শিশু ও গর্ভবতী নারীরা বেশি সংকটাপন্ন


আইসিইউ’র বারান্দায় হা-হুতাশ করছেন এক স্বামী। দু’চোখের জল গাল বেয়ে গড়াচ্ছে মেঝেতে। ৯ মাসের গর্ভবতী স্ত্রী আইসিইউতে-লড়ছেন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। লাইফ সাপোর্টে রাখা ওই নারীর নাম খাদিজা আক্তার। সপ্তাহখানেক আগেও খাদিজাকে ঘিরে আনন্দে ছিল গোটা পরিবার। তার কোল ঘিরে ফুটফুটে সন্তান আসবে-এমন আনন্দে দিশেহারা হয়ে উঠছিলেন স্বামী, স্বজনরা। এখন প্রার্থনায় বসে টানা কাঁদছেন পরিবারের সদস্যরা। খাদিজার দুটি কন্যাশিশু রয়েছে-নাম মার্জিয়া (৮) ও মিথিলা (৫)। তারা জানে না, তাদের মা লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। তবে এটা জানে, তাদের আরেকটা বোন কিংবা ভাই দুনিয়াতে আসবে। যার জন্য মাকে হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি খাদিজা আক্তার। এই হাসপাতালের বারান্দায়ও ডেঙ্গু রোগীর ছড়াছড়ি। বৃহস্পতিবার দুপুর আড়াইটা পর্যন্ত ডেঙ্গু রোগী ভর্তি ছিলেন ২৪০ জন। যার মধ্যে অর্ধেকই নারী। আর শিশুর সংখ্যা ৯০ জন। হাসপাতালটিতে অন্তত ৬ জন গর্ভবতী মা রয়েছেন-যারা এডিস মশার ছোবলে আক্রান্ত। হাসপাতালটির নতুন ভবনের ৫ তলার আইসিইউতে থাকা খাদিজা যখন শঙ্কায়-ওই সময় ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডের ১৭-ক বেডে কাতরাচ্ছেন ৭ মাসের গর্ভবতী সামসুন্নাহার (২৩)। আবার হাসপাতালটির পুরাতন ভবনের ৪টি ওয়ার্ড ঘিরে ভর্তি ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের যন্ত্রণাও স্পষ্ট ভেসে উঠছে। কোনো কোনো বেডে আক্রান্ত দুই শিশুকে একসঙ্গে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। খাদিজার স্বামী মোফাজ্জেল হোসেন জানান, তাদের দুই কন্যা সন্তান রয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে তাদের সংসারে নতুন আরও একটি অতিথি আসার কথা। কিন্তু ১৩ জুলাই ডেঙ্গু আক্রান্ত হয় তার স্ত্রী। সেই থেকে চিকিৎসা চলছে-এখন লাইফ সাপোর্টে। তিনি বলেন, চিকিৎসক বলেছেন, আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা করতে। আমরা সবাই প্রার্থনা করছি, স্ত্রী-সন্তানকে যেন আল্লাহ বাঁচিয়ে রাখেন। দেশবাসীর কাছেও দোয়া চাই।’ দুই কন্যা সন্তান মায়ের এ অবস্থা জানে না বলেই তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। ৮০১ নম্বর ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, ১৭-ক বেডে থাকা ডেঙ্গু আক্রান্ত গর্ভবতীর ওপরে মশারি টাঙিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পাশে বসে থাকা মা মাজেদা বেগম অসুস্থ মেয়েকে তরল খাবার খাওয়ানোর চেষ্টা করছেন। মা জানালেন, তার মেয়ে ৭ মাসের গর্ভবতী। বাড়ি বরিশালে। মেয়ের শরীরে তীব্র ব্যথা, সহ্য করতে পারে না, কান্না করে। গর্ভবতী নারীরা দ্রুত দুর্বল হয়ে পড়েন : এক সিনিয়র নার্স বলেন, অনেক আক্রান্ত নারী গর্ভবতী। তারা খুব সহজেই দুর্বল হয়ে পড়েন। ব্যথা সহ্য করতে পারেন না। আমরা হাসপাতাল থেকে বিনামূল্যে মশারি দিচ্ছি। আমাদের অনেক মায়া হয়। আক্রান্তদের গর্ভে থাকা ছোট্ট শিশুটিও নিশ্চয় আক্রান্ত হয়। আমরা সর্বোচ্চ সেবা দিয়ে আসছি। কিন্তু, চোখের সামনেই অনেকের মৃত্যু হচ্ছে। ৮০২ নম্বর ওয়ার্ডে থাকা গর্ভবতী এক নারীর স্বামী বলেন, নাম-ঠিকানা জানতে চাইয়েন না। আপনারা আমার স্ত্রীর-অনাগত সন্তানের জন্য দোয়া করেন। আমার স্ত্রী যখন নীল হয়ে যায়, তখন আত্মায় পানি থাকে না। আমরা সর্তক ছিলাম, তারপরও স্ত্রী আক্রান্ত হয়েছে। বরিশাল থেকে মেয়েকে নিয়ে এসেছেন এক মা। মেয়ের মুখখানি স্পর্শ করে বলছিলেন, এ হাসপাতালের প্রতি ভরসা আছে। আমিও এ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়েছি। মেয়ে ৩ মাসের গর্ভবতী। চিকিৎসকরা বলছেন, পর্যাপ্ত তরল খেতে দিতে-দিচ্ছিও। তারপরও ভয় পিছু ছাড়ছে না। শিশুদের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখতে হবে : একাধিক চিকিৎসক জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ও গর্ভবতী নারীরা অল্পতেই দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় থাকতে হবে। শিশু বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, পরিচালক স্যারের নির্দেশনা ছাড়া মিডিয়ায় কথা বলা যাবে না। তবে মানুষ হিসাবে বলতে চাই, ডেঙ্গু প্রতিরোধ কিংবা এর থেকে বাঁচতে সর্বপ্রথম নিজেকেই সর্তক হতে হবে। এ হাসপাতালেই বহু আক্রান্ত শিশু কাতরাচ্ছে। আমরা অতিরিক্ত সময় দিয়ে তাদের সেবা-চিকিৎসা করে আসছি। অভিভাবকদের প্রতি অনুরোধ করব, শিশুদের নিরাপদে রাখুন। ঘরে-বাহিরে শিশু সন্তানকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখুন।’ এদিকে হাসপাতালটির পুরাতন ভবনের অন্তত ৪টি ওয়ার্ডে প্রায় ৯০ জন শিশু ভর্তি রয়েছে। এমনিতেই হাসপাতালটিতে ধারণ ক্ষমতার চেয়ে দুই গুণেরও বেশি সাধারণ রোগী ভর্তি। ডেঙ্গু রোগীদের বিভিন্ন ওয়ার্ড-বারান্দায় স্থান দিতে হচ্ছে। চিকিৎসার কমতি নেই, বারান্দায় কিংবা মেঝেতে থাকা রোগীদের সেবা প্রদানে সর্বোচ্চ চেষ্টা চলছে। তারপরও রোগী এবং স্বজনদের হা-হুতাশা থামছে না। বাঁচার আকুতি দিন দিন তীব্র হয়ে উঠছে। আবার লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যাও। পুরাতন ভবনের ২১০ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর বেডে একসঙ্গে শুয়ে আছে দুই শিশু। শিশু দুটি ডেঙ্গু আক্রান্ত। পাশে থাকা মা ও খালা তাদের সেবা করছেন। ২ নম্বর বেডেও ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই শিশু একসঙ্গে চিকিৎসা নিচ্ছে। ১নং বেডে থাকা দুই শিশুর মা সানিয়া আক্তার জানান, তার দুই শিশু ইউশা (১১) ও ইউনা (৫) মঙ্গলবার ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়। হাসপাতালে প্রচুর রোগী। এর মধ্যেও চিকিৎসকরা সর্বোচ্চ চিকিৎসা প্রদান করছেন। বেড, মেঝেতে ঠাঁই হচ্ছে না রোগীর। বারবার ডাক্তার, সিনিয়র নার্সরা আসছেন। তাদের পরামর্শ অনুযায়ী তরল খাবার দিচ্ছি। অবহেলায় ভয়াবহ পরিণতি : ঢামেক হাসপাতালের নবজাতক ইউনিটের সাবেক ইউনিট প্রধান শিশুস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. আবিদ হোসেন মোল্লা বলেন, ডেঙ্গু রোগী লাফিয়ে বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত শিশু ও গর্ভবতী নারীর সংখ্যাও বাড়ছে। তাদের প্রতি সর্বোচ্চ সতর্কতার বিকল্প নেই। ডেঙ্গু জ্বরের লক্ষণ দেখামাত্রই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে। বিলম্বে ভয়াবহ পরিণতি হতে পারে। মনে রাখতে হবে অনেক ক্ষেত্রে এসব রোগী শক সিনড্রোমে চলে যায়। বলতে চাই, এডিস মশা নিধন কিংবা বংশবিস্তার রোধ হোক বা না হোক। স্প্রে কিংবা ওষুধ ছিটানো যথাযথ নাও হতে পারে। কিন্তু ডেঙ্গুর জীবাণুবাহী মশককূলের দাপট মারাত্মক পর্যায়ে গিয়ে ঠেকেছে। আর পাঁচটা ভাইরাল ফিভারের সঙ্গে ডেঙ্গু জ্বরের খুব তফাৎ নেই। তবে ডেঙ্গু হেমারেজিক ফিভার হলে রোগীর প্রাণ বাঁচানো মুশকিল হয়ে পড়ে। বিশেষজ্ঞ একাধিক চিকিৎসক বলেন, এক্সট্রিম এজ গ্রুপ অর্থাৎ ছোট বাচ্চা আর তাদের দাদা-দাদি, নানা-নানি ও গর্ভবতী নারীদের জ্বর হলে সাবধান হতে হবে অবিলম্বে। কেন না এদের ক্ষেত্রেই সমস্যা জটিল হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। ডেঙ্গু জ্বরের এই অবস্থা ক্রিটিক্যাল কেয়ার স্পেশালিস্টদেরও ঘুম কেড়ে নিচ্ছে। ইদানীং কম বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যেও এই মারাত্মক জ্বরের প্রকোপ দেখা যাচ্ছে। বিশেষ করে যাদের একবার ডেঙ্গু হয়ে গেছে তাদের যখন দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ডেঙ্গু হয়, তখন তা মারাত্মক অবস্থায় পৌঁছে যেতে পারে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা কর্নার : ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. নাজমুল হক বলেন, এ হাসপাতালে সাধারণ রোগীর চাপ সব সময়ই বেশি থাকে। চিকিৎসক, নার্সসহ সবাই সর্বোচ্চ চেষ্টায় চিকিৎসা-সেবা প্রদান করেন। এর মধ্যে এখন বিপুলসংখ্যক ভর্তি হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। প্রতিদিনই এমন রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। আমাদের চিকিৎসকরা সাধারণ রোগীর চিকিৎসা প্রদানসহ অতিরিক্ত সময় ধরে ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা করছেন। একাধিক ওয়ার্ডে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় আলাদা কর্নার করা হয়েছে।