সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রের ভেতর ও বাইরে একচেটিয়া প্রভাব ছিল আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের। নৌকা প্রতীকের ব্যাজ ধারণ করে তাদের ভোটারদের ভোট দিতে প্রভাবিত করতে দেখা গেছে। কোথাও কোথাও গোপনকক্ষে গিয়ে নিজেরাই অন্যের ভোট দিয়ে দিয়েছেন। আবার কেউ কেউ গোপনকক্ষে গিয়ে তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে কিনা-তা নিশ্চিত হয়েছেন। গোপনকক্ষে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) এভাবে ভোট দিয়ে দেওয়াকে নির্বাচন কমিশন ‘ডাকাত’ আখ্যায়িত করলেও বুধবার তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি নির্বাচন কমিশন। উল্টো প্রশাসন ও পুলিশের সহযোগিতা না পেয়ে কয়েকজন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন। বুধবার প্রতিবেদকরা সরেজমিন ভোটকেন্দ্র ঘুরে এসব চিত্র দেখেছেন। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুটি ভোটকেন্দ্রে কাউন্সিলর প্রার্থীদের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। একটি কেন্দ্রে অন্তত ২০ মিনিট ভোটগ্রহণ বন্ধ ছিল। তবে বেশিরভাগ কেন্দ্রে শার্ন্তিপূর্ণভাবে ভোট নেওয়া হয়। সিটি করপোরেশনের বর্ধিত এলাকা হিসাবে পরিচিত ২৮ থেকে ৪২ নম্বর ওয়ার্ডে সকাল থেকে ভোটারদের ভিড় দেখা গেছে। এমনকি বিকাল ৪টায় ভোটগ্রহণের সময় শেষ হওয়ার পরও অনেক কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ চলেছে। অপরদিকে সিটি করপোরেশনের মূল প্রাণকেন্দ্র হিসাবে পরিচিত শহর এলাকায় ভোটার উপস্থিতি ছিল খুবই কম। বেশিরভাগ কেন্দ্রে ফাঁকা ছিল। চাপ না থাকায় ভোটাররা এসেই ভোট দিয়ে চলে গেছেন। বেশিরভাগ কেন্দ্রে নৌকা ও লাঙ্গলের এজেন্ট ছিল। বাকি পাঁচ মেয়র প্রার্থীর এজেন্ট দেখা যায়নি। ভোটগ্রহণের পরিবেশ নিয়ে প্রধান দুই মেয়র প্রার্থী পালটাপালটি বক্তব্য দিয়েছেন। নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছেন জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী নজরুল ইসলাম (বাবুল)। ভোটগ্রহণ শেষ হওয়ার পর কুমারপাড়ায় নিজ নির্বাচনি কার্যালয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন ভোটের নামে সাজানো নাটক করেছে। লাঙ্গলের ভোট নৌকায় এবং নৌকার ভোট লাঙ্গল প্রতীকে দিয়ে ফলাফল ঘোষণা করছে। এটা পূর্বপরিকল্পিত নীলনকশার বহিঃপ্রকাশ। এর আগে ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় তিনি অভিযোগ করেন, ১২টি কেন্দ্র থেকে তার এজেন্ট বের করে দেওয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগ পেশিশক্তি দেখিয়েছে। ভোটের দিন তার ছেলেকে আটকে রাখা হয়েছে। এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনকে অভিযোগ করে প্রতিকার পাওয়া যায় না। নির্বাচন কমিশন, প্রশাসন সবাই আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পকেটে। তবে ভোটগ্রহণ নিয়ে ভিন্ন মন্তব্য করেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী। ভোটগ্রহণ চলাবস্থায় তিনি বলেন, নগরবাসী উৎসবের আমেজে ভোট প্রয়োগ করছেন। ইভিএমে সহজেই ভোট দিতে পারছেন নগরবাসী। নির্বাচনে জয়ের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করেন। মেয়র নির্বাচিত হলে সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করবেন বলেও জানান। গোপনকক্ষে দুজন : বেলা ৩টা ১০ মিনিটে ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের ইসলামপুর এলাকার দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্র। এ কেন্দ্রের বাইরে শত শত নেতাকর্মী তাদের পছন্দের প্রার্থীর সমর্থনে স্লোগান দিচ্ছেন। কেন্দ্রের ভেতরেও নৌকা প্রতীকের ব্যাজধারী কয়েকজন যুবক ভোটাদের তার পছন্দের প্রতীকে ভোট দেওয়ার অনুরোধ করেছেন। এ কেন্দ্রের ৫ নম্বর বুথে কিছু সময় পরপর একজন নারী গোপনকক্ষে প্রবেশ করেন। তিনি নিজেই নৌকা প্রতীকে ভোট দেন। নারী ভোটারদের ওই কক্ষের বাইরে সাদা