চট্টগ্রাম নগরীর অক্সিজেন মোড় থেকে এক কিলোমিটার দূরে চক্রকানন আবাসিক এলাকা। সেখানকার জেএফ ম্যানশনের পাঁচতলার ‘বি’ নম্বর ফ্ল্যাটে থাকতেন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক সাকিয়াতুল কাউছার। এখানে থেকেই জীবনের স্বপ্ন বুনছিলেন তিনি। স্বামী সরোয়ার কামালও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। প্রতিদিনের মতো গতকাল মঙ্গলবার সকালে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হন শিক্ষক দম্পতি। কিন্তু স্বামী কর্মস্থলে পৌঁছালেও বিকেলে ঘরে ফিরে আসে স্ত্রীর মরদেহ। উল্টো পথে আসা একটি বাস চাপা দিয়ে কেড়ে নিয়েছে সাকিয়াতুলের প্রাণ। সেই সঙ্গে চাপা দিয়েছে একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের স্বপ্নকেও। এদিকে, রাজধানীর দারুস সালামে পিকআপের ধাক্কায় গুরুতর আহত হয়ে লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন ইয়াসমিন রহমান লাভলী নামের এক শিক্ষিকা। এদিকে চট্টগ্রাম ব্যুরো জানায়, গতকাল সন্ধ্যায় নগরীর ওই বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তালা ঝুলছে শিক্ষক দম্পতির ঘরে। লাশ দাফন করতে স্বামীসহ পরিবারের সবাই তখন ছিলেন কুতুবদিয়ার পথে। বাসার নিচে কথা হয় দারোয়ান লিটন বড়ুয়ার সঙ্গে। তিনি জানান, খুব ভালো একটি পরিবার ছিল। কিন্তু এক দুর্ঘটনায় সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। একমাত্র মেয়ে ফাবিয়া আনবার রাহিকে ডাক্তার বানানোর স্বপ্ন ছিল শিক্ষক দম্পতির। সেই স্বপ্নকে পূর্ণতা দিতেই এক বছর আগে হাটহাজারী থেকে চট্টগ্রাম নগরীর বায়েজিদের চক্রকানন আবাসিক এলাকায় এসে এই ভাড়া বাসায় ওঠেন তাঁরা। মেয়েকে ভর্তি করান বাসার পাশের চট্টগ্রামের নামকরা ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল অ্যান্ড কলেজে। মেয়ে ফাবিয়া বিজ্ঞান বিভাগের একাদশ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। প্রতিদিন মেয়েকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে হাটহাজারীতে নিজের কর্মক্ষেত্র কাজিরখীল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষকতা করতেন সাকিয়াতুল। মানুষ গড়ার কারিগর মা-বাবা দু’জনই একমাত্র সন্তানকে গড়ে তুলছিলেন। কিন্তু ঘাতক বাসচালকের কারণে ছারখার হয়ে গেল তাঁদের সোনার সংসার। মেয়েকে ডাক্তার বানানোর আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হলো মাকে। সকাল পৌনে ৯টার দিকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার ক্যান্টনমেন্ট পাবলিক স্কুল মোড়ে উল্টো পথে আসা বাসের চাপায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন শিক্ষিকা সাকিয়াতুল কাউছার। তাঁর স্বামী সরোয়ার কামাল নগরের আশেকানে আউলিয়া আবদুল মোনায়েম উচ্চ বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে কর্মরত। মোবাইল ফোনে সরোয়ার কামাল বলেন, ২৩ বছর ধরে আমার স্ত্রী শিক্ষকতা করে আসছে। আমাদের সংসারে একটি মাত্র মেয়ে। মেয়ের ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করেই আমরা হাটহাজারী ছেড়েছি। মেয়ে মেধাবী হওয়ায় স্ত্রীর স্বপ্ন ছিল, তাকে ডাক্তার বানানোর। সে চিকিৎসক হয়ে মানুষের সেবা করবে– এটাই ছিল স্ত্রীর স্বপ্ন। কিন্তু বাসচালক আমার সোনার সংসার শেষ করে দিল। আমি বাসচালকের ফাঁসি চাই। কারণ, সে উল্টো পথে এসে আমার স্ত্রীকে খুন করেছে। এটি কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নয়। এটি সরাসরি হত্যাকাণ্ড। কান্নাজড়িত কণ্ঠে এই শিক্ষক বলেন, ২০২২ সালের ১ জানুয়ারির আগে আমরা হাটহাজারীর কাচারি রোডের ছালামত উল্ল্যাহ ভবনে