রাজপথে নামার সুযোগ খুঁজছে জামায়াত


সরকারের পদত্যাগসহ নির্দলীয়, নিরপেক্ষ সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে যুগপৎ কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে বিএনপিসহ সমমনা ৩৬ রাজনৈতিক দল। এছাড়া ববি হাজ্জাজ নেতৃত্বাধীন জাতীয় গণতান্ত্রিক আন্দোলনসহ (এনডিএম) আরও কয়েকটি দল যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার কথা চলছে। একদফার এ যুগপৎ কর্মসূচিতে বিএনপির দীর্ঘদিনের মিত্র জামায়াতে ইসলামীকে এখন পর্যন্ত মাঠে দেখা যায়নি। দলটির এমন ‘নীরবতা’ সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতা’ নাকি ‘নিজস্ব কৌশল’-এ নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা গুঞ্জনও চলছে। যদিও সরকারের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ গুঞ্জন নাকচ করে আসছে দলটি। নেতারা জানান, তারাও মাঠে নামতে চান। এজন্য সাংগঠনিক বিভাগে শান্তিপূর্ণ সমাবেশের কর্মসূচি দিয়েছেন। কিন্তু পুলিশ তাদের অনুমতি দিচ্ছে না। আইন মেনে কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করবেন। তা না হলে বিকল্প উপায়ে রাজপথে নামা ছাড়া আর কোনো পথ থাকবে না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জামায়াতের একজন কেন্দ্রীয় নেতা কাছে স্বীকার করেছেন, একদফা আন্দোলনে জামায়াত মাঠে না থাকায় তাদের নানা প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। কিন্তু তারা আইন মেনে অনুমতি নিয়েই মাঠে থাকতে চান। তবে সিলেট ও চট্টগ্রামে সমাবেশের অনুমতি না দিয়ে হঠাৎ করে সরকারের এমন হার্ডলাইনে যাওয়ার কারণও খুঁজছেন তারা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ গুঞ্জন নাকচ করে জামায়াতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমির অধ্যাপক মুজিবুর রহমান সম্প্রতি চুয়াডাঙ্গা জেলা জামায়াতের এক ভার্চুয়াল কর্মী সম্মেলনে বলেন, ‘জামায়াতের অভিধানে ‘আঁতাত’ শব্দ নেই। জামায়াত ১০ বছর পর ঢাকায় সমাবেশ করেছে, তা যদি আঁতাত হয়, তাহলে যারা নিয়মিত সমাবেশ করছে তারাও কি সরকারের সঙ্গে আঁতাত করে চলেছে? জামায়াত নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। তবে এর অর্থ এই নয়, সরকারের পাতানো নির্বাচনে অংশ নেবে। শুধু কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে। জনগণ এবার কোনোভাবেই বিনাভোটের নির্বাচন হতে দেবে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘গত ১৫ বছরে জামায়াত ও ইসলামী ছাত্রশিবিরের ২৪৬ জন নেতাকর্মীকে হত্যা করা হয়েছে। পাঁচজন নেতাকর্মীকে পঙ্গু করা হয়েছে। প্রায় এক লাখ নেতাকর্মীকে রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। জামায়াতের আমিরসহ শীর্ষনেতাদের কারাগারে আটকে রাখা হয়েছে। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতিতে জনগণকে বিভ্রান্ত করতে আঁতাতের প্রোপাগান্ডা চালানো হচ্ছে।’ গত ১০ জুন ঢাকায় ঘরোয়া সমাবেশের অনুমতি পেয়ে বড় জমায়েত করেছিল জামায়াতে ইসলামী। প্রায় এক দশক ধরে অনেকটা ‘নিষিদ্ধ’ থাকার পর হঠাৎ জামায়াতকে সরকার ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেয়। এটি আগামী সংসদ নির্বাচনে জামায়াতের সঙ্গে ‘সমঝোতার’ সূত্রপাত নাকি ওই সমাবেশ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির ‘সুফল’-এমন নানা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ চলছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। ঢাকার সমাবেশের পর জামায়াতের নেতাকর্মীরা চাঙাও হন। পরে সব সাংগঠনিক বিভাগে সমাবেশ এবং এরপর বড় জেলা শহরে সমাবেশের সিদ্ধান্ত নেয় দলটি। কিন্তু গত ১৫ জুলাই সিলেটে সমাবেশ করার কথা থাকলেও অনুমতি না পাওয়ায় করতে পারেনি। শনিবারও চট্টগ্রামে সমাবেশ করার কথা থাকলেও পুলিশের অনুমতি পায়নি। এমন পরিস্থিতিতে অনেকটা চাপে পড়েছে জামায়াত। জানতে চাইলে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘আমরা চাই সমাবেশের জন্য সরকার অনুমতি দেবে এবং দেওয়া উচিত। আইন মেনে মাঠে নামার চেষ্টা করব। কিন্তু তারপরও যদি না হয় তাহলে সরকারবিরোধী আন্দোলনে তো নামবই। এখন নিজস্ব জায়গায় দাঁড়িয়ে আমরা আন্দোলন করছি, সামনে কী হয় তা সময়ের ব্যবধানে বোঝা যাবে।’ বিএনপির নেতৃত্বে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো একদফার দাবি নিয়ে যুগপৎ আন্দোলনে নেমেছে। এতে চরমোনাই পির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও সমর্থন দিয়েছে। বিরোধী অধিকাংশ রাজনৈতিক দল সরকার পদত্যাগে মাঠে সরব থাকলেও জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে অনেকেই নানা প্রশ্ন তুলছেন। ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, ‘যুগপৎ আন্দোলনের জন্য তো দুপক্ষকেই (বিএনপি ও জামায়াত) এগিয়ে আসতে হবে। দশ দফা বলেন আর পাঁচ দফা বলেন সবই একদফা। আমরা মনে করি মূলত বর্তমান সরকারের পতন ঘটানো এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা-এটাই একদফা। জামায়াত আন্দোলনে আছে, বিএনপিও আন্দোলনে আছে। অন্যান্য বিরোধী দলও আন্দোলনে আছে। এ আন্দোলনের লক্ষ্য এক। একপর্যায়ে একটা জায়গায় মিলিত হতে হবে।’ বাংলাদেশে সফররত ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) প্রাক-নির্বাচনি অনুসন্ধানী দল আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জাতীয় পার্টিসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বৈঠক করে। এতে জামায়াতে ইসলামীও ছিল। সেখানেও দীর্ঘদিন পর দলটির শীর্ষনেতাদের প্রকাশ্যে দেখা যায়। নেতারা জানান, ভোটের মাঠে জামায়াতের গুরুত্ব রয়েছে বলেই বিদেশিরা আমন্ত্রণ জানিয়েছে। বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনে যাবেন না সে বিষয়টিও তারা ইইউ প্রতিনিধিদলের কাছে তুলে ধরেছেন। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আবদুল হালিম গত শনিবারও পঞ্চগড় জেলা শাখার উদ্যোগে ভার্চুয়ালি এক সভায় বলেন, ‘এ সরকারের অধীনে আর কোনো নির্বাচন নয়। বাংলাদেশ এখন সংকটের আবর্তে নিপতিত। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের মাধ্যমেই এ সংকট উত্তরণ সম্ভব। দৃঢ়ভাবে বলতে চাই, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া আমরা কোনো নির্বাচনে যাব না।’ এদিকে বিএনপি ও জামায়াতের একাধিক নেতা ইঙ্গিত দিয়েছেন, একপর্যায়ে যুগপৎ আন্দোলনে আবারও জামায়াতে ইসলামীও যুক্ত হবে। সেই সুযোগ ও সময়ের অপেক্ষায় রয়েছে জামায়াত। এ নিয়ে বিএনপির দুজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে জামায়াতের দায়িত্বশীল দুই নেতার কথাও হয়েছে। ‘কৌশলগত’ কারণে এখন তারা নিজস্বভাবে পৃথক কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে। কারণ দুই দলের দাবি প্রায় একই, লক্ষ্যও এক। একদফা দাবিতে বিএনপির পদযাত্রা কর্মসূচিতে হামলা ও বাধার নিন্দা জানিয়ে মঙ্গলবার জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সভা শেষে দেওয়া এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে আরও স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলেছে। গণমাধ্যমে পাঠানো ওই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘মঙ্গলবার বিএনপির পূর্বঘোষিত পদযাত্রা কর্মসূচি চলাকালে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালায়। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ এসব ন্যক্কারজনক ঘটনার তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাচ্ছে। সরকারের ভূমিকায় প্রতীয়মান হয়েছে, সরকার বিরোধী রাজনৈতিক দলের ওপর হামলা ও জুলুম-নির্যাতন চালিয়ে দেশকে সংঘর্ষের দিকে নিয়ে যেতে চায় এবং ২০১৪ ও ২০১৮ সালের স্টাইলে নির্বাচনের নামে প্রহসনের আয়োজন করে আবারও ক্ষমতায় আসতে চায়। জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের অভিমত হচ্ছে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার পুনর্বহাল ছাড়া জনগণ দলীয় সরকারের অধীনে কোনো প্রহসনের নির্বাচন মেনে নেবে না।’