চলতি শিক্ষাবর্ষে নতুন চালু করা শিক্ষাক্রমের জন্য লেখা নতুন পাঠ্যবই প্রণয়নে প্রস্তুতির যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। অনেকটা তড়িঘড়ি করে বই প্রকাশ করা হয়েছে। এই অভিমত সরকারের গঠন করা বিশেষজ্ঞ কমিটির। কমিটির রিভিউ কার্যক্রমে ধরা পড়েছে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ শ্রেণির নতুন পাঠ্যবইয়ে বিভিন্ন অধ্যায়ে বানান ভুল, ছবি নির্বাচন ও উপস্থাপনে ত্রুটি, ইংরেজি বইয়ে বাংলা অনুবাদ, সর্বনাম ব্যবহারে ভুল, পৃষ্ঠা সংখ্যা অতিরিক্ত করে বইয়ের ভার অকারণে বাড়ানোসহ বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। এসব ভুল-ত্রুটি সংশোধনের জন্য ৩০টি সুপারিশ করা হয়েছে। গত ২৭ মার্চ এ কমিটির প্রতিবেদন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে জমা দেওয়া হয়েছে। এই বিশেষজ্ঞ ও মূল্যায়ন কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইআর) পরিচালক অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম এবং সদস্য সচিব মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) উপপরিচালক মো. আজিজ উদ্দিন। আট সদস্যবিশিষ্ট এই কমিটির বাকি সদস্যরা হলেন– শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. ওয়াহিদুজ্জামান চাঁন, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) লুৎফর রহমান, কারিগরি মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের একজন উপসচিব, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের একজন পরিচালক ও মতিঝিল সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমুন নাহার শাহীন। এ কমিটিকে পাঠ্যবইয়ে ভুল, বিতর্ক– সবকিছু পর্যালোচনা করার দায়িত্ব দিয়েছিল শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কাজ শেষে জমা দেওয়া প্রতিবেদনে মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির নতুন পাঠ্যবই তড়িঘড়ি করে প্রণয়ন করা ছাড়াও লেখক, জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড (এনসিটিবি) এবং প্রেসের সমন্বয়হীতার কারণে নানা ধরনের ভুল চিহ্নিত করেছে এ কমিটি। ভবিষ্যতে যাতে এ তিন স্তরে সঠিকভাবে সমন্বয় করা হয়, সে জন্য সুপারিশও করেছে। ষষ্ঠ শ্রেণির বই থেকে মানব বিবর্তনবাদ অধ্যায় বাতিল করাসহ কয়েকটি অধ্যায়ে থাকা বেশ কিছু অসংগতি বাদ দিতে বলা হয়েছে। রিভিউ কাজে দেখা গেছে, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইয়ের অনেক স্থানে বানান ভুল পাওয়া গেছে। সর্বনাম ব্যবহারে ভুল হয়েছে। ইংরেজি বইয়ের মধ্যে বাংলা অনুবাদ দেওয়া হয়েছে। এর কারণে ইংরেজি শেখা থেকে পিছিয়ে পড়তে পারে শিক্ষার্থীরা। যেসব বিষয় নিয়ে অসংগতি, আলোচনা ও সমালোচনা রয়েছে সেগুলো পরিবর্তন করাসহ মোট ৩০টি সুপারিশ করেছে কমিটি। এসব সুপারিশের ভিত্তিতে গত ২৭ থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত বিশেষজ্ঞদের নিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী কর্মশালা করে ভুলগুলো সংশোধন করা হয়েছে। কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক ড. আব্দুল হালিম জানান, মাধ্যমিকের ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুশীলন, ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান অনুসন্ধান এবং অনুশীলনসহ মোট চারটি বই তাঁদের মূল্যায়ন করতে বলা হয়েছিল। এ চারটি বই নিয়েই মূলত তাঁরা কাজ করেছেন। কিছু অধ্যায় আগের মতো রাখা হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীর অ্যাকটিভিটিস রাখা হয়নি, সেগুলো চিহ্নিত করে সংশোধন করতে সুপারিশ করা হয়েছে। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বিজ্ঞান বইয়ে ভালো উপস্থাপন করা হলেও অনুশীলন বইটিকে মূল রেখে অন্যটিকে রেফারেন্স হিসেবে রাখতে বলা হয়েছে। এর বাইরেও বির্বতনবাদ অধ্যায় বাদ দেওয়াসহ নানা সুপারিশ করা হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রিভিউ কমিটির একজন সদস্য বলেন, আরও চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা করে ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বইগুলো তৈরি করলে ভালো এবং উপযোগী হতো। বর্তমানে এগুলো রিভিউ করা হয়েছে। এনসিটিবি কী পরিবর্তন করে, আমরা সে অপেক্ষা করছি। এই সদস্য বলেন, ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির বয়সের সঙ্গে সমন্বয় করে কাভার পেজ নির্ধারণ করা হয়নি। ১১-১২ বছরের শিক্ষার্থীদের বই প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষার্থীদের মতো করা হয়েছে। এতে বিষয়বস্তু সঠিকভাবে নির্বাচন করা হয়নি। ষষ্ঠ-সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা যেসব বিষয় পড়তে পছন্দ করে, সে ধরনের বিষয় যদি নির্বাচন করা হতো– তবে তাদের কাছে বইগুলো বেশি উপভোগ্য হতো। এদিকে, নতুন শিক্ষাক্রমে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ওই দুটি বইয়ের নাম একই। এনসিটিবি জানিয়েছিল, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস এবং সামাজিক বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুশীলনী পাঠ’ এবং ষষ্ঠ শ্রেণির বিজ্ঞান বিষয়ের ‘অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়েরও কিছু অধ্যায় সংশোধন করা হবে। তিনটি বইয়ের সংশোধনী ‘শিগগির’ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে জানানো হবে। কিন্তু মার্চ শেষ হলেও সংশোধনী দিতে পারেনি এনসিটিবি। এ বিষয়ে এনসিটিবির সদস্য (পাঠ্যক্রম) অধ্যাপক মশিউজ্জামান বলেন, বর্তমানে সব সংশোধন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মাধ্যমে দেশের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর প্রধান শিক্ষকদের কাছে পাঠানো হচ্ছে। রোজার মধ্যে এসব পাঠিয়ে দেওয়া হবে। ঈদের ছুটির পর যখন স্কুল খুলবে, তখন ক্লাস শিক্ষকরা একসঙ্গে শিক্ষার্থীদের বইয়ের মধ্যে সবকিছু সংশোধন করে দেবেন।