চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) সংসদীয় এলাকায় অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, ইটভাটা স্থাপন, পাহাড় কাটা, আবাদি জমির টপ সয়েল কাটা, অবৈধ সিএনজি ফিলিং স্টেশন স্থাপনসহ নানা অপকর্ম চলছে। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে শুধু গায়ের জোরে এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হচ্ছে। সাঙ্গু ও ডলু নদী থেকে যত্রতত্র অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। ৯ বছরে অন্তত ছোট-বড় ২২টি পাহাড় কেটে সাবাড় করা হয়েছে। বন উজাড় করে সেখানকার কাঠ জ্বলছে ইটভাটায়। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও ভুক্তভোগী এলাকাবাসীর অভিযোগ-স্থানীয় সংসদ-সদস্য (এমপি) ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর অনুসারীরাই এসব নৈরাজ্যে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা কখনো সরাসরি সংসদ-সদস্যের নামে, কখনো বা তার নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম চালাচ্ছেন। যে কারণে সাধারণ মানুষ এসবের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস করছেন না। প্রতিবাদ করতে গেলে শিকার হতে হচ্ছে হামলা-মামলার। নিজস্ব অনুসন্ধান এবং সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে এসব তথ্য। অনুসন্ধানে জানা যায়, উল্লিখিত অপকর্মের নেপথ্যে রয়েছেন সংসদ-সদস্যের ভাতিজা মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম, শ্যালক সাতকানিয়ার চরতি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান রুহুল্লাহ চৌধুরী এবং পিএস ও লোহাগাড়া থেকে নির্বাচিত জেলা পরিষদ সদস্য এরফানুল হক চৌধুরী। এছাড়া কোটি কোটি টাকার সরকারি বরাদ্দের বিলিবণ্টন, প্রকল্প বাস্তবায়নেও অনিয়ম-দুর্নীতির সীমা নেই। এসব ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ নেতাদের পাশ কাটিয়ে, বিএনপি-জামায়াত কিংবা এলডিপির লোকজনকে নিয়েই সংসদ-সদস্য নদভী কাজ করেন। যে কারণে স্থানীয় আওয়ামী লীগে রয়েছে চরম অসন্তোষ। ৯ বছরে সংসদ-সদস্যের সঙ্গে মতবিরোধে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গ সংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে হামলা-মামলার শিকার হতে হয়েছে। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে এসব কারণে তার সৃষ্টি হয়েছে যোজন-যোজন দূরত্ব। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় সবচেয়ে বড় ব্যবসা হচ্ছে ব্রিকফিল্ড বা ইটভাটার। এখানে দেড় শতাধিক ইটভাটা রয়েছে। চট্টগ্রামে চাহিদার সিংহভাগ ইটের জোগান আসে এ দুই উপজেলার ইটভাটা থেকে। ইটভাটার মাটি আসে পাহাড় ও কৃষিজমি থেকে। চরতি ও মাদার্শা ইউনিয়ন হচ্ছে পাহাড়ি এলাকা। এ দুই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সংসদ-সদস্য নদভীর দুই স্বজন-ভাতিজা ও শ্যালক। দুই চেয়ারম্যানের ছত্রছায়ায় থেকে দুর্বৃত্তরা এখানকার ছোট-বড় অনেক পাহাড়ের মাটি কেটে সাবাড় করেছে। এছাড়া কেরানি হাটের দুই পাশে বিলের পর বিলের কৃষিজমি দেখতে দিঘির মতো দেখায়। মূলত এসব কৃষিজমির টপ সয়েলসহ মাটি কেটে সরবরাহ দেওয়া হয় ইটভাটায়। ভূমি মালিক কিংবা পাহাড় মালিকদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করেই পেশিশক্তির প্রভাব খাটিয়ে