জ্বলানি সংকট সমাধানে স্বল্পমেয়াদে (শর্ট টার্ম) এলএনজি (লিকুইড ন্যাচারাল গ্যাস) বিক্রি করতে চায় রাশিয়া। এমন প্রস্তাব নাকচ করে দিয়েছে বাংলাদেশ। কেননা স্বল্পমেয়াদে আমদানি করতে হলে বেশি দাম দিতে হবে। সেইসঙ্গে বর্তমান চলমান ডলার সংকটের সময়ে দ্রুত অনেক বেশি ডলার পরিশোধ এবং অর্থ পরিশোধের জটিলতা (কোনো কারেন্সিতে) কাটানো সম্ভব নয় বলে মনে করা হচ্ছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে (কাতার, কুয়েত, আরব আমিরাত ইত্যাদি) যেমন দীর্ঘমেয়াদে (লং টার্ম) আমদানি চুক্তি রয়েছে, তেমনটিই করতে চায় ঢাকা। মঙ্গলবার রাশিয়ার সঙ্গে আন্তঃরাষ্ট্রীয় কমিশনের বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে এসব বিষয় উঠে আসে। সেখানে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। বৈঠকে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। রাজধানী শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আজ বুধবার অনুষ্ঠেয় তৃতীয় দিনে বৈঠক শেষে একটি প্রটোকল চুক্তি সই হবে বলে জানা গেছে। এদিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পে ঋণের কিস্তির অর্থ পরিশোধে যে সমস্যা চলছে সেটির কোনো সমাধান হয়নি। এ ক্ষেত্রে প্রথম দিনে ব্যাপক আলোচনায়ও কোনো ফলাফল আসেনি। ফলে দ্বিতীয় দিনেও আলোচনা গড়ায়। এতে বিষয়টি সমাধানে ভার্চুয়ালি বৈঠকের পরিবর্তে সরাসরি বৈঠক করার প্রস্তাব দিয়েছে বাংলাদেশ। সূত্র জানায়, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণের কিস্তি নিয়ে জটিলতা রয়েছে। কেননা এটিই রশিয়ার ঋণে বাস্তবায়নাধীন একমাত্র বৃহৎ প্রকল্প। ডলারে লেনদেনে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থাকায় রাশিয়ার ঋণের কয়েকটি কিস্তি বাকি রয়েছে। এই জটিলতা কাটাতে এর আগে নানা প্রস্তাব দেয় রাশিয়া। এ ক্ষেত্রে রাশিয়ান মুদ্রা রুবল অথবা চীনের বা তৃতীয় কোনো দেশের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধের প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিন্তু সেগুলো পর্যালোচনা করে রুবল বা অন্য কোনো মুদ্রায় কিস্তি পরিশোধ ঠিক হবে না বলে জানায় ইআরডি। সূত্র জানায়, বৈঠকের প্রথম দিন সোমবার ১৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ কমিশন বৈঠকের আলোচনায় অংশ নিয়েছিল। দ্বিতীয় দিন প্রায় ৩০টি মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে-বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়, কৃষি মন্ত্রণালয় এবং বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। আরও আছে রেলপথ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ এবং হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষ ইত্যাদি। আজকের বৈঠকে অংশ নেবে প্রায় ১৭টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। দ্বিতীয় দিন ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) সচিব শরিফা খানের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি অন্য কর্মসূচি থাকায় যোগ দিতে পারেননি। দ্বিতীয় দিনেও বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও ইউরোপ উইংয়ের প্রধান উত্তম কুমার কর্মকার। রাশিয়ার পক্ষে রাশিয়া ফেডারেশনের ফেডারেল এজেন্সি ফর ফিশারিজের প্রধান ইলিয়া ডি শেসতাকভ। বৈঠকে দ্বিতীয় দিনে অংশ নেওয়া একাধিক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, রাশিয়ার পক্ষ থেকে আমেরিকার নিষেধাজ্ঞায় থাকা ৬৯টি রুশ জাহাজ বাংলাদেশে ভিরতে না দেওয়ার বিষয়টি তুলে ধরা হয়। রাশিয়া বলেছে, এসব জাহাজ বন্দরে যাতে ভিড়তে পারে সে বিষয়ে বাংলাদেশকে ব্যবস্থা নিতে হবে। সেই সঙ্গে গত ২০ ডিসেম্বর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল বোঝাই রাশিয়ার একটি জাহাজ সমুদ্রবন্দরের কাছাকাছি এলেও মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কারণে ভিড়তে দেয়নি বাংলাদেশ। এ ঘটনার বিষয়েও উষ্মা প্রকাশ করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে এটা সম্ভব নয়। কেননা এই নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আমেরিকা। তাই এটি তুলতে গেলে তারাই কেবল পারবে। এছাড়া বিষয়টি রাজনৈতিক হওয়ায় কমিশন বৈঠকে আলোচনার বিষয় নয়। এছাড়া ভোলায় গ্যাস অনুসন্ধানে আরও সমীক্ষা করতে চায় রাশিয়া। পাশাপাশি পেট্রোবাংলা ও গ্যাজপ্রমকে কারিগরি সহায়তা দেওয়ার কথা বলেছে দেশটি। সেইসঙ্গে যত দ্রুত সম্ভব স্থল ও সমুদ্রে সাড়ে চার হাজার থেকে ছয় হাজার মিটার গভীরতায় কূপ খনন করে গ্যাস ও তেলের অনুসন্ধান করতে চেয়েছে। পাশাপাশি গ্যাসের বিষয়ে একটি মাস্টার প্ল্যান তৈরি করে দিতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে দেশটি। এছাড়া রাশিয়া চলতি বছরের মধ্যে একটি চুক্তি করতে চায়, যার আওতায় দীর্ঘমেয়াদে এলএনজি থেকে এলপিজি গ্যাস তৈরি করে বাংলাদেশে মানুষের জন্য সরবরাহ করতে চাওয়া হয়েছে। কয়লা রপ্তানির আগ্রহ দেখিয়ে বিষয়টি ভেবে দেখতে বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে টেকসই জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য ছাদে সৌরবিদ্যুৎ প্যানেল স্থাপন পদ্ধতির আধুনিকায়ন করতে চেয়েছে। ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের ইউনিট-১ ও ২ এর আধুনিকায়ন ও সংস্কারের জন্যও আগ্রহ দেখিয়েছে রাশিয়া। সূত্র জানায়, ২০২০ সালে করা সমঝোতা স্মারকের (এমওইউ) মাধ্যমে রাশিয়া বাংলাদেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সেটি আরও দীর্ঘায়িত করতে চেয়েছে দেশটি। বৈঠক সূত্র আরও জানায়, রাশিয়ার পক্ষ থেকে রুশিয়ান ইকোনমিক ইউনিয়নে বাংলাদেশ অন্তর্ভুতির বিষয়টি তুলে ধরা হয়। কিন্তু এতে বাধা দেয় বাংলাদেশ। বলা হয় এটি অনেক বড় ইস্যু। দীর্ঘদিন ধরে এ নিয়ে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আলাপ-আলোচনা চলছে। এটি নিয়ে শুধু একটি দেশের (রাশিয়া) সঙ্গে এমন ফোরামে আলোচনার বিষয় নয়। এছাড়া লেনদেনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে ‘কারেন্সি সোয়াপ’র বিষয় তুলে ধরে বাংলাদেশ। কিন্তু এতে তেমন আগ্রহ দেখায়নি রাশিয়া। বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-২ প্যাকেজে (তিনটি স্যাটেলাইট যুক্ত আছে) ৩৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার ঋণ চাওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে এ প্রকল্পে কী ধরনের যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম কেনা হবে সেটিও জানানো হয়েছে। এতে সহায়তা আশ্বাস দিয়েছে রাশিয়া। শিগগিরই চুক্তি হতে পারে। ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষে মোবাইল রোমিংয়ের খরচ কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয়। অর্থাৎ কোনো রাশিয়ান যদি বাংলাদেশে এসে তাদের দেশে কল করেন তাহলে খরচ হয় ৪৫০ টাকা। কিন্তু এই টাকার মধ্যে বাংলাদেশ পায় মাত্র ২০ টাকার মতো। বাকি টাকা পুরোটাই রাশিয়া নিয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে এই কলের খরচ কমানো এবং বাংলাদেশের প্রাপ্তির অংশ বৃদ্ধির বিষয়ে অনুরোধ জানানো হয়েছে। বিষয়টি ভেবে দেখবে বলে জানায় রাশিয়া। আইসিটি বিভাগ থেকে তথ্যপ্রযুক্তিতে ব্যাপক প্রশিক্ষণ এবং সাইবার নিরাপত্তায় সহায়তা চাওয়া হয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে কৃষি যান্ত্রীকীকরণ এবং কৃষিতে প্রযুক্তি হস্তান্তরসহ চলমান সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে প্রস্তাব দেওয়া হয় বলে জানা গেছে।