নৈরাজ্যের বাজারে স্বস্তিতে নেই ভোক্তা

প্রকাশিতঃ মার্চ ১৫, ২০২৩ | ৭:৩১ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ভোক্তা অধিকার থাকতে পারে, কয়েক বছর আগেও বিষয়টি তাদের জানা ছিল না। নৈরাজ্যের বাজারে তাদের অধিকার সংরক্ষণে আইন হলো। সেই আইনের আলোকে ২০০৯ সালে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরও হলো। মাঝখানে চলে গেছে ১৪ বছর। ভোক্তা কী পেল এই ১৪ বছরে? সেই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের দিকে নজর দেওয়া যাক। প্রাপ্ত তথ্য বলছে, ভোক্তার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গঠিত এই অধিদপ্তর কার্যত দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য কাজ করতে ব্যর্থ। ১০৮ জন কর্মকর্তা দিয়ে সমগ্র দেশে অভিযান পরিচালনা করার বাস্তবসম্মত কোনো সুযোগও নেই। এর মধ্যে ঢাকায় আড়াই কোটি মানুষের জন্য কর্মকর্তা রয়েছেন মাত্র পাঁচজন। সবার প্রশ্ন কীভাবে সম্ভব এই জলবল দিয়ে ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণ করা। আজ জাতীয় ভোক্তা অধিকার দিবস। দিবসটি সামনে রেখে ১৪ বছরের কর্মকাণ্ডের প্রতি নজর দিলে হতাশার চিত্রই দেখতে পাওয়া যায়। এই হতাশা থেকে মানুষকে রক্ষায় একটি নতুন খবর দিলেন ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি জানিয়েছেন, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় আইনটি অনুপযোগী। ফলে সময়োপযোগী করার প্রস্তাব করা হয়েছে সরকারের কাছে। কয়েকজন ভোক্তার বাস্তব অভিজ্ঞতা বিশ্লেষণ করলে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হবে। ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর আদৌ কতটুকু করতে পারছে; কিংবা কেন পারছে না। পণ্যের যথাযথ মূল্য নিশ্চিত করা, ভেজাল পণ্য প্রতিরোধ, ওজনে কারচুপি ঠেকানো এবং বাজার অব্যবস্থাপনা রোধের লক্ষ্য ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর হলেও এই প্রতিষ্ঠানের কাজে সুফল থেকে দেশের মানুষ বঞ্চিত। সম্প্রতি হাতিরঝিলের একটি কনফেকশনারি থেকে এক বোতল পানি কেনেন রাজধানীর মালিবাগের বাসিন্দা মো. সিয়াম। বোতলের গায়ে ১৫ টাকা মূল্য লেখা থাকলেও দোকানি ২০ টাকা রাখেন। এর কারণ জানতে চাইলে দোকানি বলেন-এই দামে এখানে সব স্যারেরা কিনে নেন। কখনো কিছু বলেন না। আপনি আবার আসলেন কোথা থেকে? তখন সিয়াম সাহেব জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ফোন করেন। তার পরিচয় দেন। বিস্তারিত বিষয়টি জানালে মহাপরিচালক তাকে অধিদপ্তরে এসে লিখিত অভিযোগ দিতে বলেন। তারপর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সায়েম সাহেব তার এনআইডি নম্বর, নিজের পেশাগত পরিচয় দিয়ে অভিযোগটি গ্রহণের অনুরোধ জানালেও ভোক্তার ডিজি পরে আর কোনো পদক্ষেপ নেননি। কাওরান বাজারে কথা হয় জহিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ঘরে থেকে বের হলেই পদে পদে প্রতারণার ফাঁদ। এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও ভেজাল মিলছে। চিকিৎসাসেবা পেতে নানা ধরনের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। এছাড়া লাগামহীনভাবে বাসা ভাড়া বৃদ্ধি, পরিবহণ খরচ, পানি-বিদ্যুৎ এবং গ্যাসের বাড়তি বিল গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে অসাধু ব্যবসায়ী চক্রের কারসাজিতে পণ্যের বাড়তি মূল্যে আমরা অসহায়। এসবই ঘটছে তদারকি সংস্থার চোখের সামনে। তবুও তারা নির্বিকার। এদিকে আসন্ন রোজাকে সামনে রেখে বাজারে সব ধরনের পণ্যের দাম লাগামহীনভাবে বেড়ে গেছে। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম কমলেও দেশের বাজারে কমেনি। উলটো এখন ডলারের দাম বৃদ্ধির অজুহাত দেখিয়ে পণ্যমূল্য বাড়ানো হচ্ছে। এর সঙ্গে ভেজাল পণ্য বিক্রি করা, ওজনে কম দেওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা ঘটছে। এমন পরিস্থিতি মোকাবিলা করে ভোক্তাকে জীবন ধারণ করতে হচ্ছে। ফলে কোথাও ভোক্তারা স্বস্তিতে নেই। অপর দিকে ভোক্তা প্রতারিত হলে ভোক্তা অধিদপ্তরে অভিযোগ দায়ের করার বিধান থাকলেও এ প্রক্রিয়াটিও জটিল। ভোক্তা হটলাইন করা হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। এছাড়া রয়েছে প্রভাবশালীদের চাপ। ফলে সংস্থাটি ভোক্তার