কনডেম সেল থেকে যেভাবে ফিরে এলেন দুই আসামি

প্রকাশিতঃ জুন ২২, ২০২৩ | ৭:০৭ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

হত্যাকাণ্ডের মতো স্পর্শকাতর মামলার তদন্তে একটু ভুলের কারণে যে কোনো ব্যক্তির সমগ্র জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এমনকি ভুল তদন্তে কাউকে আসামি করা হলে ওই ব্যক্তির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হতে পারে। এমনই ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার সোনাদ্দি ওরফে সোনারুদ্দি এবং ইসমাইল হোসেন বাবু। জীবনের ১৬টি বছর কেটে গেছে কারাগারে। এর মধ্যে ১৪ বছরই ছিলেন কনডেম সেলে। তারা সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে বলা হয়েছে, এ দুই আসামির অপরাধ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে কোনো প্রমাণ নেই। অনুসন্ধানে জানা যায়, মামলায় পুলিশের তদন্তকাজে যথেষ্ট দুর্বলতা, গাফিলতি ও পক্ষপাতিত্ব ছিল। ফলে নিরপরাধ ব্যক্তিরা দণ্ডিত হয়ে দীর্ঘদিন কারাগারের কনডেম সেলে ছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগ মামলার বিচার-বিশ্লেষণ করে তাদের খালাস দিয়েছেন। সূত্র জানায়, মামলার তদন্ত কর্মকর্তার ভুল তদন্তে তাদের এ মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়। প্রকৃতপক্ষে তারা এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। বছরের পর বছর মামলার পেছনে ঘুরতে ঘুরতে সবকিছু হারিয়ে তারা নিঃস্ব। এখন দিনমজুরের কাজ করে কোনোরকম জীবিকানির্বাহ করছেন। মিথ্যা মামলায় ক্ষতির শিকার হয়ে ক্ষতিপূরণ চেয়েছেন রাষ্ট্রের কাছে। দায়ীদের বিরুদ্ধে তদন্তসাপেক্ষে শাস্তি দাবি করেছেন তারা। প্রসঙ্গত, ২০০৬ সালের ২০ অক্টোবর রাজশাহীর গৌদাগাড়ীর ধুয়াপাড়া যৌবন গ্রামের সৌদি প্রবাসী বজলুর রহমানের স্ত্রী মিলিয়ারা খাতুন ওরফে রোকসানা ওরফে মিলু (৩০) এবং তার মেয়ে পারভীন ওরফে সাবনুরকে (৯) গলা কেটে হত্যা করা হয়। পরদিন মিলির বাবা রফিকুল ইসলাম থানায় মামলা করেন। মামলায় বলা হয়, মিলির মাথা গোয়াল ঘরে এবং সাবনুরের মাথা টয়লেটে পাওয়া যায়। হত্যাকাণ্ডের দুই বছর পর এ মামলার বিচার শেষে ২০০৮ সালের ২৩ জুলাই রাজশাহীর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক রায়ে চার আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দেন। তারা হলেন ধুয়াপাড়া যৌবন লাইনপাড়ার রফিকুল ইসলামের ছেলে সোনাদ্দি ওরফে সোনারুদ্দি, সিরাজুল ইসলামের ছেলে ইসমাইল হোসেন বাবু, এসলাম ডাকাতের ছেলে তরিকুল ইসলাম ভুতা ও মোক্তার। মামলার শুরু থেকেই মোক্তার পলাতক রয়েছেন। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডের অনুমোদনের জন্য ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে পাঠানো হয়। পাশাপাশি তিন আসামি খালাস চেয়ে হাইকোর্টে আপিল করেন। শুনানি শেষে হাইকোর্ট বেঞ্চ ২০১৪ সালের ১৩ মার্চ আসামিদের আপিল খারিজ করে চারজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন। এরপর কারাবন্দি তিন আসামি খালাস চেয়ে আপিল বিভাগে ফের আপিল করেন। তবে পলাতক থাকায় মোক্তার আপিল করেননি। ওই আপিলগুলোর শুনানি শেষে ২০২২ সালের ২৩ জুন রায় দেন আপিল বিভাগ। পরে তারা কনডেম সেল থেকে মুক্ত হন। সর্বোচ্চ আদালতের রায় : মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই আসামি খালাসের বিষয়ে আপিল বিভাগ রায়ে বলেছেন, আমাদের বলতে দ্বিধা নেই, মো. ইসমাইল হোসেন বাবু ও সোনারুদ্দি নামে দুই দণ্ডিত বন্দির অপরাধ খুঁজে পাওয়ার ক্ষেত্রে অপর দণ্ডিত বন্দি তরিকুলের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির সমর্থনে কোনো প্রমাণ নেই। সুতরাং, এটা আমাদের বিবেচিত দৃষ্টিভঙ্গি যে, প্রসিকিউশন বন্দি-ইসমাঈল হোসেন বাবু ও সোনারুদ্দির বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এ মামলার তদন্তে যথেষ্ট গাফিলতি ছিল। মামলার আসামি ইসমাইল ও সোনারুদ্দিকে গ্রেফতারের পর রিমান্ডে নেন তদন্ত কর্মকর্তা। দোষ স্বীকার করে নেওয়ার জন্য নানারকম নির্যাতন করেন। এত নির্যাতনের পরও তারা বলেছিলেন ঘটনা সম্পর্কে কিছুই জানেন না। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ তরিকুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেফতার করে। এ তরিকুলই ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে জানিয়েছিলেন, তার পাশাপাশি ইসমাইল ও সোনারুদ্দি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নথির তথ্য বলছে, তরিকুলের সঙ্গে ইসমাইলের পারিবারিক বিরোধ ছিল। তরিকুলের ভাগনিকে ইসমাইল বিয়ে করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় তাদের মধ্যে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। জানা যায়, এ মামলায় গৌদাগাড়ীর থানার এসআই নজরুল ইসলাম ছিলেন মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা। পার্শ্ববর্তী উপজেলায় ছিল তার বাড়ি। সেই সময়ে ওই থানার ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) ছিলেন বগুড়ার নুরুল আমিন। মামলা সম্পর্কে এ দুই কর্মকর্তার বক্তব্য জানতে যোগাযোগ করা হলে তাদের পরিবার থেকে জানানো হয়, অনেক আগেই তারা মারা গেছেন। পরে যোগাযোগ করা হয় ওই সময়ে রাজশাহী জেলা পুলিশ সুপার আব্দুল্লাহ আল মাহমুদের সঙ্গে। রাজশাহী পুলিশ একাডেমিতে সর্বশেষ তিনি ডিআইজি মর্যাদায় থাকাবস্থায় বাধ্যতামূলক অবসরে যান। আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, ঘটনার সময় আমি রাজশাহী পুলিশ সুপার ছিলাম কি না, এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না। সম্ভবত ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বরের দিকে রাজশাহী থেকে চলে এসেছি। চার