গণঅভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে চট্টগ্রামের উপজেলাগুলোতে উন্নয়নকাজে যে পরিমাণ অনিয়ম, দুর্নীতি হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে অন্যতম বাঁশখালী। বড় প্রকল্পে অনিয়মের তথ্য মানুষের মুখে মুখে ঘুরলেও ছোট্ট প্রকল্প নিয়ে মাথাব্যথা নেই কারও। যদিও কয়েক কোটি টাকার এসব ছোট উন্নয়ন প্রকল্পেও হয়েছে বিস্তর লুটপাট। যার ভুক্তভোগী এখন বাঁশখালীর মানুষ।
এর মধ্যে উপজেলার দুটি ওয়ার্ডের সংযোগ সড়ক নির্মাণে নিম্নমানের ইট, বালু, পাথর, কংক্রিট ও সিমেন্ট ব্যবহার করায় অল্পদিনেই সড়কের বেশিরভাগ স্থানে উঠে যাচ্ছে ঢালাই, ফেটে গিয়ে দেখা মিলছে গর্তের। ২০২৩ সালে ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার ২৮৫ টাকার একটি ছোট্ট রাস্তার প্রকল্পেও কাজ না করেই অধিকাংশ অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান তাহিরা এন্টাপ্রাইজের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগীরা গত ছয় মাস ধরে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে সরকারের সংশ্লিষ্ট কয়েকটি দপ্তরে এরই মধ্যে অন্তত ছয়টি লিখিত অভিযোগ জমা দিলেও দৃশ্যমান কোনো ব্যবস্থাই নেননি সংশ্লিষ্টরা।
তবে যার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ, সেই ঠিকাদার মোহাম্মদ ইসমাইল সবকিছু অস্বীকার করেছেন। তার দাবি, বন্যা হওয়ায় পানির তোড়ে রাস্তার এমন দুর্দশা হয়েছে। অন্যদিকে, উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেও সম্প্রতি দেওয়া দুই অভিযোগের একটিও আমলে নেওয়া হয়নি। আর ঠিকাদারের ভাষ্যের সঙ্গে কোনো মিল নেই উপজেলা প্রকৌশলীর। তার দাবি, সড়ক নির্মাণের পর তা ২৮ দিন বন্ধ রাখতে হয়। কিন্তু দু-তিন দিনের মাথাতেই এলাকার লোকজন ওই সড়কে গাড়ি চালানোর ফলে সৃষ্টি হয়েছে এমন ফাটল ও গর্ত।
এদিকে, বিষয়টি নিয়ে খোঁজখবর শুরুর পর প্রতিবেদককে দফায় দফায় কল করে এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ না করতে অনুরোধ জানান অভিযুক্ত ঠিকাদার। এ ছাড়া অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় নিজের লাইসেন্স বাঁচানো ও কাজের অডিট এড়াতে অভিযোগকারীকেই ম্যানেজের চেষ্টায় রয়েছেন ঠিকাদার। সেই তথ্য তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন কাছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আওয়ামী লীগের শাসনামলে চট্টগ্রামের প্রভাবশালী নেতাদের ব্যবহার করে বিভিন্ন কাজ পান ঠিকাদার মো. ইসমাইল। তার বেশিরভাগ কাজ নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। জনশ্রুতি রয়েছে, এমপি-মন্ত্রী ও প্রশাসনের কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সব ‘ঘাটে ঘাটে’ ঘুষ দেওয়ায় তখন তিনি ছিলেন আলোচনার বাইরে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাঁশখালী উপজেলার ৭ নম্বর সরল ইউনিয়নের ৮ ও ৯ নম্বর ওয়ার্ডের পাইরাং টু সরল ইউপি বাই জালিয়াঘাটা সংযোগ সড়কের বিভিন্ন অংশে ফাটল দেখা দিয়েছে। উঠে যাচ্ছে ঢালাই, যা লেগে যাচ্ছে জুতা বা পায়ের সঙ্গে। বিভিন্ন অংশে সৃষ্টি হয়েছে গর্তও। নতুন দেখায় যে কেউ সড়কটি পুরোনো ভাবলেও এর কাজ শেষ হয়েছে মাত্রই এক বছর আগে।