মাটি কাটা ও পাহাড় কাটা চলে সমানে। কেউ বাধা দিতে গেলেই হামলা-মামলার শিকার হতে হয়। তাদের আরেক ব্যবসা হচ্ছে শঙ্খ ও ডলুখালের বালু। সাতকানিয়া উপজেলার নলুয়ায় জেলা প্রশাসন কিছু বালুমহাল ইজারা দিলেও দুই খালের বেশির ভাগ এলাকায় কোনো ইজারা নেই। নিয়ম অনুযায়ী টেন্ডারের মাধ্যমে পানি উন্নয়ন বোর্ড খালের বালু উত্তোলন করবে। বিক্রি করা বালুর টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দেওয়া হবে। কিন্তু এখানে সেই নিয়মের কোনো বালাই নেই। কেউ টেন্ডার জমা দিতে চাইলেও তাদের বাধার শিকার হতে হয়। যে কারণে পানি উন্নয়ন বোর্ড আর বালু বিক্রির টেন্ডার দিতে পারে না। সূত্র জানায়, অনেক ক্ষেত্রে পানি উন্নয়ন বোর্ড ড্রেজিং করে বালু তুললে তা বিক্রি করে টাকা নিয়ে যায় সিন্ডিকেট। আবার এই সিন্ডিকেট নিজেরাও ড্রেজার লাগিয়ে বালু তুলে বিক্রি করে। কোটি কোটি টাকার এই বালুর ব্যবসা সম্পূর্ণই অবৈধভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে সংসদ-সদস্যের স্বজন ও সিন্ডিকেট। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০২১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ফসলি জমির ওপর দিয়ে অবৈধ বালু উত্তোলনের পাইপ নিতে বাধা দেওয়ায় নিরীহ কৃষকদের ওপর স্বয়ং সংসদ-সদস্যের শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে গুলি ও হামলা চালানো হয়। এ ঘটনায় মামলা হলেও হামলাকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাহাড় কাটার অভিযোগে পরিবেশ অধিদপ্তরের মামলার আসামিও হয়েছিলেন সংসদ-সদস্যের ভাতিজা ইউপি চেয়ারম্যান আ ন ম সেলিম। সর্বশেষ সাতকানিয়ার এওচিয়া ৬ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ‘এসএমবি’ নামে একটি ব্রিকফিল্ড দখলের ঘটনা ঘটে। এখান থেকে ৬ লাখ ইট লুট করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। একই ইউনিয়নে কামরুল ইসলাম নামে এক স্থানীয় বাসিন্দাকে গুলি করতে গেলে রাফি নামে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এওচিয়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ও সাতকানিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য মো. আবু সালেহ বলেন, ‘অবৈধভাবে বালু উত্তোলন, পাহাড় কাটা, ব্রিকফিল্ড দখল, অবৈধ সিএনজি স্টেশন স্থাপন থেকে শুরু করে এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা করছে না সংসদ-সদস্যের বাহিনী। কখনো সরাসরি তার নির্দেশ আবার কখনো নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করছে। তার ইউনিয়নে আনসারুল হকের মালিকানাধীন একটি ব্রিকফিল্ড দিনে-দুপুরে প্রকাশ্যে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে দখল করেছে সংসদ-সদস্যের অনুসারীরা। মানিক নোমান মমতাজের নেতৃত্বে ২০০-২৫০ সন্ত্রাসী ব্রিকফিল্ডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বের করে দিয়ে দখল করে নেয়, যা নজিরবিহীন।’ তিনি আরও বলেন, সংসদ-সদস্যবিরোধী হিসাবে এলাকায় পরিচিত কামরুল ইসলাম নামে এক স্থানীয় বাসিন্দাকে গুলি করে হত্যাচেষ্টা চালানো হয়। এতে রাফি নামে এক শিশু গুলিবিদ্ধ হয়। এ ঘটনায় ডালিমসহ দুইজন গ্রেফতার হন। হামলাকারীরা সংসদ-সদস্যের অনুসারী এবং তাদের ছাড়াতে তিনি থানায় সরাসরি তদবির চালান বলে দাবি করেন চেয়ারম্যান আবু সালেহ। দেওদিঘি এলাকায় বিপজ্জনকভাবে একটি স্থায়ী অবৈধ সিএনজি স্টেশন স্থাপন করা হয়েছে। এটি স্থাপনের নেপথ্যে রয়েছেন সংসদ-সদস্যের অনুসারীরা। প্রসঙ্গত, এসএমবি ব্রিকফিল্ডের মালিক দাবিদার কামাল উদ্দিনের স্ত্রী সংবাদ সম্মেলন করে তাদের ব্রিকফিল্ড দখলে সংসদ-সদস্যের ইন্ধন রয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন। ওই দখলের ঘটনায় নোমানসহ দুই আসামিকে র্যাব গ্রেফতারও করে। স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা সাতকানিয়ার বাসিন্দা ডা. আ ম ম মিনহাজুর রহমান বলেন, ‘সাতকানিয়ায় যেসব অপকর্ম হচ্ছে, কোনো কিছুরই দায় সংসদ-সদস্য এড়াতে পারেন না। সাড়ে ৯ বছর তিনি এলাকায় সরকারি দলের সংসদ-সদস্য হিসাবে আছেন, তাই সরকারের উন্নয়নের সুফল এলাকাবাসীর পাওয়ার কথা। উলটো অনিয়ম-দুর্নীতি, লুটপাটের কারণে এলকার সাধারণ মানুষ এর সুফল থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দলের নেতাদের সঙ্গে তার সমন্বয় নেই। রয়েছে দূরত্ব। তিনি সৃষ্টি করেছেন নিজস্ববলয়। যার খেসারত আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষকে দিতে হচ্ছে।’ অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে (পিআইও) নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সংসদ-সদস্যের পিএস এরফানুল করিম চৌধুরীর মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ বিলিবণ্টন করা হয়। সোলার প্যানেল স্থাপন, টিআর-কাবিখার মাধ্যমে অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন এককভাবেই নিয়ন্ত্রণ করেন সংসদ-সদস্য। লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে স্থাপিত অধিকাংশ সোলার প্যানেলই এখন অকেজো। সরকারের প্রদত্ত দরের এক-তৃতীয়াংশ কমে নিুমানের সোলার প্যানেল স্থাপন করে বিপুল অর্থ লোপাট করা হয়েছে বলে অভিযোগ আছে। লোহাগাড়ায় সেতু নির্মাণে অনিয়মের প্রতিবাদ করায় জসিম উদ্দিন নামে এক আওয়ামী লীগ কর্মীকে সংসদ-সদস্য নিজ হাতে মারধরের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ্য মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। সংসদ-সদস্যের পক্ষে কথা না বলায় কিংবা তার বিপক্ষে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের অনেক নেতাকর্মীকে মামলার আসামি হতে হয়েছে বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। সাতকানিয়া উপজেলা শ্রমিক লীগের সভাপতি রিদুয়ানুল হক, সাতকানিয়া উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি সাইফুল ইসলাম সুমন, উপজেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হাজে মোহাম্মদ, উপজেলা আওয়ামী লীগের যুব ও ক্রীড়া সম্পাদক নজরুল সিকদার, উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা মাস্টার আবুল কাশেম,, দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কলিম উল্ল্যাহ চৌধুরী, উপজেলা ছাত্রলীগ নেতা মো. আইয়াজ খান, চরতি ইউনিয়ন ছাত্রলীগের নেতা খোকা তালুকদার, আমিলাইশ স্বেচ্ছাসেবক লীগ সভাপতি আরমানসহ দলীয় নেতাকর্মীদের অনেকে এখন মামলার হুলিয়া মাথায় নিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ২০১৯ সালে সংসদ-সদস্যের নানাভাবে হস্তক্ষেপ এবং প্রতিপক্ষকে পেশিশক্তি দিয়ে ঘায়েল করে ভাতিজা আ ন ম সেলিমকে নিজ ইউনিয়ন