মহামারি করোনা নিয়ন্ত্রণে সফলতা দেখিয়েছে বাংলাদেশ। তবে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা (ইউনিভার্সাল হেলথ কাভারেজ-ইউএইচসি) অর্জনে তেমন অগ্রগতি নেই। সব মানুষের জন্য বিনামূল্যে বা স্বল্পমূল্যে গুণগত মানের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করাই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার মূলনীতি। তবে দেশে এখনও মানসম্মত সেবা নিশ্চিত হয়নি। নগরে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্যে দেখা যায়, ২০১২ সালে ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা’ কর্মসূচি নেওয়া হয়। ইতোমধ্যে ১০ বছরের বেশি সময় পার হলেও কাজে দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু পাইলট প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ রয়েছে। তবে পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ সমগ্র জনগোষ্ঠীকে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষার আওতায় আনার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে এখনও এর পরীক্ষামূলক (পাইলট প্রকল্প) কাজ হচ্ছে টাঙ্গাইলে। আগামী অর্থবছরে বরিশাল অথবা রংপুরে পাইলট প্রকল্প বাস্তবায়ন হওয়ার কথা রয়েছে। এ পরিস্থিতিতে আজ শুক্রবার দেশে পালিত হবে বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য– ‘হেলথ ফর অল’, অর্থাৎ সবার জন্য স্বাস্থ্য। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগামী ছয় বছরে সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা অর্জনে স্বাস্থ্য খাতকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। এমন এক কাঠামো নিশ্চিত করা দরকার, যেখানে বিনামূল্যে দেশে সব জনগণ প্রাথামিক স্বাস্থ্যসেবা ও জরুরি সেবা পেতে পারে। এজন্য দৃঢ় রাজনৈতিক অঙ্গীকার জরুরি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা শুধু পাইলট প্রকল্পের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে হবে না। এটি বাস্তবায়নে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবায় সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। একই সঙ্গে রোগ প্রতিরোধেও গুরুত্ব দিতে হবে। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে দেশে কমিউনিটি ক্লিনিকগুলো আরও কার্যকর করতে হবে। পাশাপাশি উপজেলা ও ইউনিয়নে দুই ধারার স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানকে একীভূত করে ইউনিয়ন সেবাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এখানে বেসরকারিভাবে একজন চিকিৎসক নিয়োগ দিতে হবে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও শক্তিশালী এবং ডিজিটাল পদ্ধতিতে ওষুধ সংরক্ষণের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা দরকার। ল্যাব সক্ষমতা বাড়াতে হবে। নগরে আলোক ক্লিনিকের মতো সেবাকেন্দ্রে তৈরি করে দুই বেলা সেবা নিশ্চিত করতে হবে। বিশ্বব্যাংকের সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা সূচকে এখনও অনেক পিছিয়ে রয়েছে বাংলাদেশ। ১০০ স্কোরে বাংলাদেশের অবস্থা ৫১, যেখানে নেপালের ৫৩, ভারতের ৬১, ভুটানের ৬২, শ্রীলঙ্কার ৬৭ ও মালদ্বীপের ৬৯। অন্যদিকে ৪৫ স্কোর নিয়ে বাংলাদেশের নিচে আছে পাকিস্তান। সৈয়দ আবদুল হামিদ বলেন, করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অবকাঠামো বেড়েছে। তবে সেবার সক্ষমতা বাড়েনি। জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসায় নানামুখী সংকটে পড়ছে রোগীরা। এদের একটি অংশ বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঝুঁকছে। তবে বেসরকারি পর্যায়ে চিকিৎসায় উচ্চ ব্যয়ের কারণে রোগীদের বড় একটি অংশই স্বাস্থ্য সুরক্ষার বাইরে থেকে যাচ্ছে। সরকারি হাসপাতালে সক্ষমতা বাড়াতে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, দেশের জেলা-উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলোতে সঠিক সেবা নিশ্চিত করা গেলে বেসরকারি হাসপাতাল থেকে মুখ ফিরিয়ে নেবে মানুষ। সরকারি হাসপাতালের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরবে। দরিদ্র মানুষ স্বাস্থ্যসেবা পাবে। দেশে বর্তমানে সরকারি ব্যবস্থাপনায় মোট জনগোষ্ঠীর ৪০ শতাংশকে স্বাস্থ্যসেবার আওতায় আনা সম্ভব হয়েছে। বাকি ৬০ শতাংশের চিকিৎসাসেবাও সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিশ্চিত করতে হবে। তার মতে, জেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে যে সার্ভিস দেওয়ার কথা, তা জনগণ এখনও পাচ্ছে না। জনগণকে কাঙ্ক্ষিত সেবা দেওয়া সম্ভব হলে সরকারি হাসপাতালের সেবায় মানুষের আস্থা ফিরবে। এই ব্যবস্থাপনাটা আগে ঠিক করতে হবে। এই সেবাকেন্দ্রগুলোতে যে দুর্বলতা রয়েছে, তা চিহ্নিত করে টাস্কফোর্স গঠনের মাধ্যমে দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে হবে। আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ড. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা ব্যস্তবায়নে সর্বোচ্চ রাজনৈতিক পর্যায় থেকে হস্তক্ষেপ প্রয়োজন। কর্মসূচি চালু হওয়ার পর অনেক সময় চলে গেছে।’ তিনি বলেন, হাসপাতালগুলোর অবস্থা এমন যে, সেখানে গিয়ে উল্টো অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়েন। নৈতিকতা প্রতিষ্ঠা বা নৈতিক ব্যবসা নিশ্চিত করার বিষয়টি জরুরি। ওষুধের দামের ওপর কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। চিকিৎসা ক্ষেত্রে বেসরকারি খাত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু একে নিয়ম-নীতির মধ্যে আনার উদ্যোগ নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের রেসপিরেটরি মেডিসিন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, সব মানুষের জন্য সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বড় বাধা হলো বৈষম্য। আমরা একটি অসম পৃথিবীতে বসবাস করছি। কিছু মানুষ সুস্বাস্থ্য ও উন্নত জীবনযাপন করছে। অন্যদিকে অধিকাংশ মানুষ কোনো রকমে বেঁচে থাকতে নিরন্তর যুদ্ধ করছে। স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইউনিটের মহাপরিচালক ড. মো. এনামুল হক বলেন, টাঙ্গাইলের তিন উপজেলার দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে পাইলট প্রকল্প চলমান রয়েছে। আগামী অর্থবছরে বাজেট বাড়লে আরও দু-এক জেলায় কার্যক্রম শুরু হবে।