জমি কেড়ে এমপি রানার চা বাগান

প্রকাশিতঃ মার্চ ১৮, ২০২৩ | ৫:১১ পূর্বাহ্ণ
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর একটা সময় চা বাগানের বড় কর্মকর্তা ছিলেন রানা মোহাম্মদ সোহেল। এখন তিনিই পঞ্চগড়ের বিশাল এক চা বাগানের মালিক। বাগানের আয়তন তাও প্রায় ১০০ একর। পঞ্চগড়ে গড়েছেন বিশাল সাম্রাজ্য। কোনো দিন জাতীয় পার্টি না করেই ‘টাকার জোরে’ বাগিয়ে নেন সংসদ নির্বাচনের মনোনয়ন। হয়ে যান নীলফামারী-৩ (জলঢাকা) আসনের এমপি। তবে এই আইনপ্রণেতার বিত্তশালী হওয়ার পেছনে আলাদিনের চেরাগের ছোঁয়া নেই! কখনও জবরদস্তি, কখনও আইনের ফাঁদ, মাঝেমধ্যে প্রভাব বিস্তার, আবার কোনো সময় দারিদ্র্যের সুযোগ নিয়ে বহু মানুষের জমি দখলে নিয়েছেন তিনি। তাঁর জমি দখলকাণ্ডে বহু মানুষ হারিয়েছেন ভিটা, হারিয়েছেন বসত। ফসলি জমির শেষ সম্বল হারিয়ে রিক্ত হন অনেক চাষি। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের মন্দিরের বিপুল জমি এবং দেবোত্তর সম্পত্তিও কবজায় নিয়েছেন তিনি। নানা কৌশলে জায়গা দখল করে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে ম্যানেজ করে মন্দিরে তালা দেওয়ারও নজির রয়েছে এমপি রানার। তাঁর এমন ভূমি দখলদারির শিকার হয়েছেন পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন, সদর উপজেলার হাঁড়িভাসা ইউনিয়ন এবং আটোয়ারীর আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের অনেক মানুষ। এসব ইউনিয়নের মানুষের জমির দলিল জাল করে এবং ভুয়া মালিক সাজিয়ে রেজিস্ট্রির মাধ্যমে তা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি। নানা ফন্দিতে দখল করা ওই জমিতে করেছেন চা বাগান। তিনি ‘অর্গানিক অরিজিন ফার্ম’ নামে একটি কোম্পানির জন্য এসব জমি কিনলেও তাঁর চা বাগানের কোনো নাম নেই। তিনি শ্রেষ্ঠ চা চাষি হিসেবে ২০১৮ সালে প্রধানমন্ত্রীর হাত থেকে পুরস্কারও নেন। তবে তাঁর পুরো চা বাগানই অবৈধ জমিতে দাঁড়িয়ে আছে বলে অভিযোগ রয়েছে। তাঁর সম্পদ, জাতীয় পার্টির নেতা না হয়েও টাকার জোরে এমপি হওয়া, দ্বৈত নাগরিকত্বের বিষয় গোপনসহ এমপি রানার বিষয়ে মিলেছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। তবে তিনি সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। অবিশ্বাস্য উত্থান : সোহেল রানা সেনাবাহিনীর মেজর পদের চাকরি ছাড়েন ১৯৯৬ সালের দিকে। এর পর চলে যান যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসে। পরে দেশে এসে ২০০৬ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত জেমকন গ্রুপে ব্যবসায়িক পরামর্শক পদে চাকরি নেন। জেমকনে চাকরি করার সময় তিনি পঞ্চগড়ে এই গ্রুপের কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট উন্নয়নে কাজ করেন। একই সময়ে নিজেও চা বাগান করার উদ্যোগ নেন। ২০১১ সালে সংশ্লিষ্ট পরিদপ্তর থেকে নিজের মালিকানায় ‘অর্গানিক অরিজিন ফার্ম লিমিটেড’ কোম্পানির নিবন্ধন নেন। তবে নিবন্ধনের পর থেকে আজ পর্যন্ত রিটার্ন কিংবা ট্যাক্স কিছুই জমা দেয়নি