মাদার্শা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বানান। এই ইউনিয়নে নজরুল ইসলাম সিকদার নির্বাচন করবেন ঘোষণা দেওয়ায় তার ঘরবাড়ি ভেঙে দেওয়া হয় বলে নজরুলের পরিবার এবং দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়। একইভাবে শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীকে চরতি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত করার জন্যও নগ্ন হস্তক্ষেপ করেন সংসদ-সদস্য। অবৈধ অস্ত্র হাতে সাবেক জামায়াত ক্যাডার রুহুল্লার ছবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীসহ সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় নদভীকে জেতাতে যেসব আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী কাজ করেছেন, তাদেরও বেমালুম ভুলে গেছেন। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া-দুই উপজেলাতেই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তার কোনো সমন্বয় নেই। সরকারি বরাদ্দ বিলিবণ্টনে নদভী স্ত্রী, শ্যালক, ভাগিনাসহ আত্মীয়স্বজনকে যতটুকু গুরুত্ব দেন, ঠিক ততটুকুই অবহেলা বা অবজ্ঞা করেন আওয়ামী লীগ নেতাদের! এমনকি বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও উদ্বোধনে জনপ্রতিনিধিদেরও গুরুত্ব দেন না। দলীয় নেতাদের পাশাপাশি সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্যে সভা-সমাবেশে বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য দিয়ে বারবার আলোচনা-সমালোচনার পাত্র হন তিনি। কিন্তু কিছুতেই যেন তার কিছুই যায়-আসে না। এসব অভিযোগ লিখিতভাবে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের কাছেও দেওয়া হয়েছে। যদিও নেতাদের কারও কারও দাবি, জামায়াতের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার জন্যই’ নদভীকে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন দেওয়া হয়েছিল। দলীয় সূত্রগুলো জানায়, যেহেতু দলীয় মনোনয়ন নিয়ে এসেছেন নদভী, তাই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও তার জন্য জানবাজি করে কাজ করেছেন। দুটি নির্বাচনেই নদভীর পক্ষে কাজ করেন আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। প্রথম মেয়াদে নদভী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিষয়ে সহনশীল থাকলেও দ্বিতীয় মেয়াদে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা বা মন্ত্রী-যে কেউ তার পূর্বানুমতি ছাড়া এলাকার কোনো অনুষ্ঠানে গেলে সেটিও তিনি ভালোভাবে নেন না। শিক্ষা উপমন্ত্রীর নামাঙ্কিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একাডেমিক ভবনের উদ্বোধনী ফলকও ভেঙে ফেলার নজির রয়েছে। সংসদ-সদস্যের অনুসারীরা এটি করেছেন বলে অভিযোগ সংশ্লিষ্টদের। ১১ মার্চ একটি সভায় সংসদ-সদস্যকে বলতে শোনা যায়, আওয়ামী লীগের নমিনেশনের জন্য কেউ ১০০ কোটি টাকা খরচ করলে তিনি এক হাজার কোটি টাকা খরচ করবেন। সাতকানিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এমএ মোতালেব বলেন, ‘দলীয় সংসদ-সদস্য হওয়ার পরও দলীয় নেতাকর্মীদের সঙ্গে তিনি বিমাতাসুলভ আচরণ করেন। বিভিন্ন সময়ে বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য দেন। টাকার গরম দেখান। দম্ভোক্তি করেন। কোনো কাজে দলীয় নেতাদের সঙ্গে সমন্বয় করেন না। মন্ত্রীর নামফলক ভেঙে ফেলার মতো ঘটনা ঘটান।’ তিনি আরও বলেন, ‘সাড়ে ৬ কোটি টাকায় নির্মিত উপজেলা পরিষদের সম্প্রসারিত ভবন উদ্বোধন করেন জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়েই। আমি উপজেলা চেয়ারম্যান, অথচ আমাকে বাদ দিয়ে আমার পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান, ১২ ইউপি চেয়ারম্যানকে বাদ দিয়ে নিজের লোকজন ও আত্মীয়স্বজনকে নিয়ে ভবন উদ্বোধন করেন। দলীয় সংসদ-সদস্য হওয়ার পরও জনপ্রতিনিধি ও দলীয় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে তিনি এলাকায় নিজের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করতে নোংরামির আশ্রয় নিচ্ছেন। এটা দলের জন্য লজ্জাজনক।’ তিনি বলেন, ‘দলীয় নেতাদের সঙ্গে উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের সমন্বয় করতে কেন্দ্রীয় নেতাদের উপস্থিতিতে ঢাকায় বৈঠকও হয়েছিল। বৈঠকে তিনি সমন্বয় করবেন বলে কথা দিলেও ফিরে এসে তিনি কথা রাখেননি। তার সামগ্রিক আচার-আচরণে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে আমি মনে করি।’ লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি খোরশেদ আলম বলেন, সংসদ-সদস্য নদভী লোহাগাড়ায় আওয়ামী লীগের পরিবর্তে ‘এমপি লীগ’ তৈরি করেছেন। তার কাছে দলের নেতাকর্মীরা তুচ্ছ। আত্মীয়-স্বজনই মুখ্য। ভাতিজা ও তার পিএস এরফানুল করিম চৌধুরীকে জেলা পরিষদ সদস্য বানানোর জন্য সাতকানিয়া থেকে তার ভোটার ট্রান্সফার করিয়েছেন লোহাগাড়ায়। লোহাগাড়ায় সরকারি কোনো উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমন্বয় করেন না তিনি। তার পিএস ও আত্মীয় এরফানুল করিম চৌধুরীই সর্বেসর্বা। ক্ষমতার দম্ভে তিনি বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন। আমরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাকে সংসদ-সদস্য বানিয়েছি। আর তিনি আছেন এলডিপি, জামায়াত-বিএনপি নিয়ে। লোহাগাড়ায় তিনি দলকে ধ্বংস করে দিয়েছেন। আমি যখন লোহাগাড়া উপজেলা নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীক পাই, তখন আমার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন নদভী সাহেব। তিনি এলডিপি প্রার্থী জিয়াউল হক বাবুলের পক্ষে কাজ করেন। নির্বাচনের আগে আমার বাড়িতে, নেতাকর্মীদের বাসায় পুলিশ পাঠিয়ে আতঙ্ক তৈরি করেন। অথচ জামায়াত-বিএনপির সন্ত্রাসীরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছিলাম। নৌকার সংসদ-সদস্য হয়ে নৌকার প্রার্থীকে পরাজিত করতে যা যা করা দরকার, আমার বেলায় এর সবই করেছেন নদভী সাহেব। আমরা সুযোগ পেলে এসব বিষয়ে নেত্রীকে জানাব।’ সংসদ-সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভীর বক্তব্য : উত্থাপিত বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সংসদ-সদস্য ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী মোটা দাগে প্রায় সব অভিযোগই উড়িয়ে দেন। তিনি বলেন, সাতকানিয়া ছিল একসময় ‘পাকিস্তান’। স্বাধীনতা-পরবর্তী কোনো সময় এই আসন থেকে আওয়ামী লীগ জিততে পারেনি। তিনি নৌকা প্রতীকে এই আসন থেকে জয়লাভের পর আওয়ামী লীগের ভিত্তি মজবুত করার চেষ্টা করছেন। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সঙ্গে সমন্বয় করেই সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছি। আমার ভাতিজা আ ন ম সেলিম একজন গেজেটধারী মুক্তিযোদ্ধার ছেলে। সে নৌকার মনোনয়ন পাওয়ার পর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে জয়ী হয়েছে। একইভাবে শ্যালক রুহুল্লাহ চৌধুরীও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজয় লাভ করেছে। তারা জনপ্রতিনিধি। জনগণের ক্ষতি হয়-এমন কাজ নিশ্চয় তারা করবে না। সাতকানিয়া ও লোহাগাড়া উপজেলা আওয়ামী লীগ সভাপতির সঙ্গে আমার দূরত্ব ছিল না। তাদের দিয়ে আমি অনেক কাজ করেছি। প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছি। কিন্তু তারা নিজেরা যদি দূরত্ব তৈরি করেন, তাতে আমার করার কী আছে। লোহাগাড়া উপজেলা চেয়ারম্যান এলডিপি থেকে আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। কেন্দ্রীয় নেতা মাহবুবউল আলম হানিফ তাকে চিঠি দিয়েছেন। তার পক্ষে নির্বাচনে প্রকাশ্য কাজ করার আমার কোনো সুযোগ ছিল না। লোহাগাড়া আওয়ামী লীগ সভাপতি খোরশেদ আলমকেও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে যুক্ত করেছিলাম। তিনি নিজেই আমার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করেছেন। ক্ষমতার দম্ভ নয়, আমি ক্ষমতার সদ্ব্যবহার করে মানুষের কল্যাণে কাজ করছি। পিএস এরফানুল করিম চৌধুরী : বিভিন্ন অভিযোগ প্রসঙ্গে সংসদ-সদস্যের পিএস এরফানুল করিম চৌধুরী বলেন, টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ বিভিন্ন সরকারি উন্নয়ন প্রকল্পের বরাদ্দের ৬০ শতাংশই আওয়ামী লীগের পদধারী নেতাদের মাধ্যমে বিলিবণ্টন করা হয়। মসজিদ-মন্দিরসহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের জন্য ২০ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আমার মাধ্যমে এসব নিয়ন্ত্রণ করা বা বরাদ্দে অনিয়মের যে অভিযোগ করা হচ্ছে, তা মিথ্যা। পাহাড় কাটা, অবৈধভাবে বালুর ব্যবসা, ইটভাটা নিয়ন্ত্রণ সংসদ-সদস্যের অনুসারীরাই করছেন-এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে এরফানুল করিম বলেন, ‘সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় স্বাধীনতার পর থেকে বিএনপি-জামায়াতই এসব নিয়ন্ত্রণ করত। অবৈধ ব্যবসা নিয়ে প্রায় সময় দাঙ্গা-হাঙ্গামা লেগে থাকত। সংসদ-সদস্য মহোদয় কোনো ধরনের অবৈধ কাজকে প্রশ্রয় দেন না। বরং তিনি আসার পর দাঙ্গা-হাঙ্গামা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। সবকিছুই একটা শৃঙ্খলার মধ্যে এসেছে। খালের ড্রেজিং ও ব্লক বসানোর জন্য ৫৭৭ কোটি টাকার একটি প্রকল্প এনেছেন সংসদ-সদস্য। এসব কাজ দেখভালের জন্য রুহুল্লাহকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন তিনি চেয়ারম্যান হওয়ার কারণে তার নামে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে।’ কেবল জেলা পরিষদ সদস্য হওয়ার জন্যই সাতকানিয়া থেকে লোহাগাড়ায় নিজের ভোটার ট্রান্সফার করা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমার নানার বাড়ি লোহাগাড়া। আমার লেখাপড়া সেখানে। আমি বড় হয়েছি লোহাগাড়ায়। সেখানে আমাদের জায়গা-জমিও আছে। সে কারণেই ভোটার ট্রান্সফার করেছি। মূলত গুটিকয়েক আওয়ামী লীগ নেতা শুরু থেকেই ঈর্ষাপরায়ণ হয়ে সংসদ-সদস্য মহোদয়ের পেছনে লেগেছেন। সাতকানিয়া-লোহাগাড়ায় আওয়ামী লীগে কর্মী-সমর্থক বাড়িয়েছেন, হাজার হাজার ভোটার বাড়িয়েছেন, সেটা কেউ বলছেন না। সবাই ‘ঘোলা পানিতে মাছ শিকার’-এর চেষ্টা করছেন।