বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন খুব শিগগির সংশোধন হচ্ছে না। তবে এটি নিয়ে গভীর পর্যালোচনা করছে সরকার। যথাযথ সময়ে এটি সংস্কার বা সংশোধন করা হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে আভাস পাওয়া গেছে। সূত্রমতে, গত জুনে জাতিসংঘ মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের দপ্তর থেকে পাঠানো সুপারিশ গভীরভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে। অংশীজন, মানবাধিকার কর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের মতামত নিচ্ছে সরকার। গত ১৪ মার্চ এ বিষয়ে উচ্চ পর্যায়ের একটি বৈঠক হয়। চলতি মাসেই দ্বিতীয় বৈঠক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জাতিসংঘের সুপারিশ গভীরভাবে পর্যালোচনা করার পর সরকার এ আইনটি সংশোধনের প্রক্রিয়া শুরু করবে। আগামী নির্বাচনের আগে এটি সংশোধনের সুযোগ কম বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে। ২০১৮ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি জাতীয় সংসদে পাস হয়। আইনটি পাসের আগেও সম্পাদক পরিষদ কিছু ধারা সংশোধনের সুপারিশ করেছিল। সেটি আমলে নেওয়া হয়নি। গত সাড়ে চার বছর ধরে সাংবাদিক সমাজ, মানবাধিকার কর্মী, সম্পাদক পরিষদ, পেশাজীবীসহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে এ আইনটি বাতিল বা সংশোধনের দাবি তোলা হচ্ছে। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বলছেন, আইনটি বাতিল করা হবে না; কিছু ধারা সংশোধন করা হবে। বেসরকারি সংস্থাগুলোর হিসাবে, সাড়ে চার বছরে আড়াই হাজারের বেশি মানুষের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে। সম্প্রতি প্রথম আলোর সম্পাদক ও সাংবাদিকের বিরুদ্ধে মামলা ও নওগাঁয় ইউনিয়ন ভূমি অফিসের এক নারী কর্মচারীকে গ্রেপ্তারের পর র্যাব হেফাজতে মৃত্যু এবং তাঁর বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা হওয়ার পর ফের বিতর্ক শুরু হয় এই আইনটি নিয়ে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৩১ মার্চ জাতিসংঘের মানবাধিকার হাইকমিশনার আইনটি অবিলম্বে স্থগিত করা ও সেটিকে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে প্রয়োজনীয় সংশোধনী আনার সুপারিশ করেন। জাতিসংঘের দপ্তর থেকে গত জুন মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি ধারা (২১ ও ২৮) বাতিল এবং আটটি সংশোধনের সুপারিশ করা হয়। এসব ধারার বেশিরভাগ বাকস্বাধীনতা ও সাংবাদিকতার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এবং আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে এতে উল্লেখ করা হয়। প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক জানান, ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বিভিন্ন মহল থেকে বাতিলের দাবি তোলা হলেও এটির যথেষ্ট প্রয়োজন রয়েছে। আইনটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এর পর সংশোধন করা হবে। অপব্যবহার ও মামলার পরপরই যেন গ্রেপ্তার করা না হয়, সে ব্যাপারটা আমরা সংশ্লিষ্ট বিভাগকে বলেছি।’ তিনি বলেন, ‘এ ব্যাপারে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলোচনা চলছে। আমরা ইতোমধ্যে নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের বক্তব্য শুনেছি। আগামী বৈঠকে এ নিয়ে আরও আলোচনা হবে। এর পর প্রয়েজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে।’ আইনটি সংশোধনে মতামত গ্রহণের জন্য গত ১৪ মার্চ সচিবালয়ে আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে বসেন অংশীজন। অংশ নেন তথ্য ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান, লেজিসলেটিভ সচিব মইনুল কবির, আইন সচিব গোলাম সারওয়ার, আইসিটি বিভাগের সচিব মো. সামসুল আরেফিন, ঢাবির অধ্যাপক ড. সি আর আবরার, ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া প্রমুখ। ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি অবশ্যই জনস্বার্থবিরোধী। এটি অবিলম্বে বাতিল চাই। এটি সংবিধান পরিপন্থি ও বাকস্বাধীনতাকে হরণ করছে। সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এই আইনটি ক্ষমতাসীনরা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। সরকারের সমালোচনাকারীরা যাতে কোনো কিছু প্রকাশ করতে না পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তার নামে নিরাপত্তাহীনতা সৃষ্টি করা হয়েছে। বিশেষ করে গণমাধ্যমকর্মী ও স্বাধীন মত প্রকাশকারীদের ওপর এই আইনটি ব্যবহার হচ্ছে। এতে করে নাগরিক অধিকার ক্ষুণ্ন হচ্ছে। ওই বৈঠকে উপস্থিত নাম না প্রকাশের শর্তে দু’জন জানান, খুব শিগগির এ আইন সংশোধন হচ্ছে না। সামনে আন্দোলন হতে পারে। এর পর জাতীয় নির্বাচন। এর মধ্যে এটি সংশোধনের সুযোগ কম। সুপারিশ : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২১ ও ২৮ ধারা বাতিলের সুপারিশ করেছেন জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনার। আইনটির ২১ ধারায় বলা হয়েছে, ‘কোনো ব্যক্তি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, জাতির পিতা, জাতীয় সংগীত বা জাতীয় পতাকার বিরুদ্ধে কোনো প্রকার প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালান বা এতে মদদ প্রদান করেন’ তাহলে তিনি অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে যাবজ্জীবন বা তিন কোটি টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৮ ধারায় বলা হয়, যদি কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী ইচ্ছাকৃতভাবে বা জ্ঞাতসারে ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত করার বা উস্কানি প্রদানের অভিপ্রায়ে ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা প্রচার করেন বা করান, যা ধর্মীয় অনুভূতি বা ধর্মীয় মূল্যবোধের ওপর আঘাত করে, তাহলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে সাজা হবে অনধিক ১০ বছর কারাদণ্ড বা ২০ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ড। তবে আইনমন্ত্রী বলেছেন, এ দুটি ধারা বাতিল নয়, সংশোধন করা হতে পারে। আইনটির আরও আটটি ধারা সংশোধনের সুপারিশ করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশন। এগুলো হলো– ৮, ২৫, ২৭, ২৯, ৩১, ৩২, ৪৩ ও ৫৩।