সন্দেহজনক লেনদেন ৮৩৫২

প্রকাশিতঃ জুন ১০, ২০২৩ | ৬:৫৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

বৈদেশিক বাণিজ্য ও রেমিট্যান্সের অন্তরালে বাড়ছে অর্থ পাচার-এমন শঙ্কা সংশ্লিষ্টদের। কারণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে চলতি অর্থবছরে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮ হাজার ৩৫২টি সন্দেহজনক লেনদন শনাক্ত হয়েছে। এটি নিশ্চিত করতে গ্রাহকের আড়াই কোটির বেশি নগদ লেনদেন (সিটিআর) তল্লাশি করতে হয়। পাশাপাশি রেমিট্যান্সের অর্থ হুন্ডির মাধ্যমে পাচারের সন্দেহে ৫ হাজার ৭৬৬ মোবাইল ব্যাংকিং (এমএফএস) এজেন্টের তথ্য দেওয়া হয়েছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার হাতে। এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে। আর প্রাথমিকভাবে হুন্ডির অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ইতোমধ্যে ফ্রিজ করা হয়েছে ৬ হাজার ৯৬৭টি মোবাইল ব্যাংক হিসাব। অর্থ বিভাগের এক প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে মানি লন্ডারিং (অর্থ পাচার) ও সন্ত্রাসীকার্যে অর্থায়ন প্রতিরোধসংক্রান্ত এসব কার্যক্রম। খবর সংশ্লিষ্ট সূত্রের। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, উল্লিখিত সন্দেজনক লেনদেনের মধ্যে পৃথকভাবে ৪০টির প্রয়োজনীয় তদন্ত সম্পন্ন করে প্রতিবেদন তৈরি করেছে বাংলাদেশ আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট (বিএফআইইউ)। এগুলোর আরও অধিকতর তদন্ত করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নিতে বলেছে সংস্থাটি। এছাড়া অনলাইন গেম, বেটিং ও অবৈধ ফরেক্স ট্রেডিং পরিচালনাকারী ৪৯৭টি ওয়েবসাইট, ২১২টি ফেসবুক পেজ ও ১২০টি মোবাইল অ্যাপস শনাক্ত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নিতে বলা বলা হয়েছে। অর্থ বিভাগের প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, মানি লন্ডারিং ও সন্ত্রাসীকার্যে অর্থায়নের তথ্যাদি চেয়ে এরই মধ্যে বিশ্বের ৫২ দেশে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। একইভাবে বাংলাদেশের কাছেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ সম্পর্কে তথ্য চেয়ে ১৫টি দেশ অনুরোধপত্র পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সন্দেহজনক লেনদেনগুলোর ব্যাপারে ধারণা করা হচ্ছে অর্থ পাচার ছাড়াও সন্দেহজনক আরও ২৭টি ক্যাটাগরির অপরাধ সংঘটিত হতে পারে। তবে বিস্তারিত তদন্ত শেষে সুনির্দিষ্টভাবে যেসব লেনদেনে অপরাধ সংঘটিত হওয়ার প্রমাণ মিলবে সেসব লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাংলাদেশে ব্যাংক থেকে এ রকম নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থাগুলোকে। জানা গেছে, এর আগের অর্থবছর (২০২১-২২) একই সময়ে সন্দেহজনক লেনদেন শনাক্ত সংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৩১২টি। ওই বছর ২ কোটি ৩২ লাখ ১৭ হাজার ৩১৫টি নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) বিএফআইইউতে আসে। আর ২০২০-২১ অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১ কোটি ৩৩ লাখ ৫৮ হাজার ৬৪৬টি লেনদেন তল্লাশি করা হয়। ওই অর্থবছরে সন্দেহজনক হিসাবে ৫ হাজার ২৮০টি লেনদেন শনাক্ত হয়। এছাড়া ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ হাজার ৬৭৫ এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেন ধরা পড়ে ৩ হাজার ৫৭৩টি। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিটের সাবেক উপদেষ্টা দেবপ্রসাদ দেবনাথ বলেন, অর্থ পাচারসংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য পর্যালোচনার জন্য অন্য দেশের কাছে তথ্য চাওয়া হয়। অন্য দেশগুলোও আমাদের কাছে চেয়ে থাকে। অন্য দেশের আর্থিক গোয়েন্দা বিভাগের অনুমতি ছাড়া আমরা অনেক তথ্যই প্রকাশ করতে পারি না। এটি এগমন্ট গ্রুপের সদস্য দেশ হিসাবে অনেক শর্ত ও নিয়ম মেনে চলতে হয়। অফিশিয়াল প্রমাণপত্র না আসা পর্যন্ত তথ্য প্রকাশ করা যায় না। তিনি আরও বলেন, নগদ লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) বিশ্বব্যাপী হচ্ছে। এটি গ্রাহকের অ্যাকাউন্টের তথ্য পর্যালোচনার জন্য এক ধরনের সর্তক সংকেত বটে। প্রতিটি দেশই তাদের ঝুঁকি পর্যালোচনা করে। এসটিআর ঝুঁকি পর্যালোচনার একটি কৌশল। এখন সন্দেহজনক লেনদেনগুলো নিয়ে কাজ করা হয়। জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ জানান, অর্থ পাচারকারীদের তথ্য পেলে পুলিশের সিআইডি বা বিএফআইইউকে অনুসন্ধানের জন্য জানানো দরকার। দ্বিতীয় হচ্ছে, যদি শনাক্ত হয় তাহলে দেখতে হবে কোন দেশে টাকা গেছে, সে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে। আর শেষ হচ্ছে যদি আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয় সেটি অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, উন্নয়নশীল দেশ থেকে অর্থ পাচার হয়। এটা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। বাংলাদেশও উন্নয়নশীল দেশ। এখান থেকেও টাকা পাচার হচ্ছে। যে টাকা চলে যায় তা ফেরত আনা কঠিন। তিনি আরও বলেন, গোটা পৃথিবীতে পাচার হওয়া অর্থের ১ শতাংশও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। আর অর্থ পাচারের বেশিরভাগই বাণিজ্যভিত্তিক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের পরিদর্শনে বিষয়টি উঠে এসেছে। এরপর বিলাসবহুল পণ্যের এলসিতে কড়াকড়ি আরোপ করা হয়। এছাড়া এলসি খোলার ওপর তদারকি বাড়ানো হয়েছে। ফলে বর্তমানে ওভার ইনভয়েসিং হচ্ছে না। এখন নজর দিতে হবে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের দিকে। সূত্রমতে, হুন্ডির অপরাধে মোবাইল ব্যাংকিং ফ্রিজ করার অধিকাংশ হচ্ছে রেমিট্যান্সসংক্রান্ত। প্রবাসীরা ডলার পাঠাতে পারছেন না। এগুলো ব্যবহার করা হচ্ছে আন্ডার ইনভয়েসিংয়ের পেমেন্ট মেটানোর জন্য। যেহেতু রেগুলেটর এখানে তাদের মনিটরিং ও নজরদারি বাড়িয়েছে। ফলে ট্রেড বেজড মানি লন্ডারিং আগামীতে আরও কমে আসবে। এদিকে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনের সর্বশেষ কৌশলপত্রে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হয়েছে-এমন ১০টি দেশ বা অঞ্চলের নাম দেওয়া হয়েছে। এই দেশগুলো হচ্ছে-যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকং, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া, কেম্যান আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ডস। আর অর্থ পাচারের পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় ওয়াশিংটনভিত্তিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটি (জিএফআই) বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে প্রতিবছর গড়ে ৭৫৩ কোটি ৩৭ লাখ ডলার পাচার হয়। টাকার অঙ্কে তা প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা। আর সুইজারল্যান্ডের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২১ সালে দেশটির বিভিন্ন ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ সুইস ফ্রাঁ, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। অবশ্য অনেকেই মনে করেন, পাচার করা অর্থের পরিমাণ আরও বেশি হবে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম বলেন-ডলার সংকট, বৈদেশিক মুদ্রার পতন ও টাকার অবমূল্যায়ন সবকিছুর পেছনে কাজ করছে অর্থ পাচার। আন্ডার এবং অভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে চলে যাওয়া টাকা দেশে ফেরত না আনার চেয়ে অর্থ পাচার বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থ পাচারের ব্যাপারে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তৎপর হয়েছে এটি ভালো খবর। আশা করছি এ ব্যাপারে আরও কঠোর অবস্থান গ্রহণ করবে। তাহলে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট অনেকটা কাটিয়ে উঠা যাবে। তিনি আরও বলেন, দেশের বাইরে এক কোটি ৩০ লাখ প্রবাসী থাকছেন। এদের অধিকাংশই হন্ডি ব্যবহার করছেন। ফলে অবৈধ হন্ডির দায়ে মোবাইল ফাইন্যান্সিং জব্দ অ্যাকাউন্টের সংখ্যা যথেষ্ট নয়। হুন্ডি ও ডলারের চাহিদাকারী দুর্নীতিবাজ, আমলা, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে কঠোর না হলে এবং জিরো টলারেন্স সত্যিকার অর্থে ব্যবহার না করে তাহলে এ সমস্যা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে না। মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ধারা ২-এর(য) উপধারায় সন্দেহজনক লেনদেন বলতে বোঝায় ‘যাহা স্বাভাবিক এবং সাধারণ লেনদেনের ধরন হইতে ভিন্ন বা যে লেনদেন অপরাধ হইতে অর্জিত সম্পদ বা কোনো সন্ত্রাসী কার্যে, কোনো সন্ত্রাসী সংগঠনকে বা সন্ত্রাসীকে অর্থায়ন। ব্যাংকিং নিয়মে একজন গ্রাহক একটি নির্দিষ্ট দিনে তার অ্যাকাউন্টে একাধিক বা একটি লেনদেনের মাধ্যমে দশ লাখ টাকা বা তারও বেশি জমা বা উত্তোলন করলে সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের বিরুদ্ধে সিটিআর রিপোর্ট করে ব্যাংক। সারা মাসে এ ধরনের লেনদেন তালিকাভুক্ত করে একটি নির্দিষ্ট তারিখে পাঠিয়ে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে। কিন্তু কোনো গ্রাহকের ব্যাংক হিসাবে অস্বাভাবিক লেনদেন হলে সঙ্গে সঙ্গে ওই ব্যাংকের শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ে রিপোর্ট করে। পরে প্রধান কার্যালয় থেকে সেটি বিএফআইইইতে পাঠানো করা হয়। কারণ এ ধরনের অস্বাভাবিক লেনদেনকে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সন্দেহ হিসাবে দেখে।