রাজধানীর মোহাম্মদপুরের টাউন হল এলাকা। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টা। খাঁ খাঁ রোদে খোলাবাজারে পণ্য বিক্রির (ওএমএস) ট্রাকের সামনে চালের জন্য কয়েকশ মানুষের দীর্ঘ অপেক্ষা। ৩০ টাকা কেজি দরে জনপ্রতি ৫ কেজি চাল বিক্রির কথা থাকলেও এখানকার ছবি ভিন্ন। ৩০ কেজি ওজনের এক বস্তা চাল এক ব্যক্তির কাছে বেচে দিলেন ওএমএসের ট্রাক সেল কার্যক্রমের কর্মী। বাড়তি টাকার বিনিময়ে ১০-৩০ কেজি চাল অনেককে দিতে দেখা যায়। একই পরিস্থিতি দেখা গেছে রাজধানীর আরও বেশ কয়েকটি পয়েন্টে। শুধু ওএমএস নয়, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) পণ্য বিক্রিতেও চলছে এমন রকমারি ঘাপলা। দুটি পণ্য বিক্রিতেই ক্ষমতা দেখাচ্ছেন সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরসহ প্রভাবশালীরা। কার্ড বিতরণে অনিয়ম, এক স্থান থেকে পণ্যের ট্রাক আরেক স্থানে নিয়ে যাওয়া, নির্দিষ্ট সময়ে পণ্য বিক্রি না করা, পণ্য গায়েব করে দেওয়া, কালোবাজারে বিক্রিসহ নানা অভিযোগ দীর্ঘদিনের। তবে সরকারের কঠোর বার্তা, গ্রেপ্তার, তদন্ত কমিটিসহ নানা শাস্তিমূলক ব্যবস্থায়ও বন্ধ হয়নি অনিয়ম। ফলে নিম্ন আয়ের মানুষের অনেকেই সরকারের এ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। কার্ড করেও ঠেকানো যায়নি টিসিবির পণ্য বিতরণে অনিয়ম: টিসিবির মাধ্যমে নিম্ন আয়ের এক কোটি পরিবারকে সাশ্রয়ী দামে তেল, চিনি, ডালসহ কয়েকটি নিত্যপণ্য বিক্রির উদ্যোগ নেয় সরকার। অনিয়ম ঠেকাতে চালু হয় ‘ফ্যামিলি কার্ড’। সেই কার্ড বিতরণেও নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। যে স্থানে পণ্য বিক্রির কথা, সেখানে না করে অন্য জায়গায় ট্রাক দাঁড় করাচ্ছেন ডিলাররা। দুপুরে বিক্রি শুরুর কথা থাকলেও সম্প্রতি বেশিরভাগ ডিলার বিকেলে বিক্রি করছেন। কেউ কেউ বিক্রি করেন সন্ধ্যায়। ফলে অনেক ক্রেতা নির্দিষ্ট স্থানে পণ্য কিনতে গিয়ে খালি হাতে ফিরছেন। আবার কোনো কোনো ডিলার সব পণ্য বিক্রি না করে অন্যত্র বেচে দেন। অভিযোগ রয়েছে কার্ড বিতরণের ক্ষেত্রেও। অনেকের অভিযোগ কাউন্সিলররা মুখ দেখে কার্ড বিতরণ করেছেন। কোনো কোনো পরিবার চার-পাঁচটি করে কার্ড পেয়েছে। আবার কেউ কেউ এনআইডি কার্ড নিয়ে কাউন্সিলরের অফিসে মাসের পর মাস ঘুরেও কার্ড পাননি। গত সোমবার রাজধানীর বনানী ও মহাখালীর কয়েকটি এলাকায় টিসিবির পণ্য বিক্রির সময় ক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। বনানী এলাকায় আইপিএইচ মসজিদের উত্তর পাশে, মুন্না জেনারেল স্টোরের সামনে পণ্য বিক্রি করতে দেখা গেছে বিসমিল্লাহ স্টোর নামের এক ডিলারকে। সেখানে ঝরনা বেগম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘মাস চারেক আগে পণ্য কেনার জন্য কার্ড দিয়েছিলাম। ডিলারের লোকজন কার্ডটা ফেরত দেয়নি। বলেছে মানুষের ভিড়ে হারায় গেছে। পরে খুঁজে দেবে। সেই কার্ড আর পাওয়া যায়নি।’