‘অতীতের আন্দোলন ঢাকা মহানগরের কারণে ব্যর্থ হয়েছে’-এমন অভিযোগ করে আসছেন বিএনপির তৃণমূল নেতারা। সেই অভিযোগ আমলে নিয়ে এবার ঢাকা মহানগরকেন্দ্রিক আন্দোলন জোরদারের দিকে বেশি নজর দিচ্ছে দলটি। অতীত অভিজ্ঞতা থেকে নেওয়া হচ্ছে নানা পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে সমমনা দল ও জোটকেও তারা পাশে চান। যে কারণে সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়কসহ ১০ দফা দাবিতে বিএনপিসহ সমমনারা মহানগরকেন্দ্রিক কর্মসূচি বাড়িয়েছে। নেতারা মনে করছেন, ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্যেই এমন পরিস্থিতি তৈরি হবে, যার মধ্য দিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন এক লাফে নতুন পর্যায়ে নেওয়া সম্ভব হবে, যা হবে সরকার পতনের একদফা আন্দোলন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে এসব তথ্য। বিএনপি নেতারা বলছেন, এই পর্বের আন্দোলনে তারা রাজধানী ঢাকাকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছেন। চূড়ান্ত আন্দোলনে সবাইকে সর্বশক্তি নিয়ে নামাতে সাংগঠনিক নানা প্রস্তুতিও চলছে। আন্দোলন সফলে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের ইতোমধ্যে নানা নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বিএনপির সঙ্গে অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকে সমন্বয় করে প্রতিটি কর্মসূচি পালন করার নির্দেশনা রয়েছে। এছাড়া কর্মসূচি পালনে থানা কিংবা ওয়ার্ড পর্যায়ে কোনো দুর্বলতা আছে কি না, তাও নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, ‘সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে। নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে। দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের কর্মসূচি চলছে, সামনে আরও আসবে। জনগণ আমাদের সঙ্গে রয়েছে, এ দাবি তাদেরও। এবার আন্দোলন সফল হবেই।’ বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্মমহাসচিব অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘আমরা নিজেরাই ঢাকা মহানগরের দুর্বলতা আগেই অনুভব করেছি। এখন অনেকটা ওভারকাম করতে পেরেছি। সামনে বিএনপির পক্ষ থেকে আরও কিছু কর্মসূচি আসবে। যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য দল ও জোটগুলোর পক্ষ থেকেও আসবে। যাতে ফাইনাল কলটা দেওয়ার সময় আগের মতো আমাদের পেছনে পড়তে না হয়। এ কারণেও ঘনঘন কর্মসূচি আসছে, সামনেও আসবে।’ ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, ‘ঢাকা মহানগর এখন অনেক শক্তিশালী। নেতাকর্মীরাও ঐক্যব্ধ রয়েছেন। কর্মসূচিতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মীর উপস্থিতিই তা প্রমাণ করে। আগামী দিনের যে কোনো কর্মসূচি সফলে আমরা প্রস্তুত রয়েছি।’ সূত্রমতে, আন্দোলনের এই পথ ধরে সরকার পতনের একদফার আন্দোলনে যেতে চাইছে দলটি। এই মুহূর্তে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের লক্ষ্য-ধারাবাহিক কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কেন্দ্র থেকে মাঠের কর্মী-সমর্থক পর্যন্ত আন্দোলনের একটি ঢেউ তৈরি করা। বিশেষ করে গত নভেম্বর-ডিসেম্বরে সারা দেশে বিভাগীয় গণসমাবেশগুলোকে কেন্দ্র করে নেতাকর্মীদের মধ্যে যেরকম মরিয়া মনোভাব দেখা গেছে, আবার সেরকম আন্দোলনমুখী পরিবেশ সৃষ্টি করতে চান বিএনপির নীতিনির্ধারকরা। তারা মনে করছেন, ১০ ডিসেম্বর ঢাকার সমাবেশ ঘিরে যেরকম রাজনৈতিক উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, কোনো