নিরাপদ নগরীর দাবিতে শিল্পকলায় একশনএইডের বিশেষ প্রদর্শনী

প্রকাশিতঃ নভেম্বর ২৭, ২০২৫ | ৭:৪৪ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

নারী ও কন্যাশিশুদের জন্য একটি নিরাপদ নগরী গড়ে তোলার জোরালো দাবিতে ১৬ দিনব্যাপী জেন্ডারভিত্তিক সহিংসতা প্রতিরোধ প্রচারাভিযান শুরু করেছে একশনএইড বাংলাদেশ। বিশ্বজুড়ে পালিত এই ক্যাম্পেইনের অংশ হিসেবে বুধবার ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে রাজধানীর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমিতে দিনব্যাপী বিশেষ কর্মসূচির আয়োজন করা হয়। কর্মসূচির শুরুতে শিল্পকলা একাডেমির উন্মুক্ত প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত হয় ‘স্টোরিজ অফ কারেজ’ শীর্ষক এক জীবন্ত আউটডোর পারফরম্যান্স ও ইনস্টলেশন সিরিজ। এই প্রদর্শনীতে নারীদের সাহস ও প্রতিকূলতা মোকাবিলার গল্পগুলো তুলে ধরা হয়। এরপর চিত্রশালা মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় ‘একোজ অফ হার লাইফ’ নামে একটি শক্তিশালী ইনডোর নাটক। নাটকটিতে গণপরিবহন, পাবলিক স্পেস এবং সেবাপ্রতিষ্ঠানে নারীদের দৈনন্দিন হয়রানি ও নিরাপত্তাহীনতার বাস্তব চিত্র তুলে ধরা হয়, যা উপস্থিত দর্শকদের গভীরভাবে নাড়া দেয়। নগরীতে অনলাইন ও অফলাইনে নারীরা কেমন নিরাপদ আছেন সে বিষয়টি তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশ-এর উইমেন রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইকুইটি টিমের লিড মরিয়ম নেছা। নাটক মঞ্চায়নের ফাঁকে অনুষ্ঠিত ইন্টারেক্টিভ আলোচনা অধিবেশনে বক্তারা নারীর প্রতি সহিংসতা কমাতে আইনের কঠোর প্রয়োগ, জেন্ডার-সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনায় সংস্কার এবং সামাজিক নৈতিকতার উন্নয়নের ওপর জোর দেন। বক্তারা পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতার পরিবর্তন এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে শিক্ষা পাঠক্রমে সচেতনতা অন্তর্ভুক্ত করার গুরুত্ব তুলে ধরেন। জেন্ডার-সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা গ্রহণ করে পাবলিক স্পেস ও গণপরিবহনকে নারীবান্ধব করার অঙ্গীকার করেন। হয়রানির অভিযোগের ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক ও কঠোর আইনি ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়েও জোর দেওয়া হয়। নারীর জন্য নিরাপদ নগরী নিশ্চিত করতে প্রশাসন, নীতি ও নাগরিকদের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য বলে মনে করেন বক্তারা। নিরাপদ নগরী ক্যাম্পেইনের আওতায় একশনএইড বাংলাদেশ-এর পরিচালিত গবেষণার তথ্য উল্লেখ করে কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির জানান, “আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, ২০২১ ও ২০২২ সালে অনলাইনে নারীর প্রতি সহিংসতা ৬৩ শতাংশ হয়েছে। এর কারণে ৪২ শতাংশ নারী তাদের অনলাইন উপস্থিতি কমিয়ে দিয়েছে। এছাড়া, ৬৩ শতাংশ নারী ভয় বা আশঙ্কা নিয়ে বাইরে বের হন এবং গণপরিবহনে ২২ শতাংশ নারী হয়রানির শিকার হন। এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে যে নারীরা অনলাইন বা অফলাইন কোনও ক্ষেত্রেই সম্পূর্ণ নিরাপদ নয়।” তিনি আরও বলেন, “সহিংসতা অব্যাহত থাকার প্রধান কারণ হলো প্রশ্রয় এবং জবাবদিহিতার অভাব।” তিনি এক্ষেত্রে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সবাইকে সহযোগী হিসেবে সহিংসতার বিরুদ্ধে কাজ করার আহ্বান জানান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. তানিয়া হক সহিংসতা বাড়ার পেছনে ‘কালচারাল ভায়োলেন্স’ এবং সমাজে এর গ্রহণযোগ্যতাকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘নীরব সাক্ষী’ না হয়ে নগর কমিউনিটিকে হয়রানির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবে। মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী বলেন, “পুরুষ ও ছেলেদের ইতিবাচক সংস্কারের মাধ্যমে সহযোগী হিসেবে না রাখতে পারলে সহিংসতা কমবে না। সরকার ও নাগরিক সমাজকে মিলে প্রতিরোধমূলক (Prevention) কাজে মনোযোগ দিতে হবে।” অন্যদিকে, ডিএনসিসি-এর প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ এস এম শফিকুর রহমান নগরীর নকশায় নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জেন্ডার-সংবেদনশীল পরিকল্পনা গ্রহণের অঙ্গীকার করেন। ডিএমপি-এর উপ-পুলিশ কমিশনার মোছাঃ ফারহানা ইয়াসমিন দ্রুত রিপোর্ট করার জন্য নাগরিকদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং থানায় নারী পুলিশদের জনবল বাড়ানোর পাশাপাশি তাদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে সহিংসতার শিকার নারীদের সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে ইউএনডিপি-এর জেন্ডার টিম লিড শারমিন ইসলাম গণপরিসরে সিসিটিভি নজরদারি জোরদার এবং জেন্ডার বাজেট বৃদ্ধি করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, “বিচারহীনতা সংস্কৃতির কারণেই সহিংসতা বাড়ছে, তাই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রচলিত পাঠক্রমে জেন্ডার সংবেদনশীলতা অন্তর্ভুক্ত করা জরুরি।” এছাড়া উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চলচ্চিত্র নির্মাতা ফখরুল আরেফিন খান, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহকারী পরিচালক জেসমিন আরাসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ নীতিনির্ধারক, নগর পরিকল্পনাবিদ এবং সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, এই ১৬ দিনব্যাপী প্রচারাভিযান একশনএইড বাংলাদেশ-এর নিরাপদ নগরী ক্যাম্পেইনের অংশ। ২৫ নভেম্বর থেকে ১০ ডিসেম্বর পর্যন্ত দেশের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় পর্যায়েও বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করা হবে, যা সহিংসতা মোকাবিলায় একটি টেকসই আন্দোলন গড়ে তুলতে সহায়তা করবে।