‘দুর্বল’ ইসির চ্যালেঞ্জ সুষ্ঠু নির্বাচন

প্রকাশিতঃ মে ২৪, ২০২৩ | ৭:০৮ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে সক্ষমতার দিক থেকে কিছুটা ‘দুর্বল’ হয়ে পড়ছেন তারা। এমন দুর্বল কমিশনের পক্ষে একটি সবল নির্বাচন (সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ ভোট) সম্ভব হবে কি না, তা নিয়ে নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে। সঙ্গে আলাপকালে নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা এমন আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, সাংবিধানিক এ প্রতিষ্ঠানের অগাধ ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর তা প্রয়োগে দুর্বলতার পরিচয় দিচ্ছে। নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে সাহসিকতার পরিচয় দিতে ব্যর্থ হয়েছে। এরপর পুরো আসনে নির্বাচন বাতিলসহ তাদের আরও কিছু ক্ষমতা খর্ব করা হয়েছে। সীমিত করা হয়েছে কমিশনের এখতিয়ার। আবার তারা নিজেরাও কিছু ক্ষমতা অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে। সবমিলিয়ে কমিশন আগের চেয়ে দুর্বল হচ্ছে। তাদের পক্ষে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন করাই মূল চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সুশাসনের জন্য নাগিরক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সবল ভোট চায় কি না, সেটাও একটা কথা। সবাই বলছে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা খর্ব হয়েছে; কিন্তু ইসি বলছে উলটো কথা। তারা দাবি করছে, তাদের ক্ষমতা আরও বেড়েছে। তারা অনেকটা সরকারের পক্ষে সাফাই গাইছে। তিনি বলেন, বর্তমান কমিশন শুরু থেকেই তাদের সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। কুমিল্লা সিটিসহ কয়েকটি নির্বাচনে তারা স্বাধীন ও সাহসিকতার সঙ্গে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেনি। তাদের নিরপেক্ষতা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। সব দলকে এখনো আস্থায় নিতে পারেনি। তাদের পক্ষে একটি সবল নির্বাচন সম্ভব, সেটা অনেকেই আস্থায় নিতে পারছেন না। ফলে এটা এখন ইসির মূল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে একমত নয় ইসি। তারা মনে করেন, পুরো আসনের ভোট বাতিলের ক্ষমতা হারালেও ইসি আরও শক্তিশালী হয়েছে। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের প্রধান আইন গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) সংশোধনীতে নতুন বিধান যুক্ত হয়েছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘পুরো নির্বাচন বাতিল সংক্রান্ত আরপিওর ৯১(ক) ধারা সংশোধনে ইসি কোনো প্রস্তাব না দেওয়ায় তা বহাল রয়েছে। ৯১(ক) অনুচ্ছেদের সঙ্গে (ক) উপধারা যুক্ত হয়ে রিটার্নিং কর্মকর্তা ফল ঘোষণার পরও নির্বাচন কমিশনকে কেন্দ্র বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, যেখানে ফল ঘোষণার পর বন্ধের ক্ষমতা ছিলই না, সেখানে তো কিছুটা হলেও কেন্দ্র বন্ধ করার ক্ষমতা বাড়ল। আমাদের লক্ষ্য-পুরোটা না হলেও কিছুটা তো অর্জন হয়েছে। পুরো নির্বাচনি আসনের ফল বাতিলের ক্ষমতা পেলে ভালো। কেননা যারা অনিয়ম করে, তাদের মধ্যে তখন একটা ভয় থাকত যে ভোট বাতিল হয়ে যাবে, আবার হ্যাপাটা (ঝামেলা) নিতে হবে।’ গত বৃহস্পতিবার অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আরপিও সংশোধনীর চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়। ওই বৈঠক শেষে মন্ত্রিপরিষদ সচিব মাহবুব হোসেন সাংবাদিকদের জানান, নির্বাচনে কোনো ভোটকেন্দ্রে বড় ধরনের অনিয়ম, কারসাজি ও ভোট প্রক্রিয়ায় বাধা দেওয়ার প্রমাণ পেলে ইসি কেন্দ্রের ভোট বা ফল বাতিল করে পুনরায় ভোটগ্রহণের নির্দেশ দিতে পারবে। পুরো আসনের ভোট বাতিল করতে পারবে না। আরপিও সংশোধনী নিয়ে বিভিন্ন মহলে বিতর্ক ওঠে। কেউ কেউ বলেন, আরপিওতে ইসির ক্ষমতা কমানো হয়েছে। যদি