ভয়েস-ইন্টারনেট দুই সেবাতেই দুর্দশা

প্রকাশিতঃ এপ্রিল ১৬, ২০২৩ | ৫:১৪ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দুর্বল নেটওয়ার্ক আর ইন্টারনেটের শম্বুকগতির কারণে মোবাইল ফোন গ্রাহকের ভোগান্তি পিছু ছাড়ছে না। পাশাপাশি ইন্টারনেট, কলসহ নানা সেবার বেহিসাবি প্যাকেজের নামে পকেট কাটছে ফোন কোম্পানিগুলো। প্যাকেজগুলোর অস্পষ্ট হিসাবের কারণে দ্বিধায় পড়ছেন কোনো কোনো গ্রাহক। মোবাইলের সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট আছেন– এমন গ্রাহক এখন খড়ের গাদায় সুঁই খোঁজার মতোই দুর্লভ। নেটওয়ার্ক সমস্যা এতটাই প্রকট হয়েছে, সরকার বাধ্য হয়ে দেশের শীর্ষ একটি মোবাইল ফোন অপারেটরের সিম বিক্রি গত জুনে প্রায় সাত মাস বন্ধ রাখে। গ্রাহকদের অভিযোগ, একাধিকবারের চেষ্টায় ফোনের সংযোগ মেলে। একজনের সঙ্গে একবারে কথা শেষ করা যায় না। কল ড্রপ হয় একাধিকবার। অধিকাংশ কল ড্রপের আবার ক্ষতিপূরণ মেলে না। ইন্টারনেট গতির অবস্থা আরও যাচ্ছেতাই। পর্যাপ্ত ডাটা থাকলেও ভিডিও কল, ইন্টারনেট ব্রাউজিং কিংবা ভিডিও দেখা কষ্টকর হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবকাঠামো দুর্বলতার কারণেই গ্রাহকদের এ ধরনের ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে। অপারেটররা কলড্রপ বা নেটওয়ার্কের ভোগান্তির কথা মানতে চান না। তাদের মতে, কিছু এলাকায় টাওয়ার নির্মাণে জায়গা না পাওয়া এবং বুস্টার ও জ্যামার বসিয়ে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণের কারণে গ্রাহকদের সাময়িক সমস্যা হয়। ভোগান্তির শেষ নেই মোবাইল ফোন নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগের শেষ নেই । ০১৭১১... সিরিজের গ্রামীণফোনের এক গ্রাহক জানান, গত ৫ এপ্রিল সকাল ১০টার একটু পরে অফিসের টিঅ্যান্ডটি ফোন থেকে কল আসে। প্রথমবার ফোন ধরার পর প্রায় ১৩ সেকেন্ড অন্য প্রান্তের কথা শোনা যায়নি। শুধু হ্যালো হ্যালো বলতে হয়েছে। দ্বিতীয়বার কল করে কথা শেষ করতে হয়। একই দিন ওই নম্বরের হোয়াটসঅ্যাপে সকাল সাড়ে ১১টার দিকে গ্রামের বাড়ি থেকে একটি ভিডিও কল আসে। ফোন রিসিভি করে কথা শুরু করার সোয়া মিনিট পরই ভিডিও আটকে যায়, লাইন রিকানেক্ট হতে থাকে। বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে একটি জিপি নম্বরে তিনবার কল করার পর রিং হয়। কথা বলার মাঝেই ৪৭ সেকেন্ডে হুট করে অন্য প্রান্তের কোনো কথা আর শোনা যাচ্ছিল না। পরে লাইন কেটে আবার ফোন করতে হয়। রাত ৯টা ৪০ মিনিটের দিকে একটি বাংলালিংক নম্বরে কথা বলার সময় দুইবার কল ড্রপ হয়। গ্রামীণফোনের ওই গ্রাহক জানান, ওই দিন (৫ এপ্রিল) মেসেঞ্জারে তিনজনের সঙ্গে অডিও ও ভিডিও কলে কথা বলার সময় ভোগান্তিতে পড়তে হয়। শুধু গ্রামীণফোন নয়– এমন অভিযোগ রবি, বাংলালিংক, টেলিটকসহ সব অপারেটরের গ্রাহকদের। আড্ডা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ যে কোনো স্থানে মোবাইল ফোনের সমস্যা নিয়ে কথা তুললেই আশপাশের সবাই তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা বলেন। প্যাকেজ আর অফারের ফাঁদ গত ৪ এপ্রিল ডেসপারেটলি সিকিং-ঢাকা (ডিএসডি) গ্রুপে নবনী নামে একজন লেখেন, ৩৪৪ টাকায় ৩০ জিবি (গিগাবাইট) ডাটার অফার নিতে রিচার্জ করার পর ৭ জিবি ডাটা পান। এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট অপারেটরের কাস্টমার কেয়ারে ফোন দিলে জানানো হয়, বিকেল ৪টার মধ্যে রিচার্জ না করায় ৩০ জিবি পাননি। ওই স্ট্যাটাসের কমেন্টে এআর শরীফ নামে একজন মন্তব্য করেন, তাঁকে ৩৪৪ টাকায় ১২ জিবি ডাটা দেওয়া