থাকতাম। সেখান থেকে বায়েজিদ বোস্তামী না এলে মনে হয়, আমার স্ত্রী বেঁচে থাকত। প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার সকালে নিজের স্কুলে চলে যাই আমি। সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগ থেকে আমাকে ফোন করা হয়। দ্রুত মেডিকেলে আসতে বলা হয়। স্কুলের একজন সহকর্মীকে সঙ্গে করে একটি অটোরিকশা নিয়ে চলে আসি। হাসপাতালে আসার পর স্ত্রী সড়ক দুর্ঘটনা মারা গেছে বলে জানাতে পারি। মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবন কীভাবে কাটাব– সেটা নিয়েই চিন্তা আমার। গতকাল রাতেই কুতুবদিয়ার কৌয়ারবিল নজর আলী মাতব্বরবাড়ির পারিবারিক কবরস্থানে তাঁর লাশ দাফন করা হয়। নগরের বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. ফেরদৌস জাহান জানান, কর্মস্থলে যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠতে রাস্তা পার হচ্ছিলেন শিক্ষক সাকিয়াতুল। এ সময় উল্টো পথে দ্রুতগতিতে আসা বেপরোয়া একটি বাস তাঁকে চাপা দেয়। গুরুতর আহত অবস্থায় তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। হাটহাজারী থেকে নিউমার্কেটগামী ৮ নম্বর রুটের গাউছিয়া এন্টারপ্রাইজের বাসচালক রাজীবকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। অক্সিজেন মোড় থেকে ষোলশহর ২ নম্বর গেটের দিকে যাওয়ার সময় যানজট এড়াতে বাসটি উল্টো পথে দ্রুতগতিতে নিয়ে যাচ্ছিল চালক। বাসটিও জব্দ করা হয়েছে। লাইফ সাপোর্টে শিক্ষিকা:রাজধানীর দারুস সালাম এলাকায় বেপরোয়া পিকআপের ধাক্কায় স্কুলশিক্ষিকা গুরুতর আহত হয়েছেন। তাঁর নাম ইয়াসমিন রহমান লাভলী। গতকাল মঙ্গলবার বিকেল ৪টার দিকে এ ঘটনা ঘটে। লাভলী মিরপুরের সিদ্ধান্ত হাই স্কুলের মিউজিকের শিক্ষক। সংকটাপন্ন অবস্থায় তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। লাভলী সেখানকার ওয়ানস্টপ ইমার্জেন্সি সেন্টারে রয়েছেন। লাভলী ইয়াসমিনের ভাই আরিফুর রহমান বলেন, দারুস সালামের গোলারটেকের বাসা থেকে কয়েকশ গজ দূরে মর্মান্তিক এ ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১ নম্বরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে বাসা থেকে আমি বের হয়ে রাস্তায় তাজা রক্তের দাগ দেখি। তখনও জানতে পারিনি, বোনের রক্তে রাস্তা ভিজে আছে। এর কিছু সময় পরই দুর্ঘটনার খবর পাই। ততক্ষণে আপাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। স্কুল থেকে বাসায় ফিরছিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত স্কুলের পাশাপাশি বাংলাদেশ একাডেমি অব ফাইন আর্টসেও (বাফা) মিউজিকের শিক্ষিকা তিনি। দারুস সালামের স্থানীয় বাসিন্দা গিয়াস উদ্দিন জানান, দারুস সালাম ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কমিউনিটি সেন্টারের সামনের সড়ক হয়ে রিকশায় যাচ্ছিলেন লাভলী। ওই সময় দ্রুতগামী পিকআপ রিকশাটিকে ধাক্কা দেয়। এতে ছিটকে পড়েন তিনি। তাঁর মাথা, বুকসহ শরীরের বিভিন্ন জায়গায় আঘাত পেয়েছেন। পথচারীরা তাঁকে উদ্ধার করে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেন। এর পর চিকিৎসকের পরামর্শে লাভলীকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়েছে। তিনি এখন লাইফ সাপোর্টে রয়েছেন। দারুস সালামের গোলারটেকে পরিবারের সঙ্গে বাসবাস করেন তিনি। আহত শিক্ষিকার গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলে। দারুস সালাম থানার ওসি শেখ আমিনুল বাশার বলেন, পিকআপের চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। চালকের গাড়ির ড্রাইভিং লাইসেন্স রয়েছে কিনা, তা যাচাই করে দেখা হচ্ছে। মামলার প্রস্তুতি চলছে।