দেশে গ্রীষ্মকালে চাহিদার তুলনায় বিদ্যুতের উৎপাদন এমনিতেই দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট কম। এর ওপর জ্বালানি সংকটে পায়রাসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ ও উৎপাদন কমে যাওয়ায় এ সংকট এখন আরও গভীর। গত কয়েকদিন ধরে সারা দেশে দাবদাহ বয়ে যাওয়ায় তা ‘গোদের উপর বিষফোড়া’ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলে প্রতিদিনই পাল্লা দিয়ে লোডশেডিং বাড়ছে। এতে শিল্প, কল-কারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, কৃষি, শিক্ষা, চিকিৎসা খাতের পাশাপাশি সাধারণ মানুষের নিয়মিত কর্ম সিডিউল এলোমেলো হয়ে পড়েছে। শিল্প, কল-কারখানার উৎপাদন এরই মধ্যে ৩০ শতাংশ কমেছে। ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা দেখা দিয়েছে। কৃষি কাজ চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে। সময়সূচি মেনে শিক্ষা ও চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। দিনের পাশাপাশি রাতের কয়েক দফা লোডশেডিং সাধারণ মানুষের রাতের ঘুম কেড়ে নিয়েছে। রাতভর গরমে জেগে থেকে অনেকে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ছে। এতে কর্মজীবী মানুষ সময়মতো কর্মস্থলে যেতে ব্যর্থ হচ্ছেন। ঘুম কামাই করে অনেকে নির্ধারিত সময় কাজে যোগ দিলেও নিদ্রাজনিত ঝিমুনির কারণে স্বাভাবিকভাবে কাজকর্ম করতে পারছেন না। ফলে পরিকল্পনা মাফিক প্রায় কোনো কাজই এখন সুষ্ঠুভাবে হচ্ছে না। শনিবার দুপুরে রামপুরা হাজীপাড়া, সবুজবাগ, মানিকনগর, সায়েদাবাদ ও মালিবাগসহ রাজধানীর প্রায় এক ডজন ফিলিং স্টেশন ঘুরে দেখা গেছে, তেল-গ্যাস নিতে সবখানেই দীর্ঘ যানবাহনের সারি। গাড়িচালকরা জানান, সাধারণ সময়ে তেল-গ্যাস নিতে ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লাগলে এখন লাগছে ৪০-৪৫ মিনিট, এমনকি কখনো কখনো এক দেড় ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। পাম্প মালিক-কর্মচারীরা জানান, কয়েক ঘণ্টা পর পর লোডশেডিং হওয়া স্বাভাবিক বলে তারা গাড়িতে জ্বালানি সরবরাহ করতে পারছেন না। লোডশেডিংয়ের সময় গাড়িতে তেল-গ্যাস নিতে না পারায় গাড়ির চাপের প্রভাব দিনভরই থাকছে। এতে তাদের বেচাবিক্রিতে যেমন ধস নেমেছে, তেমনি গাড়িচালকদের ভোগান্তি বেড়েছে। বিকাল সাড়ে ৩টার দিকে হাজীপাড়া ফিলিং স্টেশনে আলম ট্রেডার্সের গাড়িচালক মোজাম্মেল হোসেন এ প্রতিবেদককে জানান, গাড়িতে গ্যাস ভরে রামপুরা থেকে মালিককে নিয়ে কাঁচপুরে একটি ফ্যাক্টরিতে যাওয়ার কথা। সেখানে বিকাল ৪টায় তার একটি পূর্বনির্ধারিত মিটিং ছিল। অথচ বিদ্যুৎ না থাকার কারণে এক ঘণ্টারও বেশি সময় অপেক্ষা করেও গাড়িতে গ্যাস ভরতে পারেননি। বিষয়টি মালিককে জানানোর পর তিনি তার সিডিউল মিটিং বাতিল করেছেন। মালিবাগের এস কে গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপক আব্দুর রাজ্জাক জানান, সাব-কন্ট্রাকের কাজের চাপ থাকায় তারা কারখানা শ্রমিকদের কাজের সময় দুই ঘণ্টা বাড়িয়েছেন। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে ওভারটাইম দিয়েও কাজের সিডিউল ঠিক রাখতে পারছেন না। নির্ধারিত সময়ে যে পরিমাণ প্রোডাকশন হওয়ার কথা তার এক তৃতীয়াংশ কম হচ্ছে। সময়মতো কাজ তুলতে না পারলে তাদের বড় ধরনের লোকসান হবে। পাশাপাশি সাব-কন্ট্রাক্ট কাজ পাওয়াও কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। পিডিবি সূত্রে জানা গেছে, চলমান বিদ্যুৎ সংকটের সহসাই সমাধান হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তাপমাত্রা কমলে বিদ্যুতের চাহিদা কিছুটা কমবে। তবে তা লোডশেডিং কমার ক্ষেত্রে তেমন বড় কোনো ভূমিকা রাখবে না। দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা জানান, জ্বালানির অভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা পূর্ণ ক্ষমতায় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো পরিচালনা করতে পারছেন না। তাই এ সংকট মেটানো না গেলে লোডশেডিং আশানুরূপভাবে কমিয়ে আনা অনেকটাই অসম্ভব। তথ্য অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমানে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে সংযুক্ত দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে দৈনিক সাড়ে ১৫ হাজার থেকে ১৬ হাজার মেগাওয়াট চাহিদার বিপরীতে ২৪ হাজার ১৪৩ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু দেশে উৎপাদন হচ্ছে ১৪ হাজার থেকে সাড়ে ১৪ হাজার মেগাওয়াটের মতো। ফলে চাহিদার তুলনায় দৈনিক দেড় থেকে দুই হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি থেকে যাচ্ছে। দেশে প্রবহমান দাবদাহের কারণে যা আরও কিছুটা বেড়েছে। কম উৎপাদনের কারণে বিতরণ কোম্পানিগুলো এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংয়ের মাধ্যমে বিদ্যুতের এই ঘাটতি সামাল দেওয়ার চেষ্টা করছে। এদিকে বিদ্যুতের চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে বিভিন্ন জায়গায় ওয়াসার পানি সরবরাহের সিডিউল এলোমেলো হয়ে গেছে। এমনিতে নগরীতে রয়েছে তীব্র পানির সংকট। তীব্র গরমে তা আরও ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। এর ওপর সরবরাহ সিডিউল ভেঙে পড়ায় নগরীর বিভিন্ন এলাকায় পানির হাহাকার দেখা দিয়েছে। বিভিন্ন উৎস থেকে পানির চাহিদা মেটাতে গিয়ে নগরবাসী যেমন আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে, তেমনি দৈনন্দিন কাজের সিডিউল ঠিক রাখতেও ব্যর্থ হচ্ছে। এসব ভোগান্তির কথা স্বীকার করে ওয়াসার একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, এমনিতেই গ্রীষ্মকালে পানির সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। এর ওপর ভয়াবহ লোডশেডিংয়ের কারণে পানি সমস্যা আরও বেশি ঘনীভূত হয়েছে। কারণ লোডশেডিংয়ে পানি উৎপাদনে যেমন ব্যাঘাত ঘটছে, তেমনি সরবরাহের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হচ্ছে সংকট। ফলে সিডিউল ঠিক রাখা যাচ্ছে না। পানি সরবরাহকালে কোনো এলাকা এক ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কবলে পড়লে সে এলাকার মানুষ পানি সরবরাহ কম পান। এর পরও সব এলাকায় যাতে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা স্বাভাবিক রাখা যায় তার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নতি না হলে শিগগিরই পানি সরবরাহের সিডিউল ঠিক হওয়ার খুব একটা আশা নেই বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। এদিকে, ভয়াবহ লোডশেডিংয়ে শিল্প কারখানার উৎপাদন সিডিউল ভেঙে পড়ার বিস্তর তথ্য পাওয়া গেছে। এ অবস্থা চলমান থাকলে রপ্তানি খাতে বড় ধরনের ধস নামবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেন রপ্তানিমুখী শিল্প কারখানার মালিকরা। তাদের ভাষ্য, প্রোডাকশন সিডিউল ঠিক রেখেও সময়মতো বিদেশে পণ্য পাঠানোও অনেক সময় কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ লোডশেডিংয়ের কারণে বেশ কিছুদিন ধরে প্রোডাকশন সিডিউলই ঠিক রাখা যাচ্ছে না। সিডিউল অনুযায়ী শিপমেন্ট করতে না পারার কারণে বিপুল পরিমাণ মাল উড়োজাহাজে বিদেশে পাঠাতে হবে। এতে শিল্প কারখানার মালিকদের মোটা অঙ্কের আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ার শঙ্কা জোরালো হয়ে উঠেছে। লোডশেডিংয়ে প্রোডাকশন সিডিউল বিপর্যয় প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) কার্যকরী কমিটির নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম জানান, ‘লোডশেডিং মানেই আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হবে। তবে পরিকল্পিত এক-দুই ঘণ্টা লোডশেডিং হলে তা ম্যানেজেবল। সেটা আমরা ম্যানেজ করতে পারি। তবে ঘন ঘন লোডশেডিং হলে সেটা আমাদের জন্য সমস্যা। আর এখানে বিদ্যুতের চেয়ে আমাদের বড় যে সমস্যা হচ্ছে গ্যাস সংকট। লোডশেডিং ঘণ্টা দুয়েক ম্যানেজ করা গেলেও গ্যাস সংকট ম্যানেজ করা যাচ্ছে না। ফলে আমাদের উৎপাদন সিডিউল এলোমেলো হয়ে গেছে। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রপ্তানি। আমাদের সিডিউল ঠিক থাকছে না, এয়ার শিপমেন্ট করতে হচ্ছে। সেই সঙ্গে মার্কেট বাড়াবার যে সুযোগ তৈরি হয়েছিল, তাও আমাদের হাতছাড়া হচ্ছে।’ এদিকে ঘন ঘন বিদ্যুৎ আসা-যাওয়ার কারণে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার সিডিউলও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে। বিশেষ করে যেসব শিক্ষার্থী অনলাইনে কোচিংসহ বিভিন্ন পাঠ গ্রহণ করেন তাদের পড়াশোনা শিঁকেয় উঠেছে। অনলাইন ক্লাসের সময়সূচি বারবার পরিবর্তন করেও কোনো কাজ হচ্ছে না। ভিকারুননিসা নূন স্কুলের একজন শিক্ষিকা জানান, তিনি সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে অনলাইনে ১০-১২ জন ছাত্রীকে কোচিং করান। কিন্তু সপ্তাহখানেক ধরে এ সিডিউল কোনোভাবেই ঠিক রাখতে পারছেন না। ক্লাসের নির্ধারিত সময় প্রায়ই তার এলাকায় লোডশেডিং হচ্ছে। এতে ইন্টারনেট কানেকশন থাকছে না। আবার তার বাসায় বিদ্যুৎ থাকলেও শিক্ষার্থীদের বাসায় বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে অনলাইন ক্লাসের সিডিউল মেলানো কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ পরিস্থিতিতে তিনি কোচিং করানো বন্ধ করে দেওয়ার চিন্তাভাবনা করছেন। তবে এইচএসসি পরীক্ষার্থী এসব শিক্ষার্থীর সমস্যার কথা বিবেচনা করে তা তিনি করতে পারছেন না। এদিকে বিদ্যুতের লুকোচুরির কারণে চিকিৎসা ব্যবস্থার সিডিউল ঠিক রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে বলে জানান চিকিৎসকরা। তাদের ভাষ্য, রোগীর চিকিৎসাপত্র দিতে অনেক সময় জরুরি ভিত্তিতে কিছু প্যাথলজিক্যাল টেস্ট করাতে হয়। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কারণে অনেক সময় তা সম্ভব হচ্ছে না। জরুরি টেস্টের জন্য অনেক সময় দেড় দুই ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হচ্ছে। এতে তাদের সিডিউলও এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে বলে জানান চিকিৎসকরা।