পৃথিবী নশ্বর। নশ্বর পৃথিবীতে কেউ স্থায়িত্ব লাভ করতে পারে না। কেননা মৃত্যু অনিবার্য। সকলকেই মৃত্যুবরণ করতে হবে। এটা চিরন্তন সত্য। বিষয়টি সকলেরই জানা। তবে এটা নিয়ে গভীর উপলদ্ধি খুব বেশি মানুষের নেই। বিষয়টি নিয়ে যারা গভীরভাবে উপলদ্ধি করতে পারে তারা মৃত্যু পরবর্তী জীবনের জন্য পুঁজি সঞ্চয় করে। এরপরও অনিচ্ছাকৃতভাবে পার্থিব জীবনের অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি থেকে যায়। যা শুধরানো হয়ে ওঠে না। এজন্য মৃতরা কবরে অসহায়। মারা যাওয়ার পর তাদের আমলের সব রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। তবে মৃত ব্যক্তি যদি কোনো সদকায়ে জারিয়ার কাজ করে যায় কিংবা মৃতের আত্মীয়স্বজন যদি দোয়া করে এবং মৃত ব্যক্তির জন্য সওয়াব প্রেরণের উদ্দেশ্যে কোনো নেক কাজ করে তাহলে মৃত ব্যক্তি সেই নেক কাজের প্রতিদান কবরে পেয়ে থাকে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, মানুষ যখন মারা যায়, তখন তিনটি আমল ব্যতীত তার সব আমল বন্ধ হয়ে যায়। তা হলাে— সদকায়ে জারিয়া, এমন জ্ঞান যা দ্বারা মানুষ উপকৃত হয় এবং এমন সুসন্তান যে তার জন্য দোয়া করে। (মিশকাত-২০৩) রমজানের দ্বিতীয় দশদিন মাগফিরাতময়। মাগফিরাতের এই দশদিনে আল্লাহতায়ালা অগণিত বান্দাকে ক্ষমা করেন। মাগফিরাতের এই সময়ে নিজেদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনার পাশাপাশি মৃত আত্মীয়স্বজনদরে জন্যও ক্ষমা প্রার্থনা করা উচিত। রমজান মাসে প্রতিদিন ইফতারের সময় ও রাতে আল্লাহ বান্দাদের ক্ষমা করেন এবং জাহান্নাম থেকে মুক্তি দান করেন। তাই বরকতময় এই সময়ে মৃত আত্মীয়স্বজনদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করলে তাদের জন্য তা উপকার বয়ে আনবে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) বলেছেন, প্রতিটি ইফতারের সময় এবং প্রতি রাতে লোকদের জাহান্নাম থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। (সুনানে ইবনে মাজাহ-১৬৪৩) অনেকের মা বাবা জীবিত নেই। তারা কবরে কী অবস্থায় আছে সেটাও কারও জানা নেই। তাই সন্তানের কর্তব্য হলো, মা বাবার জন্য শান্তির দোয়া করা। যে শান্তির দোয়া করতে মহান আল্লাহ আমাদেরকে নির্দেশ দিয়েছেন। তা হলো— ‘রব্বির হাম হুমা কামা রব্বায়ানি সগিরা’। এর অর্থ: ‘হে আমার প্রতিপালক, তাদের উভয়ের প্রতি দয়া করুন, যেভাবে তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’। (সুরা বনি ইসরাইল-২৪) মহান আল্লাহ আমাদেরকে মা বাবা এবং নিজেদের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করার দোয়াও শিখিয়ে দিয়েছেন। তাই এই ক্ষমার মাসে বেশি বেশি করে সেই দোয়া পাঠ করতে হবে। এই বিষয়ে আল্লাহতায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেন, ‘রব্বানাগ ফিরলি ওয়ালি ওয়ালিদাইয়া ওয়ালিল মুমিনিনা এওমা একুমুল হিসাব’। অর্থ: ‘হে আমাদের প্রতিপালক! কিয়ামত দিবসে আমাকে, আমার মা বাবা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করুন’। (সুরা ইবরাহিম-৪১) কবর জিয়ারত করা পুণ্যের কাজ। এতে নিজেদের মৃত্যুর কথা স্মরণ হয় এবং মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া দরূদ পাঠ করে সওয়াব পৌঁছানো যায়। আর রমজান মাসে মৃত নিকটাত্মীয়দের কবর জিয়ারত করে তাদের জন্য সওয়াব পৌঁছানো আরও অধিক পুণ্যের কাজ। কবর জিয়ারতের