কোম্পানিটি। সাবেক চেয়ারম্যানের ২০ একর জমি দখল : তেঁতুলিয়ার বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান মো. কামরুজ্জামান ও তাঁর তিন ভাই এবং দুই বোনের ২০ একর কৃষিজমি দখল হয়ে যায় ২০১২ সালে। অভিযোগ রয়েছে, এমপি রানার লাঠিয়াল বাহিনী কাজী অ্যান্ড কাজী টি এস্টেট ও করতোয়া টি এস্টেটের নাম ভাঙিয়ে দখল করেন ওই জমি। পরে তৈরি করা হয় চা বাগান। তবে দখলের আগে জমি মালিকদের বিক্রির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল। মালিকরা রাজি না হওয়ায় স্থানীয় ১০ ব্যক্তিকে ভুয়া মালিক সাজিয়ে তিনটি জাল দলিল তৈরি করে তাঁদের কাছ থেকে জমি রেজিস্ট্রি করে নেওয়া হয়। ওই সময় প্রকৃত জমি মালিকদের বাড়িঘর ভেঙে, পিটিয়ে ভিটা ছাড়া করা হয়। এর পর একের পর এক মিথ্যা মামলা দেওয়ায় সে সময় থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন জমির মালিকরা। বেদখল হওয়া জমি ফিরে পেতে এক পর্যায়ে সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন মালিকরা। মামলার রায়ে জমির প্রকৃত মালিকদের দখল বুঝিয়ে দেওয়া হয়। পরে এমপি রানা ওই রায় চ্যালেঞ্জ করে জেলা জজ আদালতে আপিল করেন। রায়ে এমপি রানাকে ১৯.৩৭ একর জমি দেওয়া হয়। আর জমির প্রকৃত মালিকদের দেওয়া হয় ১.১৯ একর জমি। ওই রায়ের বিরুদ্ধে জমির প্রকৃত মালিকরা সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। এখন মামলাটি সর্বোচ্চ আদালতে বিচারাধীন। তবে জমির আশপাশেও যেতে পারছেন না মালিকরা। ভুক্তভোগী কামরুজ্জামান বলেন, ‘সাবেক চেয়ারম্যান হওয়ার পরও জালিয়াতি করে আমার জমি দখল করা হয়েছে। আমারই এ অবস্থা, পঞ্চগড়ের সাধারণ মানুষ কতটা অসহায়, তা আর বলার প্রয়োজন হয় না। অন্যায়ভাবে আমার এবং বহু নিরীহ মানুষের জমি দখল করেছেন রানা এমপি। তাঁরা আমার চা বাগান, কমলা বাগান, মার্কেট ধ্বংস করে দিয়েছে। আমি এখন নিঃস্ব, সুষ্ঠু বিচার চাই।’ দখল করা জমি ফেরত পেতে তিনি প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপও কামনা করেছেন। ৬০ বছরের মালিকানায় কোপ : এমপি রানার ইন্ধনে হাঁড়িভাসা ইউনিয়নের অরমখানা গের্দ্দ নালাগঞ্জে মসলেহার রহমান ফুলু ও তাঁর পরিবারের সদস্যের ১০.২৫ একর জমি কয়েক বছর আগে দখল করা হয়। এমপির লাঠিয়ালরা কয়েক দফা হামলা করে ওই জমি দখলে নেয়। এর আগে এমপি রানা ওই জমি কেনার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। তাতে রাজি না হলে জাল দলিল তৈরি করে তা দখল করে নেওয়া হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬২ সাল থেকে এ জমির খাজনা ও ভোগদখল করে আসছেন ফুলুর পরিবার। ২০১০ সালে রানার মদদে স্থানীয় লোকমান হোসেন এবং তাঁর সহযোগীরা ওই জমির জাল কাগজপত্র তৈরি করে যুগ্ম জেলা জজ আদালতে বাটোয়ারা মামলা করেন। তবে জালিয়াতির বিষয়টি জানাজানি হলে মামলা প্রত্যাহার করে নেন। দ্বিতীয় দফা নিখুঁতভাবে আবারও জাল কাগজ তৈরি করে মামলা করলেও আমলে নেননি আদালত। এর পর তৃতীয় দফা এসএ রেকর্ড পরিবর্তনের আবেদন করে হয়রানি করছে