স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণের চাপে পড়েছে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। এ ধরনের ঋণ পরিশোধ বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ কমছে। গত এক মাসের ব্যবধানে রিজার্ভ কমেছে ১২৪ কোটি ডলার। এক বছরের হিসাবে কমেছে ১২৯৮ কোটি ডলার। যদিও গত এক সপ্তাহের ব্যবধানে বেড়েছে ১৬ কোটি ডলার। আগামী মাসের প্রথমদিকে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দেনা বাবদ ১০০ কোটি ডলারের বেশি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হবে। তখন রিজার্ভ আরও কমে যেতে পারে। সূত্র জানায়, রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে ব্যাপকভাবে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। আগে প্রতিমাসে আমদানি বাবদ লাগত গড়ে প্রায় ৮০০ ডলার। এখন তা ৪৫০ থেকে ৪৭০ কোটিতে নেমেছে। আমদানি কমেছে গড়ে প্রায় ৪০ শতাংশ। নতুন এলসি খোলায় নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত। শুধু রোজাসংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানিতে কিছুটা শিথিলতা রয়েছে। গত বছরের ফেব্র“য়ারির তুলনায় চলতি বছরের ফেব্র“য়ারিতে এলসি খোলা কমেছে ৩৬ শতাংশ। জুলাই থেকে ফেব্র“য়ারিÑআট মাসে এলসি খোলা কমেছে প্রায় ২৫ শতাংশ। আমদানি কমেছে সাড়ে ১০ শতাংশ। এরপরও রিজার্ভের ওপর চাপ কমছে না। এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়ে গেছে। এসব ঋণ আগে পরিশোধের কথা থাকলেও করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে পরিশোধ স্থগিত করা হয়। এগুলো এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এর মধ্যে আমদানি বাবদ বেসরকারি খাতের ঋণই সবচেয়ে বেশি। এর সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি ঋণও রয়েছে। স্বল্পমেয়াদি ঋণ সাধারণত ছয় মাস থেকে এক বছরের মেয়াদে নেওয়া হয়। কোনো কারণে ঋণ পরিশোধ সম্ভব না হলে ঋণদাতা ও গ্রহীতার মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে এর মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো যায়। করোনা ও বৈশ্বিক মন্দার কারণে ঋণ পরিশোধ করতে উদ্যোক্তাদের সক্ষমতা কমায় এগুলো পরিশোধের মেয়াদ ইতোমধ্যে এক বছর থেকে দুই বছর বাড়ানো হয়েছে। এখন ওইসব ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। বর্তমানে আমদানি বাবদ ও প্রকল্প ঋণ হিসাবে মোট স্বল্পমেয়াদি ঋণ রয়েছে ২১০০ কোটি ডলার। এর মধ্যে সরকারি খাতে ৩০০ কোটি ডলার এবং বেসরকারি খাতে ১৮০০ কোটি ডলার। মোট ঋণের মধ্যে ৫০০ কোটি ডলার প্রকল্প ঋণ হিসাবে দেওয়া। বাকি ১৬০০ কোটি ডলার আমদানি খাতে নেওয়া। মোট ঋণের মধ্যে চলতি বছরে পরিশোধ করতে হবে প্রায় ১৬০০ কোটি ডলার। প্রতিমাসে গড়ে ১৫০ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। এছাড়া দীর্ঘমেয়াদি ঋণ রয়েছে ৭৫২০ কোটি ডলার। এর মধ্যে আগামী অর্থবছরে ২০০ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হবে। চলতি অর্থবছরে পরিশোধ করতে হচ্ছে ১৭০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধ, আমদানি মেটাতে প্রতিমাসে গড়ে খরচ হচ্ছে ৭০০ কোটি ডলার। