৩৮০১ কোটি টাকার প্রকল্পে পরামর্শেই খরচ ৮০৮ কোটি

প্রকাশিতঃ ডিসেম্বর ১২, ২০২৫ | ৬:২৯ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার পানি নিরাপত্তা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা এখনো অপর্যাপ্ত। নদী-খাল দূষণ, অপর্যাপ্ত স্যুয়ারেজ নেটওয়ার্ক এবং বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সীমাবদ্ধতার কারণে শহরের পানির মান ও জনস্বাস্থ্য ঝুঁকির মুখে। এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ‘মেট্রো ঢাকা ওয়াটার সিকিউরিটি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম’ শিরোনামে একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। প্রকল্পটি ঢাকা উত্তর, ঢাকা দক্ষিণ এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন ও ঢাকা ওয়াসার মাধ্যমে বাস্তবায়িত হবে। প্রকল্পের লক্ষ্য খাল খনন ও পুনর্বাসন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন এবং বর্ষার পানি দ্রুত নিষ্কাশন নিশ্চিত করা। তবে বর্জ্য ও স্যানিটেশন ব্যবস্থার উন্নয়নে নেওয়া প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও ব্যয় প্রস্তাব নিয়ে গুরুতর প্রশ্ন উঠেছে। আলোচ্য প্রকল্প বাস্তবায়নে পরামর্শকদের পেছনে ৮০৮ কোটি টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে, যাকে অস্বাভাবিক বলছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া সুনির্দিষ্ট সমীক্ষা ছাড়াই প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অত্যধিক ব্যয় প্রস্তাব করা হয়েছে, যা নিয়ে আপত্তি তুলেছে খোদ পরিকল্পনা কমিশনও। নানা ত্রুটিবিচ্যুতি থাকার পরও প্রকল্পটি দ্রুত অনুমোদনে চাপ রয়েছে এক উপদেষ্টার। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ‘মেট্রো ঢাকা ওয়াটার সিকিউরিটি অ্যান্ড রেজিলিয়েন্স প্রোগ্রাম’ শীর্ষক প্রকল্প বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮০১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৩ হাজার ৬৩০ কোটি টাকা ঋণ হিসেবে দেবে বিশ্বব্যাংক। বাকি ১৭১ কোটি ২০ লাখ টাকা দেবে বাংলাদেশ সরকার। প্রকল্পে বাস্তবায়ন কাজ চলতি মাসে শুরু করে ২০৩১ সালের মধ্যে শেষ করতে চায় এলজিআরডি মন্ত্রণালয়। আলোচ্য প্রকল্পের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য—টেকসই পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, পানি শোধনের সক্ষমতা বাড়ানো, ট্রিটমেন্ট প্লান্ট উন্নয়ন, নতুন বিতরণ লাইন তৈরি, ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানো, বিকল্প পানির উৎস তৈরি, আধুনিক শোধন প্রযুক্তি ব্যবহার, আধুনিক স্যানিটেশন ব্যবস্থা চালু করা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়ন, নদী-খাল দূষণ কমানো, পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্য সুরক্ষা, নদীর পানি দূষণ নিয়ন্ত্রণ, পানিবাহিত রোগ কমানো এবং পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার। উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) বলা হয়েছে, ঢাকা শহরের পানি নিরাপত্তা ও স্যানিটেশন ব্যবস্থা দীর্ঘদিন ধরেই সংকটাপন্ন। একদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর অতিরিক্ত নির্ভরতা, অন্যদিকে শহর-সংলগ্ন নদীগুলোর ভয়াবহ দূষণ ভবিষ্যতে পানির প্রাপ্যতাকে হুমকির মুখে ফেলেছে। এ ছাড়া সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা, অস্পষ্ট দায়িত্ব বণ্টন এবং দীর্ঘসূত্রতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সমন্বিত উদ্যোগের অংশ হিসেবে প্রস্তাবিত এ প্রকল্পের মাধ্যমে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ উপকৃত হবে বলে আশা করা হয়েছে। প্রকল্পের প্রধান কাজের মধ্যে রয়েছে ঢাকা উত্তর সিটির বাউনিয়া ও রূপনগর খাল পুনর্বাসন, ডিএনসিসির জোন ২ ও ৩ থেকে ফিকাল স্লাজ ব্যবস্থাপনা এবং পুনর্ব্যবহারযোগ্য বর্জ্য বাছাই কেন্দ্র নির্মাণ, ঢাকা দক্ষিণে কাজলা, মৃধাবাড়ি ও জিয়া সড়ক খালের পুনর্বাসন, নতুন গভীর ড্রেন নির্মাণ, ওয়ার্ড ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৭১ ও ৭২-এ উন্নত স্যানিটেশন কার্যক্রম এবং মাতুয়াইল ল্যান্ডফিল্ডে একটি নতুন রিসাইক্লিং প্ল্যান্ট নির্মাণ, নারায়ণগঞ্জে পানি নিষ্কাশন উন্নয়নে লক্ষণখোলা, লুহিয়ার, মজুমদার, সোনাকান্দা, মাহমুদ নগর ও মোডংগঞ্জসহ গুরুত্বপূর্ণ খাল পুনর্বাসন করা। এ ছাড়া ঢাকা ওয়াসার নর্দমা ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে ২০ হাজার সংযোগ স্থাপন, ১৬ কিলোমিটার ইন্টারসেপ্টর নির্মাণ এবং স্লাজ লিফটিং স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে। তিন সিটি করপোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়নে ১০টি এসটিএস ও একাধিক এমআরএফ স্থাপন, যানবাহন ও সরঞ্জাম কেনা, ডিজিটাল ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম চালু এবং জনসচেতনতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ঋণের টাকা পরামর্শকের পেছনে, প্রশাসনিক ব্যয়ই হাজার কোটি টাকার বেশি: পানি-বর্জ্য সংকট মোকাবিলায় প্রস্তাবিত প্রকল্পে বিতর্কিত বিষয় হয়ে উঠেছে পরামর্শক খাতের ব্যয়। ডিপিপি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, প্রকল্পে মোট ১৬ ক্যাটাগরির পরামর্শক নিয়োগের মাধ্যমে ৮০৮ কোটি ৭৮ লাখ ৫০ হাজার টাকা ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়েছে। অর্থাৎ ৩ হাজার ৮০১ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রকল্পে পরামর্শকদের পেছনেই খরচ হবে প্রায় ৮০৯ কোটি টাকা, যা মোট প্রকল্প ব্যয়ের ২১ দশমিক ২৭ শতাংশ। ঋণ করে পরামর্শক খাতে এই বিপুল অর্থ ব্যয়ের প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক ও অত্যাধিক বলছেন পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, ঋণের বড় অংশ যদি পরামর্শকদের পেছনে খরচ হয়ে যায়, তাহলে এ প্রকল্পে জনগণের উপকারের তুলনায় বাইরের বিশেষজ্ঞদের আয়ই দাঁড়াবে বেশি। দেশের উন্নয়ন প্রকল্পে পরামর্শক ব্যয় সাধারণত এত বেশি হয় না। কিন্তু এই প্রকল্পে তা ২১ শতাংশের বেশি, যা নজিরবিহীন। এ ছাড়া সিটি করপোরেশন, ওয়াসা ও এলজিআরডি বহু বছর ধরে কাজ করার পরও ১৬ ধরনের পরামর্শক নিয়োগের যৌক্তিকতা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। বিশ্লেষকদের মতে, ঢাকার পানি নিরাপত্তা ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা উন্নয়নে বড় প্রকল্পের প্রয়োজনীয়তা থাকলেও সেই সুযোগে পরামর্শক ও প্রশাসনিক ব্যয় অস্বাভাবিকভাবে বাড়ানোর চেষ্টা উদ্বেগজনক। ঋণের অর্থ অযৌক্তিক খাতে ব্যয়ের প্রস্তাব করা হলে এর দায় শেষ পর্যন্ত দেশের মানুষের ওপরই পড়বে। বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন (more…)