লোকমান গং। ভুক্তভোগীদের দাবি, এর পেছনে কলকাঠি নাড়ছেন এমপি রানা। মামলা চলমান অবস্থাতেই লোকমান হোসেনরা ভুয়া দাখিলা, ভুয়া মালিক ও ভুয়া খতিয়ান দেখিয়ে ২০১৩ সালে পুরো জমি বেচে দেন। এখন ওই জমির মালিক এমপি রানা ও তাঁর সহযোগীরা। ফুলু বলেন, ‘লোকমান হোসেন এবং তাঁর সহযোগীরা আমাদের জমি দখল করেছেন। তাঁদের প্রভাব ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে আমরা ভীতসন্ত্রস্ত। নিজের জমির দলিল থাকার পরও আমরা এখন জমির কাছে যেতে পারি না। আমরা সরকারের কাছে জমি দখলের বিচার চাই, আবাদি জমি ফেরত চাই।’ দেবোত্তর সম্পত্তিও লিজ : আটোয়ারির আলোয়াখোয়া ইউনিয়নের বালিয়া মৌজার ১২ একর দেবোত্তর সম্পত্তিও দখল করেছেন এমপি রানা। জমিদার শ্যামা প্রসাদ রায় আলোয়াখোয়া রাশ মন্দিরের জন্য ওই জমি দান করেছিলেন। ওই মন্দিরের সেবায়েত অনিল চন্দ্র রায় ও তাঁর ভাই সুনীল চন্দ্র রায় জমি দেখাশোনা করতেন। মন্দিরের জমি দখল করতে এই দুই ভাইকে ম্যানেজ করে ২০ বছরের জন্য ১২ একর জমি লিজ নেন এমপি রানা। পরে জমি ফেরত দেওয়ার দাবিতে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় পঞ্চগড় আদালতে মিসকেস মামলা করে। আদালত মন্দিরের কাছে জমি ফেরত দেওয়ার পক্ষে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, সেবায়েত শুধু মন্দিরের জমি রক্ষণাবেক্ষণের মালিক। এই জমি বিক্রি ও হস্তান্তরযোগ্য নয়। ২০১৩ সালে ওই জমিতে এমপি রানার লোকজন চায়ের চারা রোপণ করতে গেলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন বাধা দেন। বর্তমানে এমপির লোকজন সেই জমিতে অন্য ফসল আবাদ করছেন। স্থানীয়রা জানান, ৭-৮ বছর আগে এমপি রানা স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের ম্যানেজ করে ওই মন্দিরে তালা দেন। মন্দিরের ভেতরে প্রতিমাগুলো এখনও আছে। আলোয়াখোয়ার বিরেন চন্দ্র সিংহ বলেন, ‘মন্দিরের জমি মন্দিরের কাজে ব্যবহার হোক। পূজার জন্য মন্দির খুলে দেওয়া হোক। মন্দিরের তালা খোলার ব্যবস্থা করার দাবি জানিয়ে পঞ্চগড় জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদনও জানানো হয়েছে। তবে কোনো কাজ হয়নি। আমরা সাধারণ মানুষ, ভয়ে মন্দিরের কাছে যেতে পারি না। আমাদের ভয় দেখিয়ে বেআইনিভাবে মন্দিরের সম্পত্তি আত্মসাৎ করা হয়েছে।’ রানা যেভাবে এমপি : সোহেল রানার এমপি হওয়া নিয়েও আছে রহস্য। কখনও জাতীয় পার্টির নেতা ছিলেন না তিনি। গত সংসদ নির্বাচনে মোটা অঙ্কের টাকা দিয়ে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন কেনেন বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দলের একাধিক স্থানীয় নেতা জানিয়েছেন। অনেক বাসিন্দা বলেন, নির্বাচনী এলাকা নীলফামারীর জলঢাকায় তাঁর এক কাঠা জমি কিংবা ঘরবাড়িও নেই। তিনি মূলত পাশের উপজেলা কিশোরগঞ্জের বাসিন্দা। তবে থাকেন ঢাকার বারিধারার ডিওএইচএসে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এলাকার মানুষ তাঁকে কখনও কাছে পায় না। তাঁকে ফোনেও পাওয়া যায় না। কালে-ভদ্রে কখনও