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রা আয় হচ্ছে ৬৫০ থেকে ৬৭০ কোটি ডলার। প্রতিমাসে ঘাটতি থাকছে ৩০ থেকে ৫০ কোটি ডলার। এই ঘাটতি মেটাতে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করতে হচ্ছে। এ কারণে চাপ পড়ছে রিজার্ভে। ঘাটতির কারণে রিজার্ভে ডলার যোগ হচ্ছে না। এদিকে আইএমএফ থেকে ঋণের প্রথম কিস্তি বাবদ ৪৭ কোটি ডলার গত ফেব্র“য়ারিতে পেয়েছে বাংলাদেশ। এতে রিজার্ভ কিছুটা বেড়েছিল। পরে তা আবার কমতে থাকে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার দেশের রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ১২২ কোটি ডলার। এর আগের সপ্তাহে তা নেমে গিয়েছিল ৩ হাজার ১০৬ কোটি ডলারে। এক সপ্তাহের ব্যবধানে রিজার্ভ বেড়েছে ১৬ কোটি ডলার। আলোচ্য রিজার্ভ থেকে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বাদ দিতে হবে। ওইসব অর্থ বিভিন্ন খাতের তহবিলে বিনিয়োগ করা হয়েছে। এতে ব্যবহারযোগ্য রিজার্ভ কমে দাঁড়াবে ২ হাজার ৪২২ কোটি ডলার। এক বছর আগে রিজার্ভ ছিল ৪ হাজার ৪২২ কোটি ডলার। এক বছরের হিসাবে রিজার্ভ কমেছে ১ হাজার ২৯৮ কোটি ডলার। এদিকে রোজা ও ঈদের কারণে রেমিট্যান্স কিছুটা বেড়েছে। গত ছয় মাস পর রেমিট্যান্স ২০০ কোটি ডলারের ঘর ছাড়াল। তবে রপ্তানি আয়ের ধারা আবার নিæমুখী হয়েছে। দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের ৭০ শতাংশই আসে রপ্তানি খাত থেকে, ২৮ শতাংশ আসে রেমিট্যান্স থেকে। বাকি ২ শতাংশ অন্যান্য খাত থেকে। এ কারণে রপ্তানি আয় কমে গেলে রিজার্ভে চাপ আরও বাড়বে। গত অক্টোবরে রপ্তানি আয় ছিল ৪৩৬ কোটি ডলার। নভেম্বরে তা বেড়ে ৫০৯ কোটিতে ওঠে। ডিসেম্বরে তা আরও বেড়ে ৫৩৭ কোটি ডলারে ওঠে। জানুয়ারিতে আবার কমে ৫১৪ কোটি ডলারে নেমে যায়। ফেব্র“য়ারিতে তা আরও কমে ৪৬৩ কোটি ডলারে নামে। মার্চে তা ১ ডলার বেড়ে ৪৬৪ কোটি ডলারে ওঠে। গত বছরের মার্চের তুলনায় চলতি বছরের মার্চে রপ্তানি আয় কমেছে ৩ দশমিক ৫০ শতাংশ। গত বছরের মার্চে বেড়েছিল ৫৫ শতাংশ। গত অর্থবছরের জুলাই-মার্চে বেড়েছিল সাড়ে ৩৩ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে বেড়েছে মাত্র ৮ শতাংশ। রপ্তানিশিল্পের কাঁচামাল আমদানি করা হয় ব্যাক টু ব্যাক এলসির মাধ্যমে। গত অর্থবছরের জুলাই-ফেব্র“য়ারির তুলনায় চলতি অর্থবছরের একই সময়ে ব্যাক টু ব্যাক এলসি খোলা কমেছে ৩৪ শতাংশ। আমদানি কমেছে ১০ শতাংশ। অর্থাৎ রপ্তানিশিল্পের কাঁচামাল আমদানি কম হয়েছে। এতে আগামী দিনে রপ্তানি কমে যেতে পারে। এছাড়া ইউরোপ ও আমেরিকায় মন্দার কারণেও দেশের রপ্তানি আয় কমছে। রোজা ও ঈদের কারণে রেমিট্যান্স বেড়েছে। এ ধারা আগামী কোরবানির ঈদ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। গত জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছিল ২১০ কোটি ডলার, আগস্টে ২০৪ কোটি ডলার। সেপ্টেম্বর থেকে তা ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যায়। সেপ্টেম্বরে এসেছিল ১৫৪ কোটি ডলার, অক্টোবরে ১৫৩ কোটি, নভেম্বরে ১৬০ কোটি, ডিসেম্বরে ১৭০ কোটি, জানুয়ারি ১৯৬ কোটি এবং ফেব্র“য়ারিতে ১৫৬ কোটি ডলার। মার্চে তা বেড়ে আবার ২০২ কোটি ডলারে ওঠে। এদিকে বৈদেশিক বিনিয়োগ সামান্য বেড়েছে। গত অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারিতে বৈদেশিক বিনিয়োগ এসেছিল ১২৯ কোটি ডলার, চলতি অর্থবছরের একই সময়ে এসেছে ১৩৪ কোটি ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে অনুদান বেড়েছিল ৪৭ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের ওই সময়ে কমেছে ১৮ শতাংশের বেশি। এছাড়া বিদেশ ভ্রমণ, শিক্ষা ও চিকিৎসা খাতেও ডলার খরচ বেড়েছে। এসব কারণে রিজার্ভ চাপে পড়েছে।