রাস্তাটি দিয়ে চলাচলে এলাকাবাসীর হয়রানির চিত্র তুলে ধরে গত ছয় মাসে এ পর্যন্ত সরকারি সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অন্তত ছয়টি চিঠি দিয়েছেন মো. মাসুম হোসাইন। অবগত করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরসহ সরকারের স্থানীয় সব দপ্তরকেই। কিন্তু কার্যত কোনো ভূমিকাই নেননি তারা।
হাতে আসা নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, সবশেষ গত ১৩ নভেম্বর বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন স্থানীয় বাসিন্দা মো. মাসুম হোসাইন। এর আগে গত ৪ মে ইউএনও বরাবর প্রথম লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। পরে গত ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক (ডিসি) বরাবর লিখিত অভিযোগ দেন মাসুম হোসাইন। এ ছাড়া গত ৮ অক্টোবরও কয়েকজন স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সুপারিশ নিয়ে ফের ডিসি বরাবর আরেকটি লিখিত অভিযোগ দেন মাসুম। একই তারিখে চট্টগ্রাম এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে অভিযোগ দেন। এর আগে গত ৫ মে চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের অতিরিক্ত বিভাগীয় সচিব বরাবর একই তথ্য জানিয়ে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। সেই কাগজে দেখা যায়, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) মোহাম্মদ নুরুল্লাহ নূরী বাঁশখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। প্রতিটি অভিযোগেই তিনি অনিয়ম, দুর্নীতির বিষয়গুলো স্পষ্ট করে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানান। বলেন, স্থানীয়রা সড়কটির এমন বেহাল দশার কারণে বিপাকে পড়েছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থাই কেউ নেননি বলে অভিযোগ করেন মো. মাসুম হোসাইন।
তিনি বলেন, ‘মূলত টেন্ডারটি হয়েছিল সিসি ঢালাই দেওয়ার জন্য। কিন্তু ওই ঠিকাদার তা না করে এমন নিম্নমানের ইট, বালু, পাথর, কংক্রিট, সিমেন্ট ব্যবহার করেছে যে, পুরো রাস্তাটির ঢালাই এখন উঠে যাচ্ছে এবং ফেটে যাচ্ছে। গত কয়েকটিন আগে আগে তারা বিষয়টি জনগণ যেন বুঝতে না পারেন, সেজন্য কালো রং রাস্তায় মিক্স (মেশাতে) করতে আসেন। বিষয়টি বোঝার সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় ক্ষুব্ধ জনতা তাদের ধরে ফেলেন। রাস্তার এমন নিম্নমানের কাজ নিয়ে প্রশ্ন করায় ঠিকাদারের লোকজন কাজ ফেলেই এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যায়।’
সরল ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান রোকসানা আকতার বলেন, ‘আমি নিজেও বিভিন্নবার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে দেখেছি, নির্মাণ করা রাস্তাটির ইট, বালু এরই মধ্যে উঠে গেছে। সড়কের মাঝখানে-মাঝখানে গর্ত হয়ে গেছে। পাশাপাশি ফাটলও ধরেছে। এর মধ্যে শুনেছি, সব জায়গায় অভিযোগ যাওয়ার পর ইঞ্জিনিয়ার অফিস থেকে লোকজন কাজ করতে এসেছিল। তখন স্থানীয়রা নাকি বাধা দিয়েছিল, এমনটা শুনেছিলাম। মূলত নির্ধারিত কাজের চেয়ে এ মানটা অনেক কম হয়েছে। ভালো পণ্য ব্যবহার না করায় রাস্তার এ অবস্থা হয়েছে। অন্য জায়গায় তো আর ফাটল ধরছে না। কাজটি করার সময় আমরা দেখিনি। ফলে এতে ঠিকাদার অথবা এলজিইডির ইঞ্জিনিয়ারসহ কাদের গাফিলতি ছিল, তা আমরা বলতে পারব না।’