দোয়া সম্পর্কে হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, রাসুল (সা.) কবর জিয়ারতে গিয়ে এভাবে দোয়া করতেন, ‘আসসালামু আলাইকুম ইয়া আহলাল কুবুর, এগফিরুল্লাহু লানা ওয়া লাকুম, আনতুম সালাফুনা ওয়া নাহনু বিল আছারি’। অর্থ: ‘হে কবরস্থানের বাসিন্দাগণ, আপনাদের প্রতি শান্তি বর্ষিত হোক। আমাদের পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের প্রতি আল্লাহ রহম করুন। আমরাও আপনাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করব’। (সহিহ মুসলিম-৯৭৪) কবর জিয়ারতের নিয়ম হলো, কবরস্থানে যাওয়ার পর সর্বপ্রথম জিয়ারতের দোয়া পড়া। এরপর মৃতের জন্য সওয়াব পৌঁছানোর নিয়তে দরূদ শরিফ, সুরা ফাতিহা, সুরা ইখলাস, আয়াতুল কুরসি প্রভৃতি সুরা ও দোয়া পড়ে সওয়াব পৌঁছানো। কবর সামনে রেখে দুই হাত তুলে দোয়া করা উচিৎ নয়। কবরকে পেছনে রেখে কিংবা কবরের দিকে পিঠ দিয়ে কিবলামুখী হয়ে দোয়া করা উচিৎ। আবার কেউ চাইলে হাত না তুলে মনে মনেও দোয়া করতে পারবে। (বেনায়াহ ৩/২৬২, হিন্দিয়া ৫/৩৫০) মৃতদের সওয়াব পৌঁছানোর জন্য দান সদকা করলে তাদের কবরে কাঙ্ক্ষিত সওয়াব পৌঁছে। আর রমজান মাসে মৃত নিকটাত্মীয়দের সওয়াব পৌঁছানোর জন্য দান সদকা করলে তারা আরও অধিক বেশি সওয়াব প্রাপ্ত হবে। কেন না রমজানে প্রতিটি নেক কাজের বিনিময়ে সত্তর গুণ বেশি সওয়াব দেওয়া হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, এক ব্যক্তি রাসুল (সা.) কে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমার পিতা ইন্তেকাল করেছেন এবং ধন-সম্পদ রেখে গেছেন। কিন্তু অসিয়ত করে যাননি। আমি যদি তার পক্ষ থেকে দান সদকা করি, তবে কি তার গোনাহের কাফফারা হবে? রাসুল (সা.) বললেন, হ্যাঁ’। (মুসলিম-১৬৩০) হজরত সাদ ইবনে উবাদা (রা.) রাসুল (সা.) কে বলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! উম্মে সাদ (আমার মা) মৃত্যুবরণ করেছেন। তার পক্ষ থেকে কোন সদকা সর্বোত্তম হবে? রাসুল (সা.) বললেন, পানি। অতঃপর সাদ (রা.) একটি কূপ খনন করে বলেন, এটি উম্মে সাদের কল্যাণের জন্য ওয়াকফ করা হলো’। (আবু দাউদ-১৬৮১) মৃত ব্যক্তির পক্ষ থেকে হজ অথবা উমরা আদায় করলে সেটার সওয়াবও মৃত ব্যক্তির কাছে পৌঁছে। আর সেই সওয়াবের মাধ্যমে মৃত ব্যক্তি কবরে উপকৃত হয়। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ‘এক নারী হজরত রাসুল (সা.) এর নিকট এসে বললেন, আমার মা হজের মান্নত করেছিলেন। তবে হজ আদায় না করেই ইন্তেকাল করেছেন। আমি কি তার পক্ষ হতে হজ করতে পারি? রাসুল (সা.) বললেন , তার পক্ষ থেকে তুমি হজ আদায় করো। তুমি এ ব্যাপারে কী মনে করো, যদি তোমার মায়ের উপর ঋণ থাকত তাহলে কি তুমি তা আদায় করতে না? সুতরাং আল্লাহর হক আদায় করে দাও। কেন না আল্লাহর হকই সবচেয়ে বেশি আদায়যোগ্য’। (বুখারি-১৮৫২) কবর খুব কঠিন জায়গা। কবরে মানুষের কর্মের যথাযথ প্রতিফল দেওয়া হয়। আর পার্থিব জীবনে মানুষের কর্মে ত্রুটিবিচ্যুতি থাকা স্বাভাবিক। কবরে সেসব ত্রুটিবিচ্যুতির হিসাব দেওয়া খুবই দুরূহ। তাই মানুষ সেখানে প্রচণ্ড সহায়হীন অবস্থায় নিপতিত হয়। এরকম পরিস্থিতিতে মৃতদের জন্য মাগফিরাত কামনা এবং কল্যাণমূলক কাজ করে সওয়াব পৌঁছানো ব্যতীত আর কোনো উপায় থাকে না। তাই মৃতদের শান্তি ও মাগফিরাতের জন্য দোয়া ও কল্যাণমূলক কাজ করা নিকটাত্মীয়দের ধর্মীয় দায়িত্ব ও কর্তব্য।