সামাদ নামের আরেকজন ক্রেতা বলেন, ‘এক বছরে তিনি মাত্র দু’বার কিনতে পেরেছেন। দুপুর থেকে এখানে কয়েকশ মানুষ অপেক্ষা করে। বেশ কয়েকজনকে দিয়ে এক ঘণ্টা বিক্রি বন্ধ। কিছুক্ষণ পর ইফতারের সময় হবে। তখন ক্রেতাদের অনেকেই চলে যাবে। এরপর ডিলার পণ্যগুলো নিয়ে অন্য জায়গায় বেচবে।’ মারিনা বেগম নামের এক ক্রেতা বলেন, ‘কোন দিন কোন জায়গায় বিক্রি হয়, সে তথ্য জানানো হয় না। আশপাশের পরিচিতজন কেউ পাইলে জানায়। তখন দৌড়ে ছুটে আসি। অনেকের পেছনে দাঁড়াই। মাঝে মাঝে পাই না।’ বনানীর ইনস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনে পণ্য বিক্রি করছিল টিসিবির ডিলার এনএস এন্টারপ্রাইজ। বিকেল ৪টার দিকে সেখানে দেখা গেছে শত শত ক্রেতার ভিড়। পরিবার কার্ড হাতে একদিকে নারী, অন্যদিকে পুরুষের সারি। এ সারিতে রাজমিস্ত্রি লতিফ মিয়ার জায়গা হয়নি। তিনি বলেন, ‘কমিশনার যাদের দায়িত্ব দিয়েছেন, তারা একেকজন চার-পাঁচটা করে কার্ড নিছে। আমরা কমিশনার অফিসে ভোটার আইডি কার্ড জমা দিছি। কয়েকবার গেছিলাম। দেব দেব বলে আর দেয়নি।’ ডিলার বিসমিল্লাহ স্টোরের বিক্রয়কর্মী আসাদুর রহমানের দাবি, পণ্য থাকা পর্যন্ত বিক্রি করা হয়। আর এনএস এন্টারপ্রাইজের বিক্রয়কর্মী কাউসার আলম স্বপন বলেন, কমিশনার যেদিন যেখানে বিক্রি করতে বলেন, সেখানে তাঁরা বিক্রি করেন। সন্ধ্যা ৬টায় মহাখালী বাসস্ট্যান্ডের উত্তরে পাশের গলিতে দেখা গেছে, ৬০০ থেকে ৭০০ নারী-পুরুষ পরিবার কার্ড ও ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। দুপুর ১২টা ২৯ মিনিটে এখানে গাড়ি আসে। তবে বিক্রি শুরু হয় ইফতারের পর। এই পয়েন্টে ভিন্ন এক কৌশলের তথ্য জানা গেছে। মধ্যবয়সী এক ক্রেতার হাতে একটি কার্ড দেখা যায়। তাতে নাম লেখা আশরাফুল আলম। কার্ডে সংযুক্ত ছবি দেখে অনুমান করা গেছে আশরাফুলের বয়স ৭০ হতে পারে। তবে কার্ডের লোক কে জানতে চাইলে নিজের নাম না বলে মধ্যবয়সী ওই ক্রেতা বলেন, ‘যাঁর কার্ড তাঁর কাছে টাকা নাই। তাই আমি কিনতে আসলাম।’ চট্টগ্রামে কাউন্সিলরদের লোকদের হাতে কার্ড: নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন চট্টগ্রাম নগরের লালখান বাজারের মিলন মাস্টার কলোনির রুনু দাশ। টিসিবির ফ্যামিলি কার্ড পাননি তিনি। তাঁর অভিযোগ, ‘মুখ দেখে দেখে কার্ড দিচ্ছেন নেতারা।’তাঁদের কলোনিতে ১০ পরিবার থাকলেও কেউ কার্ড পায়নি। শুধু এই ওয়ার্ড নয়, নগরের ৪১টি ওয়াডের্র নিম্ন আয়ের অনেকে পাননি ফ্যামিলি কার্ড। তাঁদের অভিযোগ, কাউন্সিলর ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের পরিচিত ব্যক্তিরাই কার্ড বেশি পেয়েছেন। তবে তাঁরা কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি। আবার অনেকে কার্ড পেলেও নির্ধারিত দিনে গিয়ে পণ্য পান না বলে অভিযোগ করেছেন। ডিলারদের বিরুদ্ধে পণ্য কম দেওয়ারও অভিযোগ আছে। নগরীর লালখান বাজারের ১ নম্বর গলির সুলতানা বেগমের অভিযোগ স্থানীয় কাউন্সিলরের লোকজন তাঁদের পরিচিতদের কার্ড দিয়েছেন। প্রকৃত দুস্থদের দেননি। সিটি করপোরেশন এলাকায় টিসিবির নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য ভর্তুকি মূল্যে বিক্রির কার্যক্রম তদারকি কমিটির এক সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘নারী কাউন্সিলররা যাঁদের নাম দিয়েছেন, পুরুষ কাউন্সিলররা তাঁদের ফ্যামিলি কার্ড দেননি।’ যাঁরা কার্ড পেয়েছেন, তাঁরাও অনেক সময় এসে পণ্য পান না। গত ১৬ মার্চ চট্টগ্রামের শহীদ নগর সিটি করপোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে টিসিবি পণ্য দেওয়া হয়। এ সময় লালখান বাজার এলাকার অনেকে লাইনে দাঁড়ালেও পণ্য পাননি। তাঁদের একজন রুহুল আমিন। তিনি বলেন, ‘ডিলাররা পণ্য কম আনেন। তাঁরা নির্দিষ্ট কিছু কার্ডে সিল মেরে দেন। তাঁদেরকে পণ্য দেন। পণ্য শেষ হয়ে গেছে বলে বাকিদের দেওয়া হয় না।’ বরিশালে টিসিবির পণ্য মেয়রের নিয়ন্ত্রণে: ডিলারের মাধ্যমে টিসিবির পণ্য সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রির কথা থাকলেও বরিশাল নগরে তা নিয়ন্ত্রণ করছেন সিটি মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ। এ নিয়ে টিসিবি কর্মকর্তা ও ডিলারদের মধ্যে অস্বস্তি থাকলেও সাদিক আবদুল্লাহর ভয়ে মুখ খুলতে পারছেন না কেউ। একাধিক ডিলার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, বছরখানেক আগে মেয়র টিসিবির পণ্য বিক্রির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তখন কার্ড ব্যবস্থা ও দোকানে পণ্য বিক্রির নিয়ম ছিল না। ওই সময়ে মেয়রের ছবিসংবলিত গেঞ্জি পরে স্থানীয় ছাত্রলীগ কর্মীদের ট্রাকে পণ্য বিক্রি করতে নিয়মিত দেখা গেছে। এর আগে ডিলারদের তদারকির দায়িত্বে ছিলেন জেলা প্রশাসকের নিযুক্ত ট্যাগ অফিসার (সরকারি কর্মকর্তা)। মেয়রের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার পর ট্যাগ অফিসার নিয়োগ হচ্ছে না। ডিলাররা জানান, এখন দোকানঘরে কার্ডধারীদের কাছে পণ্য বিক্রির নিয়ম হলেও নিয়ন্ত্রণ মেয়র অনুসারীদের হাতেই রয়েছে। একই পরিবারের অন্তত পাঁচজনকে কার্ড বিতরণ করার অভিযোগ রয়েছে কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতাদের বিরুদ্ধে। কার্ড ছাড়াও স্লিপের মাধ্যমে পণ্য বিক্রিতে বাধ্য করার অভিযোগ জানিয়ে একাধিক ডিলার জানান, কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতারা জাতীয় পরিচয়পত্রের ফটোকপির ওপর সই ও সিল দিয়ে কাউকে পাঠালে পণ্য দিতে বাধ্য হন সংশ্লিষ্ট ডিলার। ওয়ার্ডভিত্তিক পণ্য বিতরণেও বৈষম্যর অভিযোগ জানিয়ে ডিলাররা জানান, মেয়রের আস্থাভাজনদের এলাকায় বেশিসংখ্যক কার্ডধারীর পণ্য দেওয়া হয়। আবার সেখানে ডিলার দেওয়া হয় কম। মেয়রের আস্থাভাজন কাউন্সিলর শেখ সাইদ আহমেদ মান্নার ২১ নম্বর ওয়ার্ডে দু’জন ডিলার, প্রত্যেককে ১ হাজার ২৫০ জন কার্ডধারীর পণ্য দেওয়া হয়। এর বিপরীতে ৯ নম্বর ওয়ার্ডে