হয়েছে। কাস্টমার কেয়ারে ফোন করে সমাধান মেলেনি। এভাবে প্রায় সব অপারেটরের গ্রাহকরাই নানা অফার আর প্যাকেজের ফাঁদে প্রতারিত হচ্ছেন। অনেকের অজান্তেই নানা অফার চালু করে ব্যালেন্স কাটা যাচ্ছে। বয়স্ক এবং অল্প শিক্ষিত গ্রাহকের ক্ষেত্রে এই হয়রানি বেশি হচ্ছে বলে জানা গেছে। গ্রাহকরা বলছেন, অপারেটরদের এমএমএসের যন্ত্রণায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ বার্তা চোখ এড়িয়ে যায়। ০১৯১১... সিরিজের বাংলালিংকের এক গ্রাহক জানান, এ মাসেই একদিন সকাল থেকে রাত পর্যন্ত তিনি সংশ্লিষ্ট অপারেটর থেকে ১৮টি প্রমোশনাল এসএমএস পান। গ্রাহকরা অভিযোগ করেন, নিজের অজান্তেই অনেক সময় ইন্টারনেট প্যাকেজ চালু হয়ে যায়। এ ছাড়া প্যাকেজগুলো ২৯, ৫৪, ৭৯ টাকা– এমন ভগ্নাংশ আকারে দেওয়া হয়। দোকান থেকে‌ রিচার্জ করলে ভাঙতি অংশ প্রায় সময়ই ফেরত পাওয়া যায় না। ভোগান্তির পরিসংখ্যান: বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনের (বিটিআরসি) সর্বশেষ তথ্য বলছে, গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশে মোবাইল গ্রাহকের সংখ্যা ১৮ কেটি ২৬ লাখ। এ সময় পর্যন্ত দেশে ইন্টারনেটের গ্রাহক ছিল ১২ কোটি ৫০ লাখ। এর মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেট গ্রাহকই ১১ কোটি ৩১ লাখ। অর্থাৎ দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ৯০ শতাংশই মোবাইল ইন্টারনেটের গ্রাহক। তথ্য বলেছে, দুই বছরে মোবাইল ফোন অপারেটরদের বিরুদ্ধে গ্রাহকরা প্রায় ৪০ হাজার অভিযোগ করেছেন বিটিআরসিতে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ভয়েস কল ও মোবাইল ইন্টারনেট সেবা নিয়ে। ২০২১ সালে বিটিআরসিতে ২৩ হাজার ১৬টি অভিযোগ জমা পড়ে। এর মধ্যে নেটওয়ার্ক কাভারেজ নিয়ে ৪ হাজার ৫২৩টি অভিযোগ এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। আর ২০২২ সালে অভিযোগ জাম হয়েছে ১৫ হাজার ৭৪৯টি। গত বছরের নেটওয়ার্ক কাভারেজ নিয়ে ১ হাজার ৬২২টি অভিযোগের এখনও সমাধান মেলেনি। খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকৃত অভিযোগের পরিমাণ এই সংখ্যার কয়েক গুণ বেশি হবে। কারণ প্রায় সব গ্রাহকই প্রায় দিনই মোবাইল সেবা নিয়ে কোনো না কোনো তিক্ত অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছেন। মিলছে না কলড্রপের ক্ষতিপূরণ গ্রাহকদের অন্যতম ভোগান্তির নাম ‘কলড্রপ’। যদিও গ্রামীণফোন, বাংলালিংক এবং রবি– তিন অপারেটরই দাবি করেছে, তাদের কলড্রপ কমেছে। বিটিআরসির নির্দেশনা অনুসারে প্রথম কলড্রপ থেকেই গ্রাহকদের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা। গ্রাহকদের অভিযোগ, তাঁরা ক্ষতিপূরণ পান না। কয়েক দিনে চার অপারেটরের ১১ গ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত তিন মাসে মাত্র দু’জন একবার করে কলড্রপের ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন। যদিও এই ১১ জনের সবাই জানিয়েছেন, তাঁদের প্রায় প্রতিদিনই এক বা একাধিকবার কলড্রপ হয়েছে। গত ২৩ ফেব্রুয়ারি কয়েক ঘণ্টার জন্য গ্রামীণফোনের প্রায় পুরো নেটওয়ার্ক ‘ব্লাক আউট’ হয়ে যায়। এতে কত গ্রাহক ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে? আদৌ কেউ ক্ষতিপূরণ পেয়েছেন কিনা তা নিয়ে কিছুই জানায়নি অপারেটরটি। নেটওয়ার্কের উন্নয়নে বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন গত ২০ মার্চ সংবাদ সম্মেলনে বাংলালিংক জানায়, ২০২২ সালে অপারেটরটি প্রায় ৪০ শতাংশ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে। গ্রামীণফোন শুধু ২০২২ সালের চতুর্থ প্রান্তিকেই ৫০০.৪ কোটি টাকা নেটওয়ার্ক কাভারেজ ও বিস্তৃতিতে বিনিয়োগ করেছে। অপারেটরগুলোর দাবি অনুযায়ী, নেটওয়ার্কের উন্নয়নে প্রতি বছর তারা শত শত কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। এত বিনিয়োগের পরও মানসম্মত সেবা পাচ্ছেন না গ্রাহকরা। ফলে এই বিনিয়োগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খাত-সংশ্লিষ্টরা। তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ সুমন সাবির আহমেদ বলেন, শোনা যায় প্রতি বছর অপারেটরগুলো নেটওয়ার্ক খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে। তবে তাদের সেবার মান সেভাবে বাড়ছে না। তাই অপারেটরগুলো আদৌ নেটওয়ার্কের উন্নয়নে পর্যাপ্ত বিনিয়োগ করে কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন রাখেন তিনি। বিটিআরসি ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের দায় খাত-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নেটওয়ার্ক সমস্যার অন্যতম কারণ– দেশে ফাইবার অপটিক সেবা প্রধানত দুটি প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। মনোপলি ভাঙার নামে টাওয়ার ব্যবসায় নানা শর্ত আরোপ করে নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ ব্যবস্থাপনা জটিল করে তোলা হয়েছে। ফলে গ্রাহক অনুপাতে টাওয়ার বসানো সম্ভব হচ্ছে না। স্পেকট্রাম বরাদ্দ ও ব্যবস্থাপনায় দুর্বলতা রয়েছে অপারেটরদের। নাম প্রকাশ না করার শর্তে দু’জন টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী বলেন, বিটিআরসি তথা টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এই খাতের মান উন্নয়নের চেয়ে অর্থ আদায়ে বেশি মনোযোগী। বেশি রাজস্ব আদায়ে মোবাইল নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনাকে ভেঙে অপ্রয়োজনীয় লাইসেন্সির সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। আইসিএক্স, আইআইজি, আইজিডব্লিউ, টাওয়ার কোম্পানি, এনটিটিএনসহ নানা অপারেটর তৈরি করে ইন্টারসেকশন বাড়ানো হয়েছে। ফলে নেটওয়ার্ক ব্যবস্থাপনা জটিল হয়ে পড়েছে। অপারেটরদের ব্যাখ্যা কলড্রপ ও নেটওয়ার্ক সমস্যা নিয়ে দেশের তিন বেসরকারি অপারেটর কোম্পানির কাছে জানতে চাওয়া হলে গ্রামীণফোন ও বাংলালিংকের কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। রবির চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, কলড্রপ অনেক কমে গেছে। অপারেটরগুলোর পর্যাপ্ত কাভারেজ থাকলেও নানা কারণে নেটওয়ার্কের সমস্যা দেখা দেয়। বিশেষ করে ঢাকায় সমস্যা একটু বেশি। রাজধানীর অনেক স্থানে টাওয়ার বসানোর অনুমতি মেলে না। একটি অপারেটরের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, নেটওয়ার্ক সমস্যার আরেকটি বড় কারণ যত্রতত্র বুস্টার ও জ্যামার বসিয়ে নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ। কিছু ইস্যু আছে যেগুলোতে রেগুলটেরি সংস্থার সহযোগিতা প্রয়োজন। তবে সেই প্রয়োজনীয় সহায়তা মেলে না। এ প্রসঙ্গে বিটিআরসির চেয়ারম্যান শ্যাম সুন্দর শিকদার সম্প্রতি বলেন, নেটওয়ার্ক সমস্যা আছে। তবে ধীরে ধীরে উন্নতি হচ্ছে। কলড্রপের পরিমাণ কমেছে। তিনি বলেন, নিয়মিত নেটওয়ার্কের মান পরীক্ষা করা হয়। সেবার মান উন্নয়নে অপারেটরদের নিয়মিত নির্দেশনা দেওয়া হচ্ছে। এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, সেবার মান উন্নয়নে অপারেটরদের নিয়মিত চাপ দেওয়া হচ্ছে। ইতোমধ্যে তারা বেশ উন্নতি করেছে। বিশেষ বিশেষ স্থানে যেখানে সমাগম বেশি হয়, সেখানে নেটওয়ার্ক ঝামেলা করে।