চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাজেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বর্তমান মূল্যস্ফীতির মূল উৎস বিদেশে। কারণ আমাদের ভোগ্যপণ্য আমদানিনির্ভর। বহির্বিশ্বে মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রা বিনিময় হারে ক্রমাগত ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। বাস্তব পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা জনগণকে একটু স্বস্তি দেওয়া এ বছরের বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। সাবেক অর্থ সচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ আগামী বাজেট নিয়ে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে এসব কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সিনিয়র রিপোর্টার মিজান চৌধুরী @# আইএমএফ’র শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আগামী বাজেটে কর রাজস্ব বেশি আদায় করতে হবে। কিভাবে এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যেতে পারে? মাহবুব আহমেদ : দেশে বাজেট আলোচনায় ব্যয় বরাদ্দ বেশি প্রাধান্য পায়। সরকারের আয় বৃদ্ধির উপায় নিয়ে আলোচনা খুব বেশি চোখে পড়ে না। অর্থনৈতিক বাস্তবতা হচ্ছে আয় বাড়াতে হবে-আর এর মূল উৎস হবে কর রাজস্ব। সে বিবেচনায় প্রশ্নটি খুবই সময়োপযোগী। আইএমএফ হতে চার দশমিক পাঁচ বিলিয়ন ডলারের ঋণের জন্য ৩০টি সংস্কার মূলক শর্তের কথা বলা হয়েছে। সেগুলো তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত। যেমন পরিমাণগত, কাঠামোগত এবং সাধারণ শর্তাবলী। রাজস্ব সংক্রান্ত বিষয়ে পরিমাণ এবং কাঠামোগত দুধরনের সংস্কারের কথাই বলা হয়েছে। আর অভ্যন্তরীণ উৎস হতে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য আইনি ও প্রশাসনিক সংস্কারের কথা রয়েছে। আইএমএফ বলার বহু পূর্ব হতেই এসব সংস্কার এবং কর জিডিপির অনুপাত বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে দেশে আলোচনা হচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাজেট আকার অনেক বেড়েছে। কিন্তু তা জিডিপির ১৫ শতাংশের আশপাশেই ঘুরপাক খাচ্ছে। স্বাভাবিক অবস্থায় একটি উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে বাজেটের আকার জিডিপির ২৫-৩০ শতাংশের মধ্যে হওয়া বাঞ্ছনীয়। সুষ্ঠুভাবে রাষ্ট্রপরিচালনা ও উন্নয়ন কার্যক্রম চালু রাখতে হলে রাজস্ব বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নেই। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আওতায় কর রাজস্বের খাত মূলত তিনটি-মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর ও আমদানি শুল্ক। কিন্তু আমদানি শুল্ক হতে রাজস্ব আদায়ের শতাংশ ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও কমবে। ভ্যাট ও আয়কর হবে সরকারি রাজস্বের মূল ভিত্তি। দুটি কারণে প্রত্যক্ষ করের (আয়কর) দিকে নজর দিতে হবে-২০২৬ সালে এলডিসি হতে গ্র্যাজুয়েশনের পর শুল্কমুক্ত কোটা মুক্ত সুবিধাসহ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার অনেক সুবিধাই হারাতে হবে। কিছু সুবিধা ২০২৯ পর্যন্ত অব্যাহত থাকলেও ডব্লিউটিও এর সুবিধা প্রত্যাহার-রপ্তানি বাজারকে প্রতিকূল অবস্থায় ফেলতে পারে। তাই রপ্তানি বাজার ধরে রাখার স্বার্থে দ্বিপাক্ষিক ব্যবস্থায় যেতে হবে। অর্থাৎ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করতে হবে। আমদানি শুল্কের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে প্রত্যক্ষ করের দিকে নজর দিতে হবে এখন হতেই। এছাড়া সম্প্রতি প্রকাশিত হাউজ হোল্ড ইনকাম অ্যান্ড এক্সপেন্ডিচার সার্ভে ২০২৩ রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে দেশে ধনী দরিদ্র বৈষম্য অনেক বেড়েছে। তা কমানোর জন্য ধনীদের ওপর উচ্চ হারে কর ধার্য করে সেখানে হতে প্রাপ্ত অর্থ দরিদ্র বান্ধব কার্যক্রমে ব্যয় করা যেতে পারে। এছাড়া কর আদায় বাড়ানোর জন্য কয়েকটি কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে : এক. করদাতা সংখ্যা বৃদ্ধির লক্ষ্যে আয়কর বিভাগের সম্প্রসারণ; দুই. কর ফাঁকি রোধে বাছাই করা কর নথি বাধ্যতামূলক অডিটের আওতায় আনা, তিন. উৎসে কর্তিত আয়কর-বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের আদায় করা ভ্যাট যথাযথভাবে সরকারি তহবিলে জমার বিষয়টি সুনিশ্চিত করা, চার. কর অব্যাহতি দেওয়ার সংস্কৃতি হতে বের হওয়া, পাঁচ. কর রিটার্ন দাখিল, মামলা নিষ্পত্তি ও কর আদায়ে ডিজিটাল প্রযুক্তির বহুল ব্যবহার নিশ্চিত করা। @# : একদিকে যুদ্ধ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আসন্ন বাজেটে কোন কোন বিষয়কে অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন? মাহবুব আহমেদ : গত কয়েক বছর ধরেই একটা অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বাজেট দিতে হচ্ছে। কোভিড, কোভিড-উত্তর ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ, মূল্যস্ফীতি ও নতুন করে প্রায় বিশ্ব মন্দা পরিস্থিতি। এসব বিষয় বিবেচনা করে আমাদের মতো একটি উন্নয়নশীল দেশে সব কূল রক্ষা করে সঠিকভাবে অগ্রাধিকার ঠিক করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। গত বছর পরামর্শ মোতাবেক মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণকে প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করে বাজেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য পুরোপুরি কার্যকর হয়নি। বর্তমান মূল্যস্ফীতির মূল উৎস বিদেশে। কারণ আমাদের ভোগ্যপণ্য আমদানি নির্ভর। বহির্বিশ্বে মূল্যবৃদ্ধি এবং মুদ্রা বিনিময় হারে ক্রমাগত ডলারের মূল্যবৃদ্ধির ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়নি। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রশাসনিক অদক্ষতা ও অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি। বাস্তব পরিস্থিতির কারণে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তা জনগণকে একটু স্বস্তি দেওয়া এ বছরের বাজেটের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত। এর জন্য প্রয়োজন হবে সঠিক মুদ্রানীতি ও তার সঠিক প্রয়োগ, চাহিদা এবং সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা, দক্ষতার সঙ্গে বাজার মনিটরিং। তবে কোনো অবস্থায় প্রবৃদ্ধিতে পুরোপুরি অবজ্ঞা করা ঠিক হবে না। কারণ এর সঙ্গে কর্মসৃজন ও দরিদ্র বিমোচনের সম্পর্ক রয়েছে। মূল্যস্ফীতির হার ও জিডিপি প্রবৃদ্ধি হারের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে বাজেট প্রণয়ন যথাযথ হবে। @# : ব্যাংক ব্যবস্থা হতে অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ বেসরকারি খাতের বিনিয়োগে কোনো প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবে কিনা? মাহবুব আহমেদ : সার্বিক অর্থে আমাদের ঋণ জিডিপি অনুপাত খুব একটা বেশি নয়। তবে পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ হতে দেখা গেছে, আগামী বাজেটে ঘাটতি দাঁড়াবে ২ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকা। এরমধ্যে ১ লাখ ৩৬ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করা হবে ব্যাংক থেকে। অর্থাৎ ব্যাংক ঋণ বর্তমান বৎসরের তুলনায় প্রায় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। আগামী বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে ৭.৫%। এর জন্য প্রয়োজন হবে বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ। অন্তত জিডিপির ৩২-৩৩ শতাংশ। অর্থাৎ বিনিয়োগও প্রায় ৩৩ শতাংশ বাড়াতে হবে। এর সিংহভাগ হবে বেসরকারি খাতে। এ বিপুল পরিমাণ অর্থ আসবে কোথা হতে? অভ্যন্তরীণ সঞ্চয়ের হার গত দুই বছরে (অর্থবছর-২২ এবং ২১) ছিল যথাক্রমে ২১.৫৬ এবং ২৫.৩৪ শতাংশ। উল্লিখিত সময়ে অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় কমেছে ৪.৫ শতাংশ। যদিও বিনিয়োগ বেড়েছে ১৫.০৬ শতাংশ। অর্থাৎ অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও বিনিয়োগের পার্থক্য জিডিপির অনুপাত হিসাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে মাইনাস ৫.৬৮ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরে মাইনাস ১০.১২ তে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুদের হার মুদ্রাস্ফীতির হার অপেক্ষা কম থাকায় এবং জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে সঞ্চয়ের হার বেশ কমে গেছে। সুদের হার বৃদ্ধি পেলে এবং মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হলে সঞ্চয় বৃদ্ধি পেতে পারে। কিন্তু বিদ্যমান অবস্থায় ব্যাংক থেকে অধিক মাত্রায় ঋণ গ্রহণ করা হলে ব্যক্তি খাতে বিনিয়োগের জন্য মূলধন প্রাপ্তিতে সমস্যা হতে পারে। অপরদিকে কৃষি ভর্তুকি অব্যাহত রাখতে হবে। তবে অন্যান্য খাতের ভর্তুকি ক্রমান্বয়ে কমিয়ে আনতে হবে। @# : এই মুহূর্তে সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জগুলো কি? মোকাবিলার জন্য কি পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে? মাহবুব আহমেদ : সমষ্টিক অর্থনীতির মৌলিক চ্যালেঞ্জ হচ্ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধির হার দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখা এবং প্রবৃদ্ধির ফলাফল উৎপাদনের উপকরণের মধ্যে ন্যায্যভাবে বণ্টন করা। কাঠামোগত পরিবর্তন ব্যতীত দুই থেকে চার বছরের বাজেটের মাধ্যমে এই জাতীয় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ইনক্লুসিভ গ্রোথের নীতি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। তবে এই মুহূর্তের সামষ্টিক অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ এবং তা মোকাবিলায় আশু করণীয় হচ্ছে : এক. রপ্তানি বাজারকে ধরে রাখা এবং বাজার বহুমুখীকরণ ও পণ্য বহুমুখীকরণকে গত বছরের ন্যায় উৎসাহ দেওয়া। দুই. আমদানিকে এমন ভাবে সংযত রাখা যাতে করে প্রয়োজনীয় দ্রব্য এবং কাঁচামাল আমদানি ব্যাহত না হয়, তিন. হুন্ডির প্রতিরোধ করে রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক সুস্থ ধারায় ফিরে আনা, চার. ব্যয় এমন ভাবে সংকোচন করা যাতে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত না হয়, পাঁচ. ব্যাংক ও আর্থিক খাতের ব্যবস্থাপনায় উন্নতি ঘটানো, ছয়. উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির মাধ্যমে উৎপাদন বৃদ্ধি, সাত. অভ্যন্তরীণ উৎস হতে রাজস্ব বৃদ্ধি, আট. মূল্যস্ফীতি হ্রাসের মাধ্যমে জনজীবনে স্বস্তি নিয়ে আসা। @# : ব্যয় বরাদ্দের ক্ষেত্রে এ বৎসর কোন কোন খাতকে অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? মাহবুব আহমেদ : বাজেটে সব খাতই বরাদ্দ পাবে। তবে এ বছর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া উচিত কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক নিরাপত্তা খাত ও গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণকে। এক কথায় এ বছরের বাজেট হতে হবে কৌশলী ও দূরদর্শী। তৈরি করতে হবে অতি সতর্কতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে। প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি এবং প্রবৃদ্ধি ও বণ্টনের ক্ষেত্রে ভারসাম্য দক্ষতার সঙ্গে করতে হবে।