ডিলার দেওয়া হয়েছে চারজন। প্রত্যেককে দেওয়া হয় ৭৫০ জন কার্ডধারীর পণ্য। ঘনবসতিপূর্ণ ও রসুলপুর বস্তিখ্যাত এই ওয়াডের্র কাউন্সিলর হলেন বিএনপি নেতা হারুন অর রশিদ। তবে টিসিবির বরিশাল আঞ্চলিক অফিসের সহকারী পরিচালক শতদল মণ্ডল পণ্য বিক্রিতে সিটি করপোরেশনের নিয়ন্ত্রণ পুরোপুরি অস্বীকার করেন। ওএমএস অনিয়ম: ওএমএসের চাল বিক্রিতেও ব্যাপক অনিয়ম চলছে। ডিলার ও সরকার নিযুক্ত খাদ্য পরিদর্শকদের যোগসাজশে একশ্রেণির দালাল নানা কৌশলে নামে-বেনামে উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চাল। পরে তা বিক্রি করা হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে। গ্রিন রোড, বাংলামোটর, পলাশীবাজার, আজিমপুর ছাপড়া মসজিদ এলাকায় ওএমএস ডিলারের দোকানে গিয়ে দেখা গেছে, প্রকাশ্যেই তাঁরা ইচ্ছেমতো নাম লিখে ও তার নিচে নিজেদের আঙুলের টিপ বসিয়ে চাল আত্মসাৎ করছেন। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, জনপ্রতি ৫ কেজি চাল ও ২ কেজি আটা বিক্রির কথা থাকলেও ডিলাররা বাড়তি টাকা নিয়ে ১০ থেকে ৩০ কেজি পর্যন্ত চাল বিক্রি করছেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বসিলায় তিন সন্তান নিয়ে থাকেন হনুফা বেগম। রিকশাচালক স্বামীর রোজগার দিয়ে তাঁদের সংসার আর চলে না। তাই সরকারের ওএমএসের চাল কিনতে সকাল ৯টায় লাইনে দাঁড়িয়ে বেলা ২টা পার হলেও কিনতে পারেননি। তিনি বলেন, চাল বিক্রেতারা ঘুষের বিনিময়ে চাল দিচ্ছেন লাইনের বাইরের লোকদের। এর প্রতিবাদ করলে উল্টা অপমান-অপদস্থ হতে হয়। রাজধানী ছাড়া ঢাকার বাইরেও ওএমএস কার্যক্রমে নানা অনিয়ম হচ্ছে। সম্প্রতি দরিদ্রদের কেনার সুযোগ না দিয়ে ওএমএস ট্রাকের সব চাল কিনে নেন নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সদস্য ও সিটি করপোরেশনের ১৭ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর (প্যানেল মেয়র-১) আবদুল করিম বাবু। খাদ্য অধিদপ্তরের ঢাকা রেশনিংয়ের প্রধান নিয়ন্ত্রক সুরাইয়া খাতুন বলেন, কোনো তত্ত্বাবধায়ক বা বিক্রয়কর্মী যদি টাকার বিনিময়ে অনিয়ম করেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে ধারা অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ছাড়া অভিযোগের বিষয়টি খোঁজখবর নেব। এ ব্যাপারে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আরিফুল হাসান বলেন, সংকটেও সরকার নিম্ন আয়ের মানুষের জন্য শত শত কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে পণ্য বিক্রি করছে। এতে কোনো অনিয়ম হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে অনিয়মের অভিযোগ সুনির্দিষ্ট হতে হবে। তিনি বলেন, কার্ড করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে সিটি করপোরেশনকে। তবে সিটি করপোরেশনের কোনো কোনো কাউন্সিলর বলেছেন, কার্ড নেওয়ার মতো লোক পাচ্ছেন না তাঁরা। টিসিবি দ্রুত সব কার্ড বিতরণের আহ্বান জানিয়েছে।