ভয়াবহ আগুনে মঙ্গলবার একেবারে ভস্মীভূত হওয়ার পর ফের আলোচনায় এসেছে রাজধানীর ফুলবাড়িয়া-সংলগ্ন বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্স। ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ায় কাঠ-টিনের অবকাঠামোর মার্কেট ভেঙে বহুতল করার কার্যক্রম ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) নিলেও, তা আলোর মুখ দেখেনি। এ জন্য দোকান মালিক সমিতিকে দুষলেও তারা মাসের পর মাস ভাড়া ঠিকই নিয়েছে। তবে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, ব্যবসায়ীদের পুনর্বাসন ইস্যুর সমাধান ডিএসসিসি করতে না পারায় বিষয়টি থমকে যায়। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগে একাধিকবার বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এর পর অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধেই সিটি করপোরেশন সেখানে আধুনিক বহুতল মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয়। তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের সময় মার্কেটের নকশা ও অঙ্কন (ডিজাইন-ড্রইং) চূড়ান্ত করে নির্মাণকাজের দরপত্র পর্যন্ত পৌঁছেছিল। কিন্তু হঠাৎ বেঁকে বসেন বঙ্গবাজারের দোকান মালিক সমিতির নেতারা। তাঁরা দোকানিদের পুনর্বাসন ছাড়া নতুন মার্কেট নির্মাণে আপত্তি জানান। ইস্যুটির সুরাহা না হওয়ায় নেতারা আদালতের দ্বারস্থ হলে নিষেধাজ্ঞা আসে। ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ বলছে, সমিতির নেতারা বাধা না দিলে এমন দুর্ঘটনা এড়ানো যেত। এতদিন ওখানে নতুন মার্কেটে ব্যবসায়ীরা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারতেন। মঙ্গলবার আগুন লেগে কেবল বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের চারটি মার্কেট ভস্মীভূত হয়নি। আশপাশের আরও তিনটি মার্কেট পুড়ে গেছে। পুলিশ সদরদপ্তরের একটি বহুতল ভবনও লেলিহান শিখায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জানা গেছে, চার দশকের বেশি বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি সাধারণের কেনাকাটার জন্য জনপ্রিয়। প্রায় দুই বিঘা জমির ওপর কমপ্লেক্সে রয়েছে বঙ্গবাজার মার্কেট, গুলিস্তান মার্কেট, মহানগর মার্কেট ও আদর্শ মার্কেট। এখানকার রমরমা ব্যবসা দেখেই পাশে রেলওয়ের জায়গা লিজ নিয়ে গড়ে তোলা হয় ব্যক্তি উদ্যোগে এনেক্সকো টাওয়ার মার্কেট ও ইসলামিয়া মার্কেট। আগুনে ছয়টি মার্কেটই পুড়ে গেছে। এসব মার্কেটের মধ্যে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সটি ব্যবহারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ছিল। এ বিষয়ে ডিএসসিসির তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকন জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ও বারবার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে, সেখানে বহুতল আধুনিক মার্কেট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তিনি। আর্কিটেক্ট দিয়ে ডিজাইন ও ড্রইং করা হয়। মালিক সমিতির অনুরোধে ড্রইং-ডিজাইনে পরিবর্তন আনা হয়। ব্যবসায়ীদের স্বার্থ বিবেচনায় কয়েক ধাপে মার্কেট করার সিদ্ধান্ত হয়। একটি অংশের কাজ শেষ হলে ব্যবসায়ীরা শুরু করবেন ব্যবসা। পর্যায়ক্রমে এভাবেই কাজ করা হবে। এতে দোকান মালিকরা সম্মতি দিলে দরপত্রের প্রক্রিয়ায় যাওয়ার সময় তাঁর মেয়াদ শেষ হয়। তিনি বলেন, ‘নতুন মেয়র আসার পর কী হয়েছে, কেন এ প্রক্রিয়া আর এগোয়নি আমি জানি না। তবে সামনে জাতীয় নির্বাচন। মঙ্গলবার স্বপ্নের পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলার ঐতিহাসিক দিনে এমন অগ্নিকাণ্ড জনমনে সন্দেহের উদ্রেগ করে।’ ডিএসসিসি সূত্র জানায়, সাঈদ খোকনের পর মেয়র পদে আসেন ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস। তিনি আবারও নতুন করে মার্কেটটি নির্মাণের উদ্যোগ নেন। এ সময় বলা হয়, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের দোকান মালিকরাই নতুন মার্কেটের দোকান বরাদ্দ পাবেন। এরই মধ্যে ২০১৯ সালের ১০ এপ্রিল ‘মার্কেটটি ব্যবহারের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয় ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স। পাশাপাশি ডিএসসিসির পক্ষ থেকে দোকান মালিক সমিতিকে মার্কেট খালি করতে নোটিশ দেওয়া হয়। এরপরই ষড়যন্ত্রের গন্ধ খুঁজতে থাকেন দোকান মালিক সমিতির নেতারা। নতুন মার্কেট নির্মাণে বেঁকে বসেন তাঁরা। সাধারণ দোকানিদের বোঝাতে থাকেন– ২০ থেকে ৫০ লাখ টাকায় নেওয়া দোকান একবার ছেড়ে দিলে, পরে বহুতল মার্কেটে দোকান বরাদ্দ পাওয়া মুশকিল হবে। পেলেও অতিরিক্ত টাকা গুনতে হবে। ডিএসসিসির মালিকানাধীন বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সে ২ হাজার ৯৬১টি দোকান আছে। নতুন মার্কেট নির্মাণকালে তাঁরা কোথায় যাবেন, তার সুরাহা করতে পারেনি ডিএসসিসি। এক পর্যায়ে পুনর্বাসন ছাড়া যেন তাঁদের উচ্ছেদ করা না হয়, সেটিকে সামনে এনে রিট করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর অন্য কোথাও দোকান মালিকদের পুনর্বাসন করতে পারেনি ডিএসসিসি। ফলে নতুন মার্কেটের কাজও শুরু করা সম্ভব হয়নি। কিন্তু ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত ও আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও প্রতি মাসে দোকান মালিকদের কাছ থেকে সালামি (মাসিক ভাড়া) আদায় করে আসছে ডিএসসিসি। এখন অগ্নিকাণ্ডের পর কেউ দায় নিতে চাইছে না। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গতকাল ডিএসসিসির মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস সাংবাদিকদের বলেন, ‘২০১৯ সালে ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করে মার্কেটটি ব্যবহার না করতে নোটিশ দেওয়া হয়। একই সঙ্গে নতুন করে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স তৈরির কাজ শুরু করতে চাই। কিন্তু মার্কেটের দোকান মালিকরা হাইকোর্টে রিট করেন। আদালত মার্কেটের ওপর স্থগিতাদেশ দেন। এরপর আর মার্কেট নির্মাণ সম্ভব হয়নি। আদালতের কারণে ঝুঁকিপূর্ণ মার্কেটটি ভেঙে ফেলা এমনকি জোর করে ব্যবসায়ীদের সরিয়ে দিতে পারিনি।’ বঙ্গবাজার মার্কেট কমপ্লেক্সের সভাপতি কিশোরগঞ্জ-৫ আসনের সরকারদলীয় এমপি আফজাল হোসেনের নম্বরে কল দিলে বন্ধ পাওয়া যায়। সাধারণ সম্পাদক জহিরুল ইসলামকে বারবার কল দিলেও রিসিভ করেননি। তবে আগুনে পুড়ে যাওয়া মহানগর শপিং কমপ্লেক্সের চেয়ারম্যান আবদুর রহমান বলেন, ‘পুনর্বাসন ছাড়া মার্কেট করতে পারবে না– এমন দাবিতেই দোকান মালিকরা আদালতে গিয়েছিলেন। এটি না হলে মার্কেট এত দিনে হয়ে যেত। এমন ক্ষতি হয়তো দেখতে হতো না।’ এদিকে, বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ভবন তিনতলা হলেও রাজউকের কোনো অনুমোদন ছিল না বলে জানা গেছে। এখানে কীভাবে এত দিন ব্যবসা-বাণিজ্য চলে আসছে, তা নিয়েও প্রতিষ্ঠানটির কোনো মাথাব্যথা ছিল না। এ প্রসঙ্গে রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) তন্ময় দাস বলেন, ‘রাজউক সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত ভবনের কার্যক্রম মনিটর করে না। সেগুলো দেখভালের দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট সংস্থার। রাজউক শুধু ব্যক্তি মালিকানাধীন বা কোনো বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন ভবন-মার্কেটের কার্যক্রম তদারকি করে। বঙ্গবাজার কমপ্লেক্স ডিএসসিসির মালিকানাধীন, সেখানে রাজউকের কিছুই করার নেই। আর বঙ্গবাজার কোনো ইমারত ছিল না। সেটি কাঠ-টিনের অবকাঠামো ছিল।’