পাঞ্জাবি পরা দুজন যুবক তাকে পাহারা দেন। এ প্রতিবেদকদের দেখার পর ওই নারী এজেন্টদের সারিতে বসে পড়েন। এ প্রতিবেদকদের সঙ্গে তিনি কোনো কথা বলতে রাজি হননি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের ঘটনা ঘটার কথা নয়। ভোটারদের অনুরোধে কেউ সহায়তা করতে যেতে পারেন বলে সন্দেহ প্রকাশ করেন তিনি। বিষয়টি তিনি দেখবেন বলেও জানান। এর আগে বেলা ১২টা ৫৫ মিনিটে ৩৫ নম্বর ওয়ার্ডের বাঘমারার সফিক-রফিক সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে গিয়েও প্রায় একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তৌহিদুর রহমান তুহিন বলেন, গোপনকক্ষে না যাওয়ার জন্য বারবার নিষেধ করা হয়েছে। তিনি বলেন, অনেক ভোটার ইভিএমে ভোট দিতে পারে না। ভোটারদের বারবার অনুরোধে হয়তো দু-একজন গোপনকক্ষে গিয়ে থাকতে পারে। বেলা দেড়টায় লন্ডন গ্রেস আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রেও একই ধরনের চিত্র দেখা গেছে। গোপনকক্ষে ‘ডাকাত’ ঠেকাতে নিজের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেন ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তা মো. আল শাহরিয়ার রাজিব। তিনি বলেন, গোপনকক্ষে বারবার ভোটার ছাড়াও অন্য ব্যক্তিরা প্রবেশ করছেন। তাদের নিষেধ করার পরও শুনছেন না। বিষয়টি সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ম্যাজিস্ট্রেটকে জানিয়েছি। তারা কী ব্যবস্থা নেন দেখি। এর বাইরে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। বিচ্ছিন্ন সহিংসতা : সিটি করপোরেশন নির্বাচনের কয়েকটি কেন্দ্রে সহিংসতা ও ধাক্কাধাক্কির ঘটনা ঘটে। সবকটি ঘটনাই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘটিত হয়েছে। একজন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা গোপনকক্ষে গিয়ে একজন নারী ভোটারকে ভোট দিতে সহযোগিতা করাকে কেন্দ্র করে ৩০ নম্বর ওয়ার্ডে মহালক্ষ্মী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া হয়। ওই সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাকে লাঞ্ছিতও করা হয়। এ ঘটনায় ভোটগ্রহণও ২০ মিনিট স্থগিত রাখা হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাড়তি সদস্য ও ম্যাজিস্ট্রেট গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। মারামারির ঘটনা ঘটেছে ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট কেন্দ্রেও। ওই কেন্দ্রের দায়িত্বরত পুলিশ কর্মকর্তা জানান, ভোটারদের প্রভাবিত করা নিয়ে কেন্দ্রের ভেতরেই দুই কাউন্সিলর প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে ধাওয়া-পালটাধাওয়া ও হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ইভিএমে কেউ খুশি কেউ অসন্তোষ : প্রথমবার ভোট দিতে গিয়ে অনেকেই খুশি হয়েছেন। আবার অনেকেই অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বেলা ১১টা ৪৯ মিনিটে ১৫নং ওয়ার্ডের শাহজালাল জামিয়া ইসলামিয়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে গিয়ে দেখা গেছে, ভোটার কম থাকায় অলস সময় পার করছেন ভোটগ্রহণ কর্মকর্তারা। ৩ নম্বর কক্ষের ইভিএমে ত্রুটি ধরা পড়ে। ওই কক্ষের নৌকা প্রতীকের এজেন্ট প্রহর দাস বলেন, একদিকে ভোটার নেই, অন্যদিকে ইভিএম যন্ত্রণা। সকাল ৮টায় ভোট শুরু হওয়ার পর থেকে দুপুর পৌনে ১২টা পর্র্যন্ত ৪বার ইভিএম মেশিন বিকল হয়ে যায়। মেশিনটি সচল করতে প্রতিবার ১০ থেকে ১৫ মিনিট সময় লেগেছে। কাউন্সিলর প্রার্থী রেডিও প্রতীকের এজেন্ট দিপক রায়েরও একই অভিযোগ। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ভোটগ্রহণের সময় এসব হচ্ছে কেন। এটা কি পরিকল্পিত না অন্য কোনো ষড়যন্ত্র সেটাই বুঝতে পারছি না। অনেকে ভোট না দিয়ে চলে যাচ্ছেন। অসন্তোষ প্রকাশ করে জল্লারপাড়ের বাসিন্দা গোলজার আহমদের স্ত্রী আনোয়ারা বেগম বলেন, ইভিএম মেশিনে আমার আঙুলের ছাপ মেলেনি। পরে স্মার্টকার্ড দিয়ে ২০ মিনিট চেষ্টার পর ভোট দিতে পেরেছি।