পক্ষে জোরালো অবস্থান নিতে পারছে না। তারা শক্ত অবস্থানে গেলে ব্যবসায়ীরা ধর্মঘট ডেকে দোকানপাট বন্ধ করে দেন। তখন ভোক্তার ভোগান্তি আরও বাড়ে। এদিকে নানা সংকটে হাবুডুবু খাচ্ছে ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এর মধ্যে জনবল সংকট সবচেয়ে তীব্র। ভোক্তা অধিদপ্তরের ২৪০ জন জনবলের মধ্যে দেশের ১৭ কোটি ভোক্তার অধিকার রক্ষায় মাঠপর্যায়ে সরাসরি কাজ করছেন মাত্র ১০৮ জন কর্মকর্তা। এর মধ্যে রাজধানীতে প্রায় আড়াই কোটি মানুষের অধিকার রক্ষায় কাজ করছেন মাত্র ৫ জন কর্মকর্তা। ফলে তাদের দিয়ে ভোক্তার কী উপকার হচ্ছে সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। জানতে চাইলে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ভোক্তার অধিকার দেখার জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর করা হলেও আইনে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা করলে কঠোর শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। আইনে জরিমানার সঙ্গে জেলে দেওয়ার বিধান রাখা হলেও সংস্থাটি জরিমানা করেই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করছে। জেল দেওয়ার কোনো নজির নেই। পরিস্থিতি এমন-ভোক্তার অধিকার নিয়ে কানামাছি খেলা শুরু হয়েছে। অধিদপ্তরের অভিযানের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, ২০০৯ সালে ভোক্তা আইন হওয়ার পর ২০০৯-২০১০ অর্থবছর এবং ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মোট ৬২ হাজার ৯টি অভিযান পরিচালনা করে সংস্থাটি। এতে এক লাখ ৪৬ হাজার ৬৬০টি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে জরিমানা আদায় করে ১০২ কোটি ৯৫ লাখ ৭৫ হাজার ৭৪২ টাকা। পাশাপাশি প্রতারিত ভোক্তার অভিযোগের ভিত্তিতে ৮ হাজার ৩০২টি প্রতিষ্ঠানের কাছে ৫ কোটি ৮৫ লাখ ৮ হাজার ৮০৮ টাকা জরিমানা করা হয়। এই দুই খাতে মোট ১০৮ কোটি ৮০ লাখ ৮৪ হাজার ৫৫০ টাকা জরিমানা করা হয়। কিন্তু আইনে জরিমানার সঙ্গে জেলে পাঠানোর কথা থাকলেও নজির নেই। জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিভিন্ন বড় বড় কোম্পানিকে শাস্তির আওতায় আনা হচ্ছে, যা আগে হয়নি। এবার আমরা ভোক্তার অধিকার রক্ষায় সার্বিকভাবে মাঠে নেমেছি। সঙ্গে ভোক্তা আইন সংশোধন করা হচ্ছে। আইনটির খসরা করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। ভ্যাটিং হওয়ার পর সংসদে যাবে। আশা করি খুব শিগগিরই আইনটি পাশ হবে। তিনি জানান, এই আইনে ভোক্তার অধিকার রক্ষায় অনেক যুগোপযোগী হবে। এখানে অনেক নতুন বিষয় যুক্ত করা হয়েছে। অসাধুদের বিরুদ্ধে শাস্তির আওতা বাড়ানো হয়েছে। কর্মকর্তাদের ক্ষমতা বাড়ানো হয়েছে। একজন ভোক্তা শুধু বাজারে নয় অন্যান্য স্থান যেমন-বাড়ি ভাড়া, হজ ব্যবস্থাপনা, অনলাইনে কেনাকাটা করে প্রতারিত হলে প্রতিকার পাবে। এছাড়া ভোক্তা হটলাইনে এখন অভিযোগ করা না গেলেও ভবিষ্যতে এই ব্যবস্থা চালু করার প্রক্রিয়া চলমান আছে। যাতে ভোক্তা অভিযোগ দিলে সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। এছাড়া জনবল স্বল্পতা নিয়ে কাজ করছি। যে জনবল আছে তা নিয়ে কাজ করা সম্ভব না। কারণ কাজের পরিধি বেড়েছে। তাই আরও ৪৬৫ জন জনবল নিয়োগের জন্য আমাদের আবেদন বাণিজ্য মন্ত্রণালয় হয়ে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে যাচ্ছে। কারণ এই অধিদপ্তর ভোক্তার অধিকার রক্ষার জন্য সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ সেক্টর। তাই আশা করছি খুব শিগগিরই জনবল বাড়াবে। সূত্র জানায়, ভোক্তার অধিকার রক্ষায় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পাশাপাশি সরকারের আরও কয়েকটি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই), নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর, স্থানীয় প্রশাসনসহ সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। এসব সংস্থা তাদের নিজস্ব আইনে কার্যক্রম পরিচালনা করে। তবে সংস্থাগুলো বেশিরভাগ শহরকেন্দ্রিক কার্যক্রম চালাচ্ছে। গ্রামে যাচ্ছে কম। ফলে গ্রামে ভোক্তারা আরও বেশি ঠকছেন। এছাড়াও রয়েছে সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়হীনতা। ফলে ভোক্তারা এসব তদারকির কোনো সুফল পাচ্ছেন না।