ষাটের দশকের রাজনৈতিক অঙ্গনে অধিকারের ব্যাপারটা প্রধান ছিল। অর্থনৈতিকভাবে বঞ্চনা হোক, পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তুলনা হোক অথবা ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্ন কিংবা বামপন্থি চিন্তার দিক থেকে হোক, মূলে ছিল আদর্শিক চিন্তা ও ধ্যান-ধারণা। এখন আদর্শের চেয়ে অঙ্কের হিসাবের উন্নয়ন, অর্থাৎ একমুখী উন্নয়ন মুখ্য হয়ে গেছে। এক পন্থার উন্নয়ন আমাদের আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমরা নারী নির্যাতনের কথা বলছি ঠিক আছে, কিন্তু শ্রমিকের শোষণ, ন্যায়বিচারের কথা এখন আসে না। এখন মূল চিন্তা হলো– রিজার্ভ কত আছে, রেমিট্যান্স কত হচ্ছে, মাথাপিছু আয় কত হচ্ছে। বলা হচ্ছে মাথাপিছু আয় জনপ্রতি ২ হাজার ৮০০ ডলার। সহজ হিসাবের জন্য যদি ৩ হাজার ডলার ধরি, তাহলে চার সদস্যের পরিবারের গড় আয় ১২ হাজার ডলার। এই পরিমাণ আয়ের পরিবার দুরবিন দিয়ে খুঁজতে হবে। তবে হ্যাঁ, এক জায়গায় কোটি কোটি টাকা আয়ের লোক জমা হয়ে আছে। তারা ক্ষুদ্র একটি অংশ। মাথাপিছু আয়ের না পাওয়া অংশটা তারাই খেয়ে ফেলছে। এই অংশ জনগণের ৫ শতাংশের বেশি হবে না। উন্নয়ন হচ্ছে, তবে অধিকারের জায়গা গৌণ হয়ে গেছে। অধিকারহীনতা খুব প্রকট হয়ে যাচ্ছে। বিচারব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। আগের মামলা শেষ করার অনেক চেষ্টা হচ্ছে, তবে দুই বছর ধরেও এগোতে পারছে না। বড় দাগে বলি, ’৭০ সালে আমাদের চিন্তা ছিল– ভোট হবে, সংসদ হবে এবং এটি গণতন্ত্রের প্রথম ধাপ। ’৭০-এ আমরা প্রথম ভোট দিলাম, চিন্তা ছিল জনপ্রতিনিধিত্বমূলক প্রতিষ্ঠান হবে সংসদ। তারা জনগণের চিন্তা-ভাবনার প্রতিফলন হিসেবে আইন বানাবে। তবে শুধু সংসদ দিয়েই তো হবে না, অধিকার নিশ্চিত করার জন্য আরও কিছু শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান থাকতে হবে। প্রথমে বিচার বিভাগ, তারপর নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, আরও আনুষঙ্গিক হিসাবনিকাশ ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান ধীরে ধীরে হবে এবং প্রাতিষ্ঠানিক উৎকর্ষই জনগণের অধিকার নিশ্চিত করবে। অথচ গত ৫০ বছরে এই প্রতিষ্ঠানগুলোর একটিও শক্তিশালী হয়নি; বরং ক্রমাবনতি হয়েছে। পৃথিবীতে সংসদের আলোচনা ছাপা হয়। আমাদের গত ছয়-সাত বছরে সংসদের প্রসিডিউর ছাপা হয় না। সংসদের প্রসিডিউর ছাপা হয় না অথচ সেশন হচ্ছে। এ রকম ঘটনা একেবারে গরিব দু-একটা দেশে হতে পারে। আমি জানি না। কয়েক দিন ধরে সড়ক ও সেতু মন্ত্রণালয় নিয়ে আলোচনা হচ্ছে। পদ্মা সেতু, এমআরটি বিদেশিরা করছে। এগুলো সময়মতো ভালোভাবে হচ্ছে। তবে যেগুলো আমাদের মন্ত্রণালয় করছে, সেসব বছরের পর বছর চলে গেলেও সম্পন্ন হচ্ছে না। সংসদীয় কমিটির কাজ হলো– সচিব, চিফ ইঞ্জিনিয়ারকে ডেকে জিজ্ঞেস করা, চার বছরের কাজ ১২ বছরে হচ্ছে কেন? বাজেট ৪০০ কোটি টাকা থেকে ২ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এর জবাবদিহিতা কী? সংসদীয় কমিটি প্রায় নিশ্চুপ। ইংল্যান্ডে বিরোধীদলীয় এমপি সংসদীয় কমিটির চেয়ারপারসন হন। এতদূর যাওয়ার দরকার নেই, তবে কমিটির সভা তো হবে! সংসদের ৬০-৭০ শতাংশ এমপি হলেন ব্যবসায়ী। এমপিরা ব্যবসায়ী হলে তাঁদের বড় ব্যবসা সরকারের সঙ্গে হয়। এ জন্য সরকারি হর্তাকর্তাদের তাঁরা চটান না। সরকারের থেকে ব্যবসা হারানোর ভয়েই সংসদীয় কমিটি এত দুর্বল। দুনিয়ার কোথাও সংসদে এত ব্যবসায়ী নেই। মূল প্রতিষ্ঠান সংসদ; নির্বাচনের কথায় না-ইবা গেলাম। কীভাবে তাঁরা জনপ্রতিনিধি হন, সেদিকে না-ই গেলাম। সরকারের মন্ত্রিপরিষদ যা প্রস্তাবনা পাঠাচ্ছে, তা-ই সংসদে পাস হচ্ছে। বিচার বিভাগের অবস্থা আসলেই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমরা দেখেছি সরকারি দলের অধীনে নির্বাচনে কমিশন সরকারি দলকেই জিতিয়েছে। ন্যায্যতা, অর্থনৈতিক সুযোগ-সুবিধার সুষম বণ্টন তো নেই। রেহমান সোবহান বলেছেন, ষাটের দশকে যে কথা বলতে দ্বিধা করতেন না, এখন তা বলতে গিয়ে তাঁকে চিন্তা করতে হয়। আমরা কথা বলছি, পরের বাক্য কী বলব– এটা চিন্তা করে বক্তব্য নম্র-ভদ্র করতে আমরা এক্সপার্ট হয়ে গিয়েছি। বাকস্বাধীনতায় ক খ গ ঘ শিখিয়েছে– কোন বিষয়ে বলা যাবে, কতটুকু বলা যাবে। এভাবে চলতে থাকলে বাংলাদেশে যে স্বপ্ন ছিল– আমরা খেয়ে-পরে সুখে শান্তিতে থাকব, আমাদের ওপর নিপীড়ন-নিষ্পেষণ কম হবে; সেই ভবিষ্যৎ ক্রমে অনেক দূরে চলে যাবে।