কমিশনের হাত শক্ত করার মতো ইচ্ছা সরকারের থাকত, তাহলে এই বিধান অবশ্যই রাখা হতো; কিন্তু সরকার তা করেনি। আবার নির্বাচন কমিশন নিজের কিছু ক্ষমতা অন্যের হাতে তুলে দিতে যাচ্ছে। জানা যায়, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ‘ভোটকেন্দ্র স্থাপন ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালায়’ পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ভোটকেন্দ্র কোন প্রতিষ্ঠানে হবে, তা নির্ধারণের ক্ষমতা রাজনীতিক, স্থানীয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে আগের নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র বহাল রাখার বাধ্যবাধকতাও তুলে দিচ্ছে। এসব বিধান যুক্ত করে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র স্থাপন এবং ব্যবস্থাপনা নীতিমালা’-এর খসড়া অনুমোদন দিয়েছে ইসির একটি কমিটি। তারা কেন নিজের ক্ষমতা অন্যের হাতে তুলে দিচ্ছে, তা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞ তোফায়েল আহমেদ বলেন, নির্বাচন বাতিল করার ক্ষমতা তো নির্বাচন কমিশনের ছিল। ক্ষমতা না থাকলে তারা গাইবান্ধায় ভোট বন্ধ করল কীভাবে। তাহলে তারা আবার ক্ষমতা চাইতে গেল কেন। এটা আপনারা খুঁজে বের করেন। তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের নেই। দেশে যে সংকট বিরাজমান, সেটা রাজনৈতিক সংকট। এটা সমাধানের চাবিকাঠি সরকারের হাতে। কোনো দল এলো বা না এলো, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন হয়ে যাবে। বর্তমানে সিটি করপোরেশন নির্বাচন চলছে। এতে কি সব দল অংশ নিয়েছে? নির্বাচন কিন্তু হয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ইসির সদিচ্ছার প্রতিফলন যদি কার্যকর করা না যায় এবং আইন যদি সঠিক ও নির্দ্বিধায় প্রয়োগ করা না হয়, তবে শত আলোচনা ও আইন সংস্কার কোনো কাজে আসবে না। নির্বাচন কমিশনের সক্ষমতা নিয়ে শুরুতেই নানা মহলে প্রশ্ন ছিল। কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে তাদের ভূমিকা নিয়ে এ প্রশ্ন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। ইসির অগাধ ক্ষমতা থাকলেও তা ব্যবহারে কমিশন সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। শুরুতেই তারা আজ্ঞাবহের পরিচয় দেয়। কমিশন গঠন নিয়ে এমনিতেই মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ বড় একটি অংশের বিরোধিতা ছিল। দায়িত্ব গ্রহণের দীর্ঘদিন পেরিয়ে গেলেও তাদের আস্থায় আনতে পারেনি তারা। উলটো ইসির কর্মকাণ্ডে দিনদিন তাদের মধ্যে দূরত্ব আরও বেড়েছে। জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, নির্বাচন স্থগিত বা বাতিল করে দেওয়ার উদাহরণ গাইবান্ধার ক্ষেত্রে ইসি আমাদের সামনে হাজির করেছিল। আরপিও সংশোধনীতে তারা সেরকম প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কমিশনের প্রত্যাশা ছিল সরকার এতে সায় দেবে; কিন্তু তা দেয়নি। নির্বাচনের দিন কোনো অনিয়ম হলে একটিমাত্র কেন্দ্রে ভোট স্থগিত করতে পারবে ইসি। পুরো আসনে পারবে না। এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন কমিশনের নখ ও দাঁত রহিতকরণ করা হয়েছে। সীমিত করা হয়েছে কমিশনের এখতিয়ার। যদি এখতিয়ারেই না থাকে, তাহলে তার কাছ থেকে সেটা প্রত্যাশা করা বাতুলতা ছাড়া কিছু না। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন একটি সাংবিধানিক পদ। বর্তমানে যারা আছেন, তারা নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনে শপথ গ্রহণ করেছেন। তারা সবাই হট সিটে বসে আছেন। কিন্তু পথটা কুসুমাস্তীর্ণ নয়। তফশিল ঘোষণার আগ পর্যন্ত সবাইকে নিয়ে নির্বাচন করার চেষ্টা চালিয়ে যাবেন। বিশেষ করে প্রধান যে রাজনৈতিক দলগুলো আছে, তাদের ভোটে আনার চেষ্টা চালাবেন, ভোটে আসার আহ্বান জানাবেন। এর বাইরে গিয়ে তারা কিছুই করতে পারবেন না। কারণ, নির্দিষ্ট সময়ে নির্বাচন তাদের করতেই হবে।