একটা প্রেক্ষাপটে যে কোনো সময় সেরকম একটা পরিস্থিতি তেরি হয়ে যাবে। আর তখনই কর্মীদের সর্বশক্তি নিয়ে মাঠে নামানোর প্রস্তুতি নিচ্ছে দলটি। সূত্রমতে, আগামী দিনে ঢাকা মহানগরে ধারাবাহিক কর্মসূচি পালনের বিষয়ে একমত হয়েছেন বিএনপি এবং সমমনা দল ও জোটের নেতারা। এরই অংশ হিসাবে ইতোমধ্যে তারা ধারাবাহিক কর্মসূচিও ঘোষণা করেছেন। সোমবার গণতন্ত্র মঞ্চ বিক্ষোভ মিছিল করেছে। ১৯ জুন ‘অসহনীয় লোডশেডিং এবং বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকট সমাধানের দাবিতে’ বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় অভিমুখে বিক্ষোভ পালন করবে। সোমবার রাজধানীতে শোভাযাত্রা করে শোডাউন করেছে বিএনপিও। এছাড়া আজ ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপির উদ্যোগে পৃথকভাবে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবে। ১৬ জুন রাজধানীতে ফের পৃথকভাবে পদযাত্রা করবে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ বিএনপি। এরপর আবারও নতুন কর্মসূচি দেওয়ার কথা রয়েছে। ১৬ জুন বিক্ষোভ মিছিলের কর্মসূচি দিয়েছে ১২ দলীয় জোট। জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটও দু-একদিনের মধ্যে রাজধানীতে কর্মসূচি দেবে। জামায়াতে ইসলামীও একই পথে হাঁটছে। গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আন্দোলন সফল করতে ঢাকা মহানগরের ওপর বেশি গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ে আমরাও একমত। এজন্য মহানগরে আন্দোলন জোরদার করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করেছি, সামনেও রয়েছে। পরে আবারও কর্মসূচি দেওয়া হবে। এর মাধ্যমে মহানগরের মানুষকে আন্দোলনে যুক্ত করার চেষ্টা করছি।’ জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য ও কেন্দ্রীয় প্রচার বিভাগের সেক্রেটারি মতিউর রহমান আকন্দ বলেন, ‘দশ দফার মধ্যে মূলত কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, জাতীয় নেতা ও আলেম-ওলামাদের মুক্তি এবং দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণের দাবিই প্রধান। এ দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে। ধীরে ধীরে কর্মসূচির ধারাবাহিকতা সবাই দেখবে।’ তিনি বলেন, ‘কেয়ারটেকার সরকারের বিষয়ে বিরোধী সব দলই একমত। কাজেই এখন আন্দোলনের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটাই মূলত বিএনপির। জনগণ আন্দোলনমুখী, তাদের জনসমর্থনও আছে। ঢাকাকেন্দ্রিক এই আন্দোলনটা যদি করে, তাহলে তা সফল হবে। আর তারা (বিএনপি) যদি দায়সারাভাবে কাজ করে, তাহলে আন্দোলন সফল হতে বিলম্ব হবে।’ জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপি চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘ঢাকা মহানগরে যদি আন্দোলন সফল হয়, তাহলে সরকার পতন হবে। এ ঢেউ এমনিতেই গ্রামে চলে যাবে। গ্রামের আন্দোলন ঢাকায় কোনো প্রভাব পড়ে না। সামনের দিনের আমাদের প্রধান পয়েন্ট থাকবে ঢাকা মহানগর। একদফার আন্দোলন সফলে ঢাকাকেই জোর দেওয়া হচ্ছে।’ ১২ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক বাংলাদেশ জাতীয় দলের চেয়ারম্যান সৈয়দ এহসানুল হুদা বলেন, ‘অতীতে ঢাকা মহানগরকে ওইভাবে চাঙা করা যায়নি বিধায় হয়তো বা আন্দোলনটা পরিপূর্ণতা পায়নি, যা বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারাও স্বীকার করবেন। এখন ঢাকাকেন্দ্রিক আন্দোলন জোরদার করছি। পাাশাপাশি তৃণমূলকেও যথাযথ ভূমিকা রাখতে হবে।’