‘তখনও আমার ছয়টি দোকানে আগুন লাগেনি। দোকানে ক্যাশ (নগদ) ছিল ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। চায়া চায়া দেখলাম, সব পুইড়া ছাই।’ বলছিলেন পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজারের সাতটি দোকানের মালিক লিটন মাঝি। দোকানের সব চাবি ছিল দুই কর্মচারীর কাছে। তাদের একজন থাকে যাত্রাবাড়ী, আরেকজন কামরাঙ্গীরচর। তারা রিকশায় আসতে আসতে মার্কেটের আগুন দোকানে এসে লাগে। জানালেন, ‘দুই কোটি টাকার মাল ছিল। মার্কেটের বিভিন্ন দোকানে কোটি টাকার বাকি পাওনার কাগজ ছিল। টাকা শেষ, কাগজপত্রও সব পুড়ে গেছে। যাদের কাছে বাকির টাকা ছিল, তাদের দোকানও পুড়ে ছাই, সবাই আমরা নিঃস্ব। ৬ থেকে ৭ কোটি টাকা ক্ষতি হয়ে গেল!’ লিটন মাঝি যখন মার্কেটের কাছে আসেন, তখনও বঙ্গবাজার মহানগর কমপ্লেক্সে আগুন লাগেনি। পাশের আদর্শ কমপ্লেক্সে সবেমাত্র আগুন ধরেছে। ওদিকে তখন মহানগর কমপ্লেক্সের অনেক দোকানের মালিকরা ক্যাশের টাকা, হিসাবপত্রসহ মালপত্র সরাচ্ছেন। কিন্তু তিনি উপস্থিত থেকেও কিছুই করতে পারলেন না। লিটন মাঝির দাবি, ঈদ উপলক্ষে সোয়া ২ কোটি টাকার মালপত্র তুলেছিলেন। নগদ ছিল ৮ থেকে ১০ লাখ টাকা। মঙ্গলবার দুপুরে বঙ্গবাজার কমপ্লেক্সের সামনে আহাজারি করে এসব কথা বলছিলেন তিনি। লিটন মাঝি বলেন, সাড়ে ৬টার দিকে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ির শব্দ শুনে পাশের রোজ প্লাজার কারখানা থেকে নিচে নেমে এসে আগুনের খবর জানতে পারি। যখন এ মার্কেটের সামনে আসি তখনও চাবি থাকলে কিছু করতে পারতাম। কর্মচারীরা আসার পরে ভেতরে গিয়ে ক্যাশবাক্স ও কাগজপত্র আনতে চাইলেও, নিরাপত্তার স্বার্থে তিনি যেতে দেননি। তিনি বলে চলেন, ঈদ উপলক্ষে বাসায় থাকা হতো না। দিনের বেলা দোকানে আর রাতের বেলা কারখানায় ঘুমাতাম। এখন তো সব শেষ হয়ে গেল। ‘চোখের পাতা ফেলার আগেই যে দোকান থেকে ফায়ার সার্ভিসের সদরদপ্তর দেখা যেত, তারা কিছুই করতে পারল না!’ এই আক্ষেপ ছিল তাঁর কণ্ঠে। লিটন বলেন, ফায়ার সার্ভিসে খবর দেওয়ার অনেক পরে তারা আসে। আসার পরেই জানাল পানি নেই। তখন তারা ফায়ার এক্সটিংগুইশার দিয়ে গ্যাস মেরে আগুন নেভানোর চেষ্টা করে। অন্য ইউনিটগুলো যখন আসে, তখন তারা পুলিশ সদরদপ্তর বাঁচাতেই বেশি ব্যস্ত ছিল। শুরু থেকেই তারা গুরুত্ব দিলে দোকানিদের এত বড় ক্ষতি হতো না– এই ছিল তাঁর অভিযোগ। বঙ্গবাজারের সামনেই বিলাপ করছিলেন আল মোক্তার গার্মেন্টের মালিক মোহাম্মদ আহাদ। মার্কেটে চারটি দোকান আর তিনটি গোডাউন ছিল তাঁদের। একটি দোকানে নিজে বসতেন, বাকিগুলো বাবা-চাচারা দেখাশোনা করতেন। দোকান ও গোডাউন মিলে তাঁদের ৭-৮ কোটি টাকার মালপত্র ছিল। ঈদ উপলক্ষেই আনা হয়েছিল বেশিরভাগ পোশাক। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দোকানে থাকা ক্যাশবক্স বাঁচাতে চেয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও সম্ভব হয়নি। সারা বছর এই একটা মাসের অপেক্ষা মোহাম্মদ আহাদের কথা : আমার বাড়ি বঙ্গবাজার মার্কেটের পাশেই। আগুন লাগার খবর শুইনাই মার্কেটে আসি। তখনও আমার এক দোকানে পুরোপুরি আগুন লাগে নাই। আমি দৌড় দিয়া দোকানে যাই ক্যাশ বাক্স আনার জন্য। ক্যাশে আমার ১৭-১৮ লাখ টাকা ছিল। কিন্তু ততক্ষণে আগুন ধইরা যায়। দোকানের কাছে যাইতেই উপরের তলার একটা এসি বিস্ফোরণ হয়। আমার হাতে-পিঠে আগুনের ছ্যাঁকা লাগে। পুড়ে যায়। তাও আমি যাব ভিতরে; কিন্তু দোকানদার এক চাচা আমারে টাইনা বাইরে নিয়া আসে। তাঁর কথা, ‘সারা বছর আমরা এই একটা মাসের জন্য অপেক্ষায় থাকি। করোনায় যে ক্ষতি হয়েছিল তা পূরণের অপেক্ষায় ছিলাম। এখন আর কিছু নাই।’ ছেলেমেয়ে নিয়া কোথায় যাব আমি আহাদের পাশেই কামরুল ইসলাম নামে এক দোকানি মোবাইল ফোনে আরেকজনকে বলছিলেন, ‘ভাই দোয়া করেন, সব শেষ আমার।’ পরে এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘ছোট্ট ব্যবসা, দোকানে ১৫ লাখ টাকার মাল ছিল। আর গতকাল রাতে বেচাকেনা শেষে ১ লাখ ৮৫ হাজার টাকা রাইখা গেছিলাম। আগামাসিহ লেনের বাসা থিকা আইসাই দেখি সব পুইড়া ছাই। আগের রাতে ক্যাশবাক্সের টাকাটা যদি সঙ্গে নিয়া যাইতাম, তাও তো কিছু থাকত। সব কিছু শেষ হইয়া গেল আমার।’ তিন বছর গেল করোনায়, এবার গেল পুরোটাই ‘দুই ছেলে আর দুই মেয়ে নিয়ে কোথায় যাব আমি। সবার পড়াশোনা আর সংসার চলত ব্যবসার টাকায়।’ এই আহাজারি নাইম এন্টারপ্রাইজের আজাদ হোসেনের। তিনি জানান, দোকানে ঈদের মাল ছাড়াও অন্যান্য দোকানে বাকি ছিল ৫০ লাখ টাকা। শীতের মৌসুমে তাঁরা বাকি নিয়েছিলেন, ঈদের ব্যবসা থেকে শোধ করা কথা। বলছিলেন তিনি, ‘তাদেরও তো কিছু থাকল না, আমাকে দিব কী। পথে বসে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।’ জান্নাত গার্মেন্টসের কাওসার বলেন, ঈদ উপলক্ষে তিন হাজার পিস প্যান্ট কিনেছিলাম। ব্র্যাক ব্যাংক থেকে ১৫ লাখ টাকা আর মঙ্গল সমিতি থেকে ৫ লাখ টাকার ঋণ ছিল। ঈদের পরে একেবারেই শোধ করে দিতাম সব ঋণ। কিন্তু তা আর হলো না। কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে তিনি বলে যান, ‘তিন দিন আগে জন্মানো মেয়ে ইকরাকে দেখতে লক্ষ্মীপুরে গিয়েছিলাম। সেখান থেকে আর দোকানে আসা হলো না। বিদেশ থেকে এসে ব্যবসা শুরু করলাম। তিন বছর গেল করোনায়, এইবার গেল পুরোটাই।’