পণ্য সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকলেও রোজা ঘিরে দুই মাস আগেই দাম বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ ব্রয়লার মুরগির দাম নিয়ে কারসাজি হয়েছে। কেজিতে একশ টাকা দাম বাড়িয়ে কমানো হয়েছে ২০ টাকা। ফলে এখনও ক্রেতাকে ৮০ টাকা বেশি দিয়ে কিনতে হচ্ছে ব্রয়লার মুরগি। তদারকি সংস্থার কাছে অনিয়মের তথ্য এবং প্রমাণ থাকলেও অসাধুরা অধরা। ভোক্তার স্বার্থ রক্ষায় সরকারের বেশ কয়েকটি সংস্থা তাদের মতো করে অভিযান পরিচালনা করলেও কাজে আসছে না। সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা তাদের ছক অনুযায়ী ক্রেতা ঠকিয়েই যাচ্ছে। আর ভোক্তার পকেট কেটে লুটে নিচ্ছে টাকা। বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন-বাজার নিয়ন্ত্রণে ভোক্তার সঙ্গে প্রতারণা চলছে। সম্প্রতি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর খুচরা, পাইকারি, খামারি ও করপোরেট ব্যবস্থায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে। সভাশেষে ভোক্তা অধিদপ্তর জানায়, প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি উৎপাদনে করপোরেট ব্যবসায়ীদের ১৩৫-১৪০ টাকা খরচ হয়। আর খামারিদের খরচ হয় ১৫০-১৬০ টাকা। কিন্তু সেই মুরগি খুচরা বাজারে ২৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। করপোরেট ব্যবসায়ীরা এসএমএস’র মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। তারা যে দাম নির্ধারণ করে, রাজধানীসহ সারা দেশে ওই দামে বিক্রি হয়। এসব অভিযোগ করপোরেট ব্যবসায়ীরা স্বীকার করেন। এসব ঘটে অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামানের সামনে। তখন বাজার অস্থির করার পেছনে কারা দায়ী সেটা প্রমাণ হলেও তিনি কোনো পদক্ষেপ নেননি। বরং আলোচনা সভার সব চিত্র একটি প্রতিবেদন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে জমা দেন। পরে চলমান চাপের মুখে ভোক্তা অধিদপ্তর বৃহস্পতিবার চার করপোরেট প্রতিষ্ঠান-কাজী ফার্মস লিমিটেড, আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেড, সিপি বাংলাদেশ ও প্যারাগন পোলট্রি অ্যান্ড হ্যাচারি লিমিটেডকে অধিদপ্তরে তলব করে। সেখানে আলোচনা করে খামার পর্যায় থেকে সর্বোচ্চ ১৯৫ টাকায় বিক্রির আদেশ দেন। সেদিন থেকে খুচরা বাজারে প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগির দাম ২০ টাকা কমে ২৪০ টাকায় বিক্রি হয়। এতে দেখা গেছে, খুচরা পর্যায়ে কেজিতে ১০০ টাকা বাড়তি দরে বিক্রি হওয়া ব্রয়লার মুরগি ২০ টাকা কমে। সেক্ষেত্রে এখনও ভোক্তার ৮০ টাকা বাড়তি দরে কিনতে হচ্ছে। জানতে চাইলে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, বাজার মনিটরিংয়ে কোনো সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই। তাই সবাই যে যার মতো করে লোক দেখানো চেষ্টা করছে। এ সমন্বয়হীনতার ফলে বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোর মধ্যেই উলটো হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। যার নেতিবাচক প্রভাব বাজারে পড়ছে। ফলে ক্রেতার কোনো সুফল আসছে না। তিনি বলেন, ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা কমানো হয়েছে। কিন্তু ক্রেতার এখনো ২৪০ টাকার উপরেই কিনতে হচ্ছে। অনিয়মের কারণ সব জানা, তবুও অসাধুদের বিরুদ্ধে কোনো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নেই। বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, সরকারি তদারকি না থাকায় হরিলুট চলছে দেশের পোলট্রি খাতে। এই খাতের করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো গত ৫২ দিনে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। দেশে প্রতিদিন ব্রয়লার মুরগির চাহিদা তিন হাজার ৫০০ টন। এরমধ্যে প্রান্তিক খামারিদের ব্রয়লার মুরগির উৎপাদন খরচ এখন কেজিপ্রতি ১৬০-১৬৫ টাকা। আর করপোরেট প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন ব্যয় ১৩০-১৪০ টাকা। তবে পাইকারি পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২৩০ টাকা পর্যন্ত এসব মুরগি বিক্রি হয়েছে। তাতে কেজিপ্রতি অন্তত ৬০ টাকা বেশি মুনাফা করেছে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো। সংগঠনটি জানায়, করপোরেট প্রতিষ্ঠানের (তাদের চুক্তিভিত্তিক ফার্মসহ) মাধ্যমে প্রতিদিন দুই হাজার টন মুরগি বাজারে আসে। সেই হিসাবে দিনে তাদের অতিরিক্ত মুনাফা হয় ১২ কোটি টাকা। এভাবে ৩১ জানুয়ারি থেকে ২৩ মার্চ পর্যন্ত এই ৫২ দিনে মুরগি বিক্রি করে করপোরেট কোম্পানিগুলো লাভ করেছে ৬২৪ কোটি টাকা। আর ১ দিনের মুরগির বাচ্চা বিক্রি করে তাদের ৩১২ কোটি টাকা মুনাফা হয়েছে। সব মিলিয়ে মুরগি ও বাচ্চার দাম বাড়িয়ে ৯৩৬ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি। কিন্তু ব্যবসায়ীদের বেশি চাপাচাপি করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। আমরা তাদেরও সহযোগিতা করতে চাই। তবে অনিয়ম সামনে এলেই কঠোর ব্যবস্থা নেব। তিনি জানান, করপোরেট পর্যায়ে নির্ধারিত দামে মুরগি বিক্রি হচ্ছে। এ জন্য খুচরা পর্যায়ে দাম কিছুটা কমেছে। অভিযান পরিচালনা চলমান আছে। সামনে দাম আরও কমবে।