মৌসুমি বায়ুর বিস্তার না ঘটায় দেশের ওপর দিয়ে অব্যাহতভাবে বয়ে যাচ্ছে মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ। সাত দিন ধরে প্রচণ্ড গরমে পুড়ছে দেশের বিভিন্ন এলাকা। বৃষ্টির কোনো লক্ষণ নেই। মে মাসের শেষভাগ থেকে শুরু হওয়া এই তাপপ্রবাহ আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন অব্যাহত থাকতে পারে বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর। এদিকে, রোববার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে রাজশাহীতে ৪১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আর রাজধানী ঢাকায় রেকর্ড করা হয়েছে ৩৭ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রাজধানীসহ সারা দেশে গত এক সপ্তাহ ধরে জ্যৈষ্ঠের দহনে পুড়ছে দেশের মানুষ। দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে জনজীবন। প্রচণ্ড গরমে দেশের প্রতিটি শ্রেণি-পেশার মানুষের অবস্থা শোচনীয়। এতে বাড়ছে গরমজনিত বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি। ধনী লোকেরা এসি ঘরে থাকলেও নিম্ন শ্রেণি থেকে প্রান্তিক লোকজন একটু ছায়া পেতে চান। কিন্তু শহরে বড় গাছপালা না থাকায় ছায়াও মিলছে না। প্রখর সূর্যতাপে কাবু মানুষ, তারপরও জীবন-জীবিকার তাগিদে নামতে হচ্ছে রাস্তায়। রাজধানীর মহাখালী এলাকায় কথা হয় মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অর্থ আয় করা বেশ কয়েকজন রিকশাওয়ালার সঙ্গে। তারা জানান, শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষায় তাদের শরীরের ঘাম শুকায় না। কিন্তু গরমকালে তাদের ভোগান্তি হয় অনেক বেশি। গত কয়েকদিন ধরে প্রখর রোদ পড়ছে। অতিরিক্ত গরমে তাদের অবস্থা খারাপ যাচ্ছে। রিকশা চালাতেও কষ্ট হচ্ছে। কিন্তু সংসার চালাতে গিয়ে রোদের তাপ উপেক্ষা করেই বের হতে হয়। সাতরাস্তা এলাকার বাসিন্দা নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘গরমে ঘরের ভেতর টেকা যায় না। বাইরে এলেও তাপে চামড়া পুড়ে যায়। দিন-রাত ফ্যান চালু রেখেও গরম থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়েছে। সব জায়গায় খাঁ-খাঁ রোদ। ঘরে-বাইরে কোথাও স্বস্তি নেই।’ অন্যদিকে আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট চরমভাবাপন্ন আবহাওয়া অসময়ে খরা, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য দায়ী। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সাম্প্রতিককালে কমে গেছে ঝড়-বৃষ্টির হার। বছরের বেশিরভাগ সময়ই উত্তপ্ত থাকছে মাটি। বইছে তীব্র দাবদাহ। এতে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি ভবিষ্যতে এই তাপপ্রবাহ থেকে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি বিশেষ করে খাদ্য উৎপাদন মারাত্মকভাবে ব্যাহত হওয়ার শঙ্কাও জোরালো হচ্ছে। অতিরিক্ত তাপপ্রবাহে এরই মধ্যে বিপর্যস্ত হয়েছে আফ্রিকার অনেক দেশ। প্রতিবেশী দেশ ভারতের কিছু রাজ্যেও এ সংকট চলমান। আর এরকম কিছু যে বাংলাদেশেও হবে না সেটা বলা যায় না। তাই সচেতনতার পাশাপাশি তাপপ্রবাহ মোকাবিলায় সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণের তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের বিশেষজ্ঞরা চলমান তাপপ্রবাহের তিন কারণ দেখছেন। এর একটি সাম্প্রতিক ঘূর্ণিঝড় মোখা। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম সম্প্রতি একটি সংবাদমাধ্যমে বলেছেন, ‘সাইক্লোন মোখার কারণে বৃষ্টিপাত কম হচ্ছিল। ফলে ভারত-বাংলাদেশে তাপমাত্রা বেশি। মোখার সময় এই পুরো বেল্ট ওভারহিটেড হয়ে যায়। এটা একটা কারণ।’ তিনি জানান, মোখার প্রভাবে এখনো ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহারে অতিরিক্ত তাপমাত্রা বিরাজ করছে। আর তা থেকে লু হাওয়া বইছে বাংলাদেশের দিকে। বজ্রঝড় কমে যাওয়াও তাপপ্রবাহের অন্যতম কারণ। বৃষ্টিপাত না হলে গরমের তীব্রতা কমার সম্ভাবনা কম বলে জানিয়েছে আবহাওয়া অফিস। বৃষ্টি কম হওয়ায় মাটির নিচের পানিস্তর ধীরে ধীরে আরও নিচে নেমে যাচ্ছে। এতে কম গভীরতার নলকূপে পানি উঠছে না। এর মধ্যে আবার বাড়ছে ডায়রিয়ার আশঙ্কা। সব মিলিয়ে জনজীবন শঙ্কাময় সময় কাটাচ্ছে। তীব্র গরমের মধ্যে আরেক ভোগান্তি যানজট। এই সংকটের কারণে রাজধানীর মানুষ নাকাল। রোববার রাজধানীর বিজয়নগর, মৎস্য ভবন ও পল্টন থেকে সদরঘাট পর্যন্ত তীব্র যানজট দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বাসে বসে থেকে অপেক্ষা করতে করতে মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে যায়। তারা হাঁটতে শুরু করেন। মাথার ওপর জ্বলন্ত সূর্য, পায়ের নিচে উনুনের তাপ- মানুষকে অসুস্থ করে দিচ্ছে। তারপরও এ শহরের ভোগান্তি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে অফিস ও ঘরমুখো মানুষকে। এর মধ্যে আবহাওয়ার সবশেষ পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলা তাপপ্রবাহ আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন অব্যাহত থাকতে পারে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা বলছেন, তাপপ্রবাহের সৃষ্টি হয় বাতাস আটকে যাওয়ার (ট্র্যাপড এয়ার) কারণে। কোনো অঞ্চলে বাতাস আটকে গেলে সূর্য তাপে সে বাতাস আরও গরম হতে থাকে। আবার কোনো কোনো অঞ্চলের উচ্চ চাপের বাতাস সে অঞ্চলেই আটকে গিয়ে গরম হয়ে যায়। দেখা যায় গরম থেকে বাঁচার জন্য শহরাঞ্চলে এয়ারকন্ডিশনিং সিস্টেম ব্যবহার করে আরাম অনুভব করে। ঘরের ভেতরে এয়ার কন্ডিশনিং সিস্টেম তাপমাত্রাকে নিচে নামিয়ে রাখলেও কুলিং মেশিন বাইরের তাপমাত্রাকে বাড়িয়ে দেয়। রোববার সকাল ৯টায় আবহাওয়া অধিদপ্তর আগামী ২৪ ঘণ্টার আবহাওয়ার পূর্বাভাসে দেশের ৪৪টি স্টেশনের আবহাওয়ার পরিস্থিতি তুলে ধরে জানিয়েছে, এসব স্টেশনের মধ্যে ৩১টিতেই মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে চলেছে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রাজশাহী, নওগাঁ, নীলফামারী ও দিনাজপুর জেলার ওপর দিয়ে তীব্র তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। ঢাকা, ময়মনসিংহ, খুলনা, বরিশাল বিভাগসহ রংপুর ও রাজশাহী বিভাগের অবশিষ্টাংশ এবং মৌলভীবাজার, চাঁদপুর ও নোয়াখালী জেলার ওপর দিয়ে মৃদু থেকে মাঝারি তাপপ্রবাহ বয়ে যাচ্ছে। এই তাপপ্রবাহ আরও চলতে পারে। এছাড়া দিন ও রাতের তাপমাত্রা প্রায় অপরিবর্তিত থাকতে পারে। আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, ‘আগামী পাঁচ থেকে ছয় দিন এমন মৃদু থেকে তীব্র তাপপ্রবাহ থাকতে পারে। বাতাসে জলীয়বাষ্প বেশি থাকার জন্য গরমের অনুভূতিও বেশি হতে পারে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এখন মৌসুমি বায়ু আসার সময়। সাধারণত ৩১ মের মধ্যে এটি উপকূলের টেকনাফ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। এরপর তা বিস্তার লাভ করে। কিন্তু এবার আসতে দেরি হচ্ছে। তবে এবারই যে এমন হচ্ছে তা নয়। গত বছর ২৩ জুন থেকে মৌসুমি বায়ু বিস্তার লাভ করে। এর আগের বছর ছিল ১৪ জুন। ২০১৫ সালের পর থেকে জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর মৌসুমি বায়ু বিস্তার লাভ করছে।’ আবহাওয়ার বার্তা অনুযায়ী, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের দুই-এক জায়গায় অস্থায়ীভাবে দমকা হাওয়াসহ বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। এ ছাড়া দেশের অন্যত্র অস্থায়ীভাবে আংশিক মেঘলা আকাশসহ আবহাওয়া প্রধানত শুষ্ক থাকতে পারে।