এলাকায় গেলে ওঠেন রেস্টহাউসে। স্থানীয়রা জানান, নির্বাচনী এলাকায় উন্নয়ন কার্যক্রম বলতে কিছুই নেই। সারাদেশের যে উন্নয়ন কার্যক্রম চলছে, তা থেকে জলঢাকার মানুষ পুরো বঞ্চিত। রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, দুস্থদের টিআর, কাবিখার কাজও চোখে পড়ে না। বিপুল সম্পদ, আয়কর নথিতে গরমিল : এমপি রানার ব্যক্তিগত ও কোম্পানির ট্যাক্স ফাইল পেয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে, ট্যাক্স না দেওয়ায় এনবিআর কোম্পানিকে দুই দফা নোটিশ করলেও তাদের পক্ষ থেকে কোনো জবাব দেওয়া হয়নি। তার ব্যক্তিগত ট্যাক্স ফাইলে চা বাগানের জমির পরিমাণ ১৯.৬৫ একর দেখানো হলেও ভূমি অফিসের তথ্যমতে, তা প্রায় ১০০ একর। রানার আরও বহু সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। পূর্বাচলে ১০ কাঠা প্লট, মিরপুর ডিওএইচএসে ৮ কাঠা, রংপুর পৌরসভার কেরানীপাড়ায় ৮ কাঠা, কুয়াকাটায় ২.১১ একর জমি, কক্সবাজার, টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিনে ৪.৬৩ একর জায়গা রয়েছে। এর বাইরেও একাধিক স্থানে তাঁর জায়গাসহ বিপুল সম্পদ রয়েছে বলে জানা গেছে। এমপি রানা তাঁর নির্বাচনী হলফনামায় কৃষি খাতের আয় ৫ লাখ টাকা উল্লেখ করেছেন। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর নথিতে তা দেখানো হয়নি। হলফনামায় স্থায়ী ঠিকানা হিসেবে জলঢাকার পশ্চিম বালাগ্রাম উল্লেখ করা হয়েছে। তবে ২০১৭-১৮ অর্থবছরের আয়কর নথিতে তার স্থায়ী ঠিকানা লেখা রংপুর সদর উপজেলার কেরানীপাড়া। সংসদ সদস্য হিসেবে রানা কূটনৈতিক পাসপোর্ট পেয়েছেন। এতে তার দ্বৈত নাগরিত্ব নেই বলে দাবি করা হয়েছে। তবে ‘ট্রুথফাইন্ডার’ রিপোর্টে যুক্তরাষ্ট্রের টেপাস ও মিশিগানে তার বাড়ি ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা পাওয়া গেছে। যা বললেন এমপি : এসব অভিযোগের বিষয়ে এমপি রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে অভিযোগগুলো অনেক দিন ধরেই আছে। গুজব বা মিথ্যা তথ্য দিয়ে আমাকে সহজে কাবু করা যাবে না।’ জালিয়াতি করে ভুয়া দলিল তৈরি ও ভুয়া মালিক সাজিয়ে জমি দখলের বিষয়গুলো তিনি এড়িয়ে যান। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় যা ঘটে তার কিছু বটে। আমার একটা চা বাগান আছে আলোয়াখোয়ায়। ১৪ বছর আগে বাগানটি করা হয়েছে। ১৪ বছর ধরে একটু একটু জমি কিনে বাগানটি করেছি। সেখানে জমি দখল করে রাখার কোনো সুযোগ নেই। কারণ আমি সেখানে বহিরাগত।’ রাশ মন্দিরের জমি বেআইনিভাবে লিজ নিয়েছেন কিনা– জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আচ্ছা, তথ্য অনেক জোগাড় করেছেন দেখতে পাচ্ছি।’ দেবোত্তর সম্পত্তি নিয়ে তাঁর জ্ঞান আছে উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি আইনের বাইরে কোনো কিছু করিনি।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, বিগত দিনে স্থানীয় লোকজন জমি দখলের অভিযোগে তাঁর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলন এবং গাড়ি ভাঙচুর করেছেন।