আলট্রাসুপার পাওয়ার প্ল্যান্টসহ বড় বড় মেগা প্রকল্প নিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরও চরম লোডশেডিংয়ে অতিষ্ঠ দেশের মানুষ। পিজিসিবি’র তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদন সক্ষমতা ২৩ হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট। তারপরও ঘণ্টায় ঘণ্টায় বিদ্যুৎ যাচ্ছে। গ্রামাঞ্চলে বিদ্যুতের জন্য চলছে হাহাকার। অনেক গ্রামে দিনে-রাতে ৩-৪ ঘণ্টাও বিদ্যুৎ থাকে না। আগে রাজধানী ঢাকা কিছুটা হলেও লোডশেডিং মুক্ত ছিল। এখন ঢাকায়ও লোডশেডিং হচ্ছে। রাতে লোডশেডিংয়ের পরিমাণ আরও বেশি। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, ৮ বা ৯ জুন বিচ্ছিন্নভাবে বৃষ্টি হতে পারে। অর্থাৎ ৭ জুন পর্যন্ত দেশের তাপমাত্রা বেশি থাকার আশঙ্কা রয়েছে। ফলে এই সময় পর্যন্ত দেশব্যাপী তীব্র লোডশেডিং থাকতে পারে। এদিকে কয়লা সংকটে আজ দেশের সবচেয়ে বড় মেগা প্রকল্প পায়রা বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে। এতে ১২শ মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন কমে যাবে। দেশব্যাপী বিদ্যুতের এ লোডশেডিংয়ে ফুঁসে উঠেছে মানুষ। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এ নিয়ে চলছে নানা ট্রল ও স্ট্যাটাস। বিদ্যুৎ গেলেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হচ্ছে ওই এলাকার বিদ্যুৎ কোম্পানি। ফেসবুকের ট্রল থেকে রেহাই পাচ্ছেন না বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীসহ বিদ্যুৎ বিভাগের শীর্ষকর্তারা। কোনো কোনো গ্রামে পল্লী বিদ্যুৎকেন্দ্রের অফিসে হামলার খবর পাওয়া গেছে। লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক শিল্পকারখানা বন্ধ করে রেখেছেন মালিকরা। শিল্প মালিকরা বলেছেন, যতবার কারখানা বন্ধ হবে ততবার কাঁচামাল ফেলে দিতে হয়। এতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। নতুন করে ফ্যাক্টরি চালু করতে ২-৩ ঘণ্টা সময় লাগে। এ কারণে অনেকে কারখানা বন্ধ রাখছেন। জানা যায়, একদিকে তীব্র গরম অপরদিকে লোডশেডিং-এই দুইয়ে মিলে মানুষ ও প্রাণীর প্রাণ ওষ্ঠাগত। শুক্রবার ছুটির দিনে অনেকেই বাসা-বাড়িতে ছিলেন। যে কারণে কিছুটা ফুরসত ছিল। কিন্তু গরমের এমনই দশা ছিল যে, ফ্যানের নিচেও ঘামতে হয়। পুকুরের পানি আর বাসার ছাদের ট্যাংকির পানি পর্যন্ত গরম ছিল। এমনকি ঘরের খাবার পানি গরম হয়ে যায়। দাবদাহে প্রায় সব বয়সের মানুষেরই নাকাল অবস্থা। তবে সবচেয়ে বেশি কষ্ট পাচ্ছে বৃদ্ধ ও শিশুরা। খেটে খাওয়া মানুষেরও ত্রাহিদশা। এই গরমে ডায়রিয়া-আমাশয়-জন্ডিসের মতো পানিবাহিত রোগের প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ঢাকার মহাখালীর আইসিডিডিআর.বিতে বেড়েছে রোগীর চাপ। ঢাকা মেডিকেল, ঢাকা শিশু হাসপাতালেও রোগী ভর্তি বেড়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই তীব্র খরতাপ অব্যাহত থাকতে পারে আরও অন্তত এক সপ্তাহ। বৃহস্পতিবারের আগে আকাশে মেঘের আনাগোনার কোনো পূর্বাভাস নেই। ফলে বৃষ্টিশূন্য দিন আরও প্রলম্বিত হবে। সেই সঙ্গে বাড়বে তাপমাত্রা। ফলে গরমের প্রকোপ আরও বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এদিকে দিনে-রাতে লোডশেডিংয়ে জনজীবন অতিষ্ঠ হলেও সরকারের হিসাব অনুযায়ী লোডশেডিং হচ্ছে সামান্য। পাওয়ার গ্রিড অব কোম্পানি বাংলাদেশের হিসাব অনুযায়ী, শুক্রবার দিনে বিদ্যুতের চাহিদা ছিল ১২৮০০ মেগাওয়াট। এ সময় উৎপাদন দেখানো হয়েছে ১২৩৪৮ মেগাওয়াট। লোডশেডিং ছিল মাত্র ৪৫১ মেগাওয়াট। অপরদিকে সন্ধ্যায় ১৪৮০০ মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে উৎপাদন দেখানো হয় ১৪৩৩৪ মেগাওয়াট। ঘাটতি মাত্র ৪৬৬ মেগাওয়াট। অথচ বেসরকারি হিসাবে সারা দেশে লোডশেডিং আড়াই হাজার থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। একই অবস্থা পিডিবির ওয়েবসাইটেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ওয়েবসাইটে গতানুগতিক তথ্য দেয় পিডিবি ও পিজিসিবি। তাদের মতে, পিডিবি যতটুকু উৎপাদন করতে পারছে ততটুকুই চাহিদা দেখায়। প্রকৃত চাহিদা কখনো ওয়েবসাইটে দেয় না। এদিকে শিল্পমালিকরা জানিয়েছেন, গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকটে দিনের অধিকাংশ সময় কারখানা বন্ধ রাখতে হচ্ছে। উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সময়মতো বিদেশে পণ্য পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রপ্তানি অর্ডার বাতিলের শঙ্কা দেখা দিয়েছে। বিদ্যুৎ খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, তাপমাত্রা