জানতে চাইলে বাঁশখালীর ইউএনও মোহাম্মদ জামশেদুল আলম বলেন, ‘এটি মূলত এলজিইডির রাস্তা। এ বিষয়ে এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী ভালো বলতে পারবেন। অভিযোগটি উনাকেও দিয়েছেন, উনি যদি কোনো ব্যবস্থা নেন। উপজেলা প্রশাসন থেকে সাহসী কিছু করার সুযোগ নেই, বলারও কিছু নেই।’
বাঁশখালী উপজেলা প্রকৌশলী কাজী ফাহাদ বিন মাহমুদ বলেন, ‘সড়কটি নির্মাণের সময় যা যা উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, সবই আমরা তখন প্লান্টে গিয়ে চেক করেছি। তখন নির্বাহী প্রকৌশলীর ল্যাব থেকে সব টেস্ট হয়েছে। সেই টেস্ট রিপোর্টসহ সবকিছু আমাদের আপডেট আছে। সবকিছু ভালো করে পরীক্ষা করে কাজটি করা হয়েছে। আসলে ওই ইউনিয়নে যাওয়ার অন্যতম প্রধান সড়কই ওটা। আমাদের আশপাশে যে কয়টি সড়ক—মিয়ার বাজার, হারুন বাজারের কাজ চলছে। পৌরসভার বিভিন্ন দিকে কাজ চলছে। ফলে ওই রাস্তাগুলো বন্ধ। আমাদের এ রাস্তাটি এটা দেড় কিলোমিটার। নিয়ম হলো, সড়ক নির্মাণের পর ২৮ দিন তা বন্ধ রাখতে হবে এবং পানি দিয়ে কিউরিং করতে হবে। আমরা যখন আরসিসি ঢালাই করেছি, তখন দেখা গেছে মানুষ দু-এক দিনের মাথাতেই গাড়ি উঠিয়ে দিয়েছে। ফলে ২৮ দিন তো দূরের কথা—আমরা নির্মাণের পর সড়কটি দু-তিন দিনও বন্ধ রাখতে পারিনি মানুষের জন্য।’
তিনি আরও বলেন, ‘অটোরিকশা, ব্যাটারিচালিতরিকশা অনবরত চলছে। এর ফলে নির্ধারিত সময়ের আগেই যেহেতু লোড আসছে ফলে ওপরের সারফেসের কিছু নুড়ি পাথর উঠে গেছে। একটি রাফ সারফেস এসেছে। এখানে অডিট হওয়ার মতো কিছুই নেই। আমার কাছেও অভিযোগ করেছেন, আমি এরই মধ্যে পদক্ষেপ নিয়েছি। যেহেতু সড়কের ওপরের সারফেসটি খারাপ হয়েছে, আমি ঠিকাদারকে বাধ্য করে পাতলা কার্পেটিংয়ের মতো প্রলেপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি। আমরা ওইদিন কার্পেটিং করতে গিয়েছিলাম, কিন্তু মাসুম সাহেবের নেতৃত্বে কতগুলো লোকজন নাকি কাজে বাধা দিয়েছেন। তারা বলেছেন, এক থেকে দেড় ইঞ্চি পরিমাণ কার্পেটিং করতে হবে এবং পুরো রাস্তা করতে হবে। যেখানে রাস্তা ভালো আছে, সেখানে কি এটা করার দরকার আছে?’
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তাহিরা এন্টাপ্রাইজের মালিক মোহাম্মদ ইসমাইল বলেন, ‘রাস্তা নির্মাণের সময় বন্যা হয়েছিল। আমরা যখন কাজ করেছিলাম, তখন পানির প্লাবনে রাস্তার ওপরের সারফেস উঠে যায়। মাসুম দরখাস্ত দেওয়ার পর উপজেলা ইঞ্জিনিয়ার ফোন করে আমাকে বলেছেন, ‘ভাই আপনার ও আমার বিরুদ্ধে দরখাস্তটি দেওয়া হয়েছে। আপনি টাকা পান বা না পান, কাজটি শেষ করে দেন।’ আমি ৩ কোটি ৩৭ লাখ ৭৫ হাজার ২৮৫ টাকার মধ্যে মনে হয় আর ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা পাওনা আছি। বাকি টাকাগুলো আমি পেয়েছি।’