক্রেতাদের। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম কমলেও দেশে এখনো আগের অর্ডার করা পণ্যই আসছে। তাই বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাব পড়তে একটু সময় লাগবে। তবে খাদ্য মূল্যস্ফীতির অন্যতম কারণ হিসাবে তিনি মনে করেন, চিনি ও পেঁয়াজের ধাক্কা লেগেছে জুনের মূল্যস্ফীতির হিসাবে। তবে চালের দাম স্থিতিশীল না থাকলে মূল্যস্ফীতি অনেক বেড়ে যেত। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলে যে দেশের বাজারে স্বয়ংক্রিয়ভাবে দাম কমবে, তেমনটি হয়নি। তিনি বলেন, এর কারণ জানতে চাওয়া হয়েছিল বাণিজ্যমন্ত্রীর কাছে। তিনি (বাণিজ্যমন্ত্রী) গণমাধ্যমকে বলেছিলেন দেশে কিছু বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যাদের হাতে বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। তারা কৌশলে বাজারের দাম নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। কিন্তু এখানে প্রশ্ন হলো-তারা কীভাবে বা কোন অপকৌশলে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে, সেটি কি সরকারের বা বাণিজ্যমন্ত্রীর অজানা? যদি সেটি না হয়, তাহলে ওই রাঘববোয়ালদের ধরা না গেলেও তাদের অপকৌশল বন্ধে সরকার তো ব্যবস্থা নিতে পারে। কিন্তু মূল্যস্ফীতির হার কমার মতো কোনো কার্যকর পদক্ষেপই নেয়নি সরকার। এটা করা না গেলে বিশ্ববাজারে দাম কমার প্রভাব দেশে পড়বে না। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ২০২৩ সালের শুরু থেকেই বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে মূল্যস্ফীতি কমেছে। ২০২২ সালের জুনে যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ১ শতাংশ। সেটি কমে গত ডিসেম্বরে দাঁড়ায় ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। এছাড়া জুনে এটি আরও কমে হয়েছে ৪ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ। এরপর ডিসেম্বরে তা বেড়ে ১০ দশমিক ৫ শতাংশে ওঠে। কিন্তু চলতি বছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬ দশমিক ৫ শতাংশে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে গত বছরের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৭ শতাংশ। ডিসেম্বরে এ হার কমে দাঁড়ায় ৫ দশমিক ৭২ শতাংশে। গত জুনে দেশটির মূল্যস্ফীতি কমে গিয়ে হয়েছে ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। শ্রীলংকা ব্যাপক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলা করে ২০২২ সালে। সবচেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতির শিকার হয়েছিল দেশটি। মূল্যস্ফীতির হার গত বছর ঠেকেছিল প্রায় ৬০ শতাংশে। রিজার্ভ সংকটে জ্বালানি তেলের মতো অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যও আমদানি করতে পারেনি। আমদানি দায় আর বিদেশি ঋণ পরিশোধের ব্যর্থতায় নিজেদের দেউলিয়াও ঘোষণা করেছিল। কিন্তু সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি দ্রুতই কাটিয়ে উঠছে। মূল্যস্ফীতির হার ধারাবাহিকভাবে কমছে শ্রীলংকায়। সর্বশেষ জুনে এ হার দাঁড়িয়েছে ১২ শতাংশে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, জুনে দেশের সার্বিক মূল্যস্ফীতির হার সামান্য কমে হয়েছে ৯ দশমিক ৭৪ শতাংশ, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশ। এপ্রিলে ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং গত বছরের জুনে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। কিন্তু খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়ছেই। জুনে খাদ্যে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে। মে মাসে এ হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ। এর আগে এপ্রিলে ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এছাড়া গত বছরের জুনে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এদিকে গ্রাম-শহর সর্বত্রই খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। জুনে গ্রামে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৯৫ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ৩২ শতাংশ। এছাড়া শহরে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশে, যা মে মাসে ছিল ৯ দশমিক ১৩ শতাংশ। এদিকে সদ্য সমাপ্ত অর্থবছরে (জুলাই-জুন) দেশের গড় মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৯ দশমিক ০২ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। ড. জাহিদ হোসেন মঙ্গলবার বলেন, সরকার এমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি যে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। বরং সরকারের কার্যক্রম মূল্যস্ফীতিকে উসকে দিয়েছে। কেননা সরকার বাজেট ঘাটতি পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছে প্রায় ৯২ হাজার কোটি টাকা। এই অর্থের জোগান দেওয়া হয়েছে টাকা ছাপিয়ে। এটা সরাসরি মূলস্ফীতি বৃদ্ধির একটি অন্যতম উৎস। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে তারল্য ঢালছে সরকার। পাশাপাশি রিফাইন্যান্সিংয়ে নতুন করে অর্থায়ন করা হচ্ছে। ফলে এগুলো সবই সম্প্রসারণমুখী মুদ্রানীতির কার্যক্রম। পাশাপাশি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে গত অর্থবছর মুদ্রানীতিতে কোনো পদক্ষেপ ছিল না। এবার নতুন মুদ্রানীতিতে সামান্য সুদের হার বৃদ্ধি করা হয়েছে। কিন্তু মূল্যস্ফীতি কমাতে এটি বাস্তবসম্মত কোনো কাজ হবে না। এদিকে ডলার সংকটে আমদানি নিয়ন্ত্রণের কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। এছাড়া কৃচ্ছ সাধনের একটা উদ্যোগ ছিল। কিন্তু সেটিতে খুব বেশি কাজ হয়নি। কেননা বাজেট ঘাটতি অনেক বেড়ে গিয়েছিল। সবকিছু মিলিয়ে বিশ্বে মূল্যস্ফীতি কমলেও দেশে সেটি হয়নি।