যত নামি বিশ্ববিদ্যালয় তত বেশি টিউশন ফি

প্রকাশিতঃ মার্চ ২৬, ২০২৩ | ৭:২৫ পূর্বাহ্ন
শিক্ষা বাতায়ন ডেক্স

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়ে উচ্চ দাম দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা। তুলনামূলক কম টিউশন ফির বিশ্ববিদ্যালয় থাকলেও নামি বিশ্ববিদ্যালয়ে টাকার অঙ্ক রীতিমতো বিস্ময়কর। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বিভিন্ন কোর্স ও প্রোগ্রামের ফি সংশ্লিষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একতরফা নির্ধারণ করছে। এ ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মতের কোনো জায়গা নেই। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন ২০১০-এ ভর্তি, টিউশন ও কোর্স ফি কীভাবে নির্ধারণ করা হবে– সে বিষয়ে কিছু বলা নেই। এ সুযোগে ইচ্ছামতো ফি নির্ধারণ করছে সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কত টাকা টিউশন ফি নিচ্ছে– এ ব্যাপারে সম্প্রতি তথ্য তালাশে নামে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এ প্রেক্ষাপটে দেশের ১০৮ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে চিঠিও দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দেওয়া তথ্যই বলছে, সবচেয়ে বেশি টিউশন ফি নিচ্ছে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের আর্কিটেকচার বিভাগ। সেখানে পাঁচ বছরে এক শিক্ষার্থীকে পড়তে গুনতে হয় ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫০ টাকা। আর সর্বনিম্ন ফি নেওয়া হয় উত্তরা ইউনিভার্সিটির বি.এড প্রোগ্রামে– ৪১ হাজার ৭০০ টাকা। অবশ্য পুন্ড্র ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি নামে অপর একটি প্রতিষ্ঠানে এই একই কোর্স ২০ হাজার টাকায়ও করা যায়, যদিও সেখানে শিক্ষার্থী খুবই কম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত ও সঠিক তথ্য দিয়েছে কিনা, তা নিয়ে সন্দিহান ইউজিসি। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শুধু সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামের ফির তথ্য দিয়েছে, তারা আলাদা করে আবার ভর্তি ফি নেয়। অনেক বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ আবার চতুরতার সঙ্গে প্রতি ক্রেডিট হিসেবে তথ্য দিয়েছে; ভর্তির টাকা ও উন্নয়ন ফি কত নেওয়া হয়, তা জানায়নি। এ ব্যাপারে ইউজিসির বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পরিচালক মো. ওমর ফারুখ বলেন, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুসারে, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে ইউজিসি টিউশন ফির বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে পরামর্শ দিতে পারে। এ জন্য আমরা তথ্যগুলো নিয়ে এখন বিশ্লেষণ করে দেখছি। গ্র্যাজুয়েশন করতে কোথায় কত ফি: ইউজিসির তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, গ্র্যাজুয়েশন পর্যায়ে বেসরকারি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি সর্বোচ্চ ফি নিচ্ছে বি ফার্ম প্রোগ্রামে– ১৩ লাখ ১৮ হাজার ৫০০ টাকা। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বনিম্ন ফি অর্থনীতিতে গ্র্যাজুয়েশনে ৮ লাখ ৫ হাজার টাকা। চট্টগ্রামের ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি, চিটাগাং (ইউএসটিসি) সর্বোচ্চ ফি নিচ্ছে বি ফার্ম প্রোগ্রামে ৫ লাখ ৪৬ হাজার টাকা, সর্বনিম্ন নিচ্ছে ইংরেজিতে অনার্স ১ লাখ ৫০০ টাকা। ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি নেয় ১১ লোখ ১০ হাজার টাকা; সবচেয়ে কম অর্থনীতিতে অনার্স ৮ লাখ ৪১ হাজার টাকা। সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে সর্বোচ্চ ফি বিএসসি ইন কম্পিউটার সায়েন্স ৫ লাখ ১৭ হাজার টাকা; কম লাগে বিএসএস ইন সোশ্যাল অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ পড়তে– ২ লাখ ৭১ হাজার টাকা। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বিজনেস এগ্রিকালচার অ্যান্ড টেকনোলজিতে (আইইউবিএটি) বেশি ফি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (সিএসসি)– ৫ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। আর কম নেওয়া হয় সমাজবিজ্ঞানে পড়তে– ২ লাখ ৯৮ হাজার টাকা। আন্তর্জাতিক ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয় চট্টগ্রামে বেশি ফি পুরকৌশলে স্নাতক হতে ৫৬ লাখ ৯১ হাজার ১৬০ টাকা, কম লাগে কোরানিক সায়েন্স অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিজে স্নাতক হতে ৭ লাখ ৪ হাজার ৫১৬ টাকা। আহ্ছানউল্লা ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজিতে সর্বোচ্চ ফি ৫ বছর মেয়াদি আর্কিটেকচারে– ১০ লাখ ৫০ হাজার ৫০০ টাকা। আর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বনিম্ন টাকা লাগে চার বছর মেয়াদি সিএসসি পড়তে– ৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫০০ টাকা। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ (এআইইউবি) বেশি নেয় ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিকস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে (ট্রিপল ই)– ৮ লাখ ৮৮ হাজার টাকা। কম নেয় সাংবাদিকতা পড়তে– ৭ লাখ ২০ হাজার টাকা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে সবচেয়ে বেশি ফি নেওয়া হয় ব্যাচেলর অব ফার্মাসি (বি ফার্ম) পড়তে– ৯ লাখ ৮১ হাজার ১২০ টাকা। আর সবচেয়ে কম ব্যাচেলর অব পিপিএইচএস ৪ লাখ ৩০ হাজার ৬২০ টাকা। ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিক সর্বোচ্চ ফি নেয় আর্কিটেকচারে ৮ লাখ ৭৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর সবচেয়ে কম ইংরেজিতে অনার্স পড়তে ৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা। গণবিশ্ববিদ্যালয়ে বি ফার্ম পড়তে লাগে ৫ লাখ টাকা। এটাই সর্বোচ্চ ফি। সবচেয়ে কম লাগে বাংলায় অনার্স পড়তে– ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। দ্য পিপলস ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ সর্বোচ্চ বিবিএতে ৩ লাখ ২৭ হাজার ৬০০ এবং সর্বনিম্ন ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতিতে অনার্স পড়তে ৬৮ হাজার ৪০ টাকা নিয়ে থাকে। এশিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ সিএসই পড়তে ৪ লাখ ২১ হাজার ৯০০ আর ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ১ লাখ ৪ হাজার ২০০ টাকা নেয়। ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি সবচেয়ে বেশি এলএলবি ৫ লাখ ৫৫ হাজার, সবচেয়ে কম সমাজবিজ্ঞানে অনার্স ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা নিয়ে থাকে। মানারাত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি ব্যাচেলর অব ফার্মাসিতে সবচেয়ে বেশি ৪ লাখ ৭৫ হাজার ১০০ এবং সবচেয়ে কম নেয় ইসলামিক স্টাডিজে অনার্স ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে আর্কিটেকচারে নেওয়া হয় সর্বোচ্চ ফি– ১৬ লাখ ৬৩ হাজার ৩৫০ টাকা। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বনিম্ন ফি ইংরেজিতে অনার্স ২ লাখ ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ সবচেয়ে বেশি ফি নেয় এগ্রিকালচারে পড়তে– ৭ লাখ ৭২ হাজার ২০০ টাকা। আর সবচেয়ে কম নেয় ইংরেজিতে অনার্স পড়তে, ৩ লাখ ৭৮ হাজার টাকা। সিলেটের লিডিং ইউনিভার্সিটি এগ্রিকালচারে ৬ লাখ ৪১ হাজার ৮৮০ টাকা এবং ইসলামিক স্টাডিজে ১ লাখ ৩০ হাজার ৪০০ টাকা নেয়। ১০৮টি বিশ্ববিদ্যালয়ের সবকটির তথ্যই কাছে রয়েছে। সেখানে দেখা গেছে, প্রায় সবকটিতেই উচ্চ হারে ফি নেওয়া হচ্ছে। স্নাতকোত্তর পর্যায়ে কারা কত নিচ্ছে: স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সর্বোচ্চ ফি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের এমপিএইচ প্রোগ্রামে। এক বছরেই নেওয়া হয় ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এই ফি বাংলাদেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে সবচেয়ে বেশি ফি এমবিএ প্রোগ্রামে। এক বছরেই নেওয়া হয় ৩ লাখ ৮০ হাজার টাকা। এমবিএ প্রোগ্রামে ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ নেয় ৩ লাখ ৮৭ হাজার টাকা। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি এমবিএ প্রোগ্রামে নিচ্ছে ৩ লাখ ৬৩ হাজার টাকা। আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এমবিএ প্রোগ্রামে নিচ্ছে ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি ইএমবিএ প্রোগ্রামে ৩ লাখ ৪ হাজার টাকা নেয়। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশন্যাল ইউনিভার্সিটি মাস্টার্স অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে ১ লাখ ২৩ হাজার ৬০০ টাকা নেয়। ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ এমবিএ প্রোগ্রামে নেয় ২ লাখ ৮৩ হাজার ৫০০ টাকা। শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজিতে এমবিএ ইন প্রোডাক্ট অ্যান্ড মার্চেন্ডাইজিংয়ে নেয় ২ লাখ ৯১ হাজার ২০০ টাকা। ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি এমবিএ (রেগুলার) প্রোগ্রামে নেয় ২ লাখ ১৪ হাজার ৪০০ টাকা। উত্তরা ইউনিভার্সিটি এমবিএতে নেয় ২ লাখ ১৯ হাজার ৭০০ টাকা। ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ প্রোগ্রামে ৩ লাখ ৪৫ হাজার টাকা লাগছে। ভারতের চেয়ে খরচ বেশি: পাশের দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গসহ বেশ কয়েকটি রাজ্যের প্রতিষ্ঠানে উচ্চশিক্ষার খরচ সম্পর্কে খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, বাংলাদেশেই উচ্চশিক্ষার খরচ বেশি। শিক্ষার মানেও ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ এগিয়ে। দেশটির আইআইটিএম, এডামাস, চণ্ডীগড়, ডিআইটি বিশ্ববিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষার খরচ বাংলাদেশের চেয়ে অনেক কম। সে দেশে জীবনযাপন এবং অন্য জিনিসের খরচও খুব একটা বেশি না। ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কোনো কোনো প্রোগ্রামে পড়াশোনার খরচ বাংলাদেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তিন গুণ কম। এ ছাড়া ভারতের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় চালু আছে মেধাবৃত্তি। বৃত্তি নিয়ে ভারতে বিনামূল্যে পড়াশোনাও করছেন বেশ কিছু বাংলাদেশি শিক্ষার্থী। ‘নিজের আয়ে চলে’: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতাদের সংগঠন বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি শেখ কবির হোসেন বলেন, এসব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে সরকার ন্যূনতম কোনো আর্থিক সহায়তা দেয় না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে সম্পূর্ণ নিজের আয়ে চলতে হয়। প্রতিষ্ঠানের জন্য জমি কেনা, ভবন নির্মাণ, যোগ্য শিক্ষক নিয়োগ ও তাঁদের বেতন-ভাতা, বিদ্যুৎ ও পানির বিল, বিভিন্ন ট্যাক্স থেকে শুরু করে পরিচালন ব্যয়ের সবটুকুই নিজস্ব আয় থেকে করতে হয়। আর শিক্ষার্থীদের দেওয়া ফি ছাড়া আয়ের দ্বিতীয় কোনো উৎস নেই। এ টাকায়ই বিশ্ববিদ্যালয় চলে।