না কমা পর্যন্ত ভোগান্তি কমবে না। সংশ্লিষ্টরা জানান, গরম বেড়ে যাওয়ায় এসি ও ফ্যান বেশি চলছে। পাশাপাশি সেচ মৌসুমের পিক আওয়ার চলায় বিদ্যুতের চাহিদা একলাফে অনেক বেড়েছে। উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় লোডশেডিং করতে হচ্ছে। জানা যায়, গ্রামে অর্থাৎ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাভুক্ত এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে গড়ে ২ থেকে ৩ হাজার মেগাওয়াট। লোডশেডিংয়ে বেশি নাজুক ৬৩টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি। ঢাকার বাইরে রাতে বিদ্যুৎ পরিস্থিতি খুবই খারাপ। গরমে অতিষ্ঠ মানুষ রাতে ঠিকমতো ঘুমাতে পারছেন না। অনেকে গরম সহ্য করতে না পেরে ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে যাচ্ছেন। বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে সেচ কার্যক্রম। অনেক এলাকায় সেচ কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। এতে ধানের ফলনে বড় ধরনের সংকট দেখা দিতে পারে। কৃষকরা জানিয়েছেন, এখন সেচ মৌসুমের শেষ দিক। এই সময় ফসলের খেতে পানির খুব প্রয়োজন। কিন্তু বিদ্যুৎ না থাকায় পর্যাপ্ত পানি দিতে পারছেন না তারা। এ কারণে ফলনেও এর বিরূপ প্রভাব পড়বে। বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, গ্যাস ও জ্বালানি তেল সংকটে শুক্রবার ৪ হাজার ১৫৬ মেগাওয়াট এবং কেন্দ্র মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য ২ হাজার ৬৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়নি। বাংলামোটরের বাসিন্দা আজমল হোসেন বলেন, বৃহস্পতিবার রাতে ৩-৪ বার বিদ্যুৎ গেছে। সারা রাত ঘুমাতে পারেননি। গরমের কারণে জেগে থাকতে হচ্ছে। রাতে জেগে থাকার পর সকালে অফিস করাটা অনেক কষ্টের। এছাড়া বিদ্যুৎ না থাকায় সকালে বাসায় পানি থাকে না। আদাবরের বাসিন্দা ইকবাল করিম বলেন, শুক্রবার ছুটির দিনেও সকাল ৭টা থেকে দুপুর ১টার মধ্যে ৪ বার বিদ্যুৎ গেছে। প্রচণ্ড গরমে তার এক বছরের বাচ্চা অসুস্থ হয়ে গেছে। একই অবস্থা উত্তরা, মোহাম্মদপুর, বাড্ডা, মিরপুর ও যাত্রাবাড়ী এলাকার বাসিন্দাদের। মোহাম্মদপুর শেখেরটেক বাসিন্দা কাজী হাফিজ বলেন, ‘গভীর রাতেও বিদ্যুৎ চলে যাচ্ছে। বাচ্চাদের নিয়ে কষ্টে আছি। একদিকে মশা, অন্যদিকে লোডশেডিং-সব মিলিয়ে একটি সংকটে আছি।’ নারায়ণগঞ্জের বাসিন্দা হারুনুর রশিদ জানান, এক সপ্তাহ ধরে লোডশেডিং বেড়েছে। শুক্রবারও দফায় দফায় বিদ্যুৎ গেছে। সামনে বাচ্চাদের পরীক্ষা। এভাবে চললে বড় ক্ষতি হয়ে যাবে। খরতাপে পুড়ছে দেশের উত্তর জনপদ : দিনাজপুর প্রতিনিধি জানান, খরতাপে পুড়ছে দিনাজপুরসহ দেশের উত্তর জনপদ। অব্যাহত তীব্র দাবদাহে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে উত্তরের জনজীবন। দিনাজপুর আঞ্চলিক আবহাওয়া অফিসের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান জানান, শুক্রবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আগের দিন ছিল চলতি মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪১ ডিগ্রি। তিনি জানান, গত কয়েক দিন ধরেই দিনাজপুরসহ এই অঞ্চলের তাপমাত্রা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। ২৯ মে দিনাজপুরে তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস, ৩০ মে মঙ্গলবার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়ে দাঁড়ায় ৩৮ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। বুধবার দিনাজপুরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৯ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। আবহাওয়াবিদদের মতে, কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা ৩৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস হলে, সেটাকে বলে মৃদু দাবদাহ, ৩৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস পেরিয়ে গেলে ধরা হয় মাঝারি দাবদাহ। আর তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস অতিক্রম করলে বলা হয় তীব্র দাবদাহ। দিনাজপুরে এখন বিরাজ করছে তীব্র দাবদাহ। দিনাজপুরের বিরল উপজেলার রাজারামপুর গ্রামের প্রদীপ চন্দ্র রায় জানান, বেশিরভাগ সময়ে বিদ্যুৎ না থাকায় তীব্র এই গরমে বাড়িতে থাকা যাচ্ছে না। গাছতলায়ও স্বস্তি নেই। গরম বাতাসে শরীর জ্বালাপোড়া করছে। শহরের ঘাসিপাড়া এলাকার সবুজ আলী জানান, জরুরি প্রয়োজনে ছাতা নিয়ে বের হলেও স্বস্তি নেই। পিচঢালা রাস্তা ও গরম বাতাসে যেন মুখ ও শরীর ঝলসে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।