মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিতে সর্বোচ্চ জোর দেওয়া হচ্ছে। আগামী ২ বছরের মধ্যে কৃষি খাতে ঋণের অঙ্ক ৫০ শতাংশ বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বর্তমান এখাতে পৌনে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ হচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে এটি সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত করতে হবে। ফলে এখনকার চেয়ে প্রায় পৌনে ছয় হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে বিতরণের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি সহজে ঋণ দিতে কৃষকদের সঙ্গে সরাসরি মোবাইল ফোনে কথা বলতে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের প্রতিনিধিদের নির্দেশ দেওয়া হয়। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কৃষি ঋণ বিতরণ ও আদায় সংক্রান্ত মাসিক সভায় এসব নির্দেশ দেওয়া হয়। মূলত আগামীতে খাদ্য নিরাপত্তা গড়ে তুলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে এ উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বৈঠকের কার্যবিবরণীতে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। এই নির্দেশনার চিঠি রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি রাষ্ট্রায়ত্ত বিশেষায়িত ব্যাংকগুলোকেও পাঠানো হয়েছে। সরকারি গবেষণা সংস্থা (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক ও অর্থনীতিবিদ এমকে মুজেরি বলেন, এখনো পর্যন্ত প্রান্তিক ও ক্ষুদ্র কৃষকের কাছে প্রাতিষ্ঠানিক কৃষি ঋণ পৌঁছে না। অথচ মোট কৃষকের ৮০ শতাংশই তারা। এদের অধিকাংশই উচ্চ সুদে এনজিও ও মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছেন। ঋণের অঙ্ক ৫০ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত ভালো। এতে খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ বাড়বে। তবে একটি বিষয় খেয়াল রাখতে হবে ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণকৃত ঋণ যেন সঠিক সময়ে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের কাছে পৌঁছায়। কারণ ওরাই সংখ্যায় বেশি। তারা উৎপাদনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে, অথচ বঞ্চিত হচ্ছে ঋণ পাওয়া থেকে। ফলে ঋণ অঙ্ক বাড়ালেই হবে না, যাদের সবচেয়ে ঋণ বেশি দরকার তাদের কাছে পৌঁছাতে হবে। চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরে কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা। প্রতি এক মাস অন্তর ঋণ বিতরণের অগ্রগতি নিয়ে মাসিক সমন্বয় বৈঠক করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এটি ‘রাষ্ট্র মালিকানাধীন এবং বিশেষায়িত ব্যাংকসমূহের কৃষি ঋণ বিতরণ, আদায় ও কৃষি ঋণ নীতিমালায় অন্তর্ভুক্ত উন্নয়নমূলক কার্যক্রম পর্যালোচনা’ সংক্রান্ত সভা নামে পরিচিত। কেন্দ্রীয় ব্যাংকে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (এসিডি) মো. আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, জেলাওয়ারি বরাদ্দ অনুযায়ী ঋণ বিতরণের আনুপাতিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। তিনি পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন। বৈঠকে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে, স্বচ্ছতা ও হয়রানি মুক্ত ঋণ পাওয়া নিশ্চিত করা। ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলো নিজেস্ব কৌশল নিয়ে মাসিক কর্ম-পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। জেলা ভিত্তিক ঋণ বিতরণের অগ্রগতি মনিটরিংয়ের পদক্ষেপ নিতে হবে। এছাড়া একই কৃষকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে যাচাই-বাছাই করে নতুন কৃষকদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ঋণ কর্মসূচির আওতায় আনতে হবে। যৌক্তিকতা বিবেচনায় একই পরিবারের একাধিক কৃষককে ঋণ দিতে হবে। দ্বৈত রিপোর্টিং পরিহার করে ঋণ বিতরণের তথ্য ব্যাংকগুলোকে পাঠাতে হবে। খেলাপি পরিহারের লক্ষ্যে গ্রাহকের সক্ষমতা ও প্রকৃত অবস্থা যাচাই করে ঋণ বিতরণ ও আদায় কার্যক্রম জোরদার করতে হবে। পাশাপাশি আমদানির বিকল্প পণ্য উৎপাদনে ৪ শতাংশ হারে ঋণ ও টাঙ্গাইল জেলার ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীকে ৪ শতাংশ রেয়াতি হারে ঋণ এবং ছিটমহলগুলোতে এজেন্ট ব্যাংকিংসহ নিজস্ব শাখা ও উপ-শাখার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষি ঋণকে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য আকাশচুম্বী উঠেছে। এর প্রভাবে বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি ঘটে। এর সঙ্গে বাংলাদেশের মূল্যস্ফীতির হার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পূর্বাভাস চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি অব্যাহত থাকবে। এমন পরিস্থিতি খাদ্য উৎপাদনে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রধানমন্ত্রী নিজেও খাদ্য উৎপাদন বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষি ঋণে পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সূত্র মতে, বৈঠকে কৃষকদের মধ্যে ‘প্রকাশ্যে কৃষি ঋণ বিতরণ কর্মসূচি’কে বেশি গুরুত্ব দিতে ব্যাংকগুলোকে বলা হয়েছে । চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এই কর্মসূচির আওতায় ৭০ লাখ ৫৩৭ জন কৃষকের মধ্যে ৫৫৭ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। বৈঠকে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ঋণ বিতরণের চিত্র তুলে ধরা হয়। সেখানে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরে কৃষি ঋণের লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে মার্চ (২০ মার্চ) পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে নয় হাজার ৮৮৭ কোটি টাকা। এরমধ্যে অগ্রণী ব্যাংক ৪৯১ কোটি টাকা, বেসিক ব্যাংক ২২ কোটি টাকা, বিডিবিএল ১৮ কোটি টাকা, বিকেবি পাঁচ হাজার ৬০৯ কোটি টাকা, জনতা ৫৭৩ কোটি টাকা, রাকাব এক হাজার ৬৪৫ কোটি টাকা, রূপালী ৩২২ কোটি টাকা ও সোনালী ব্যাংক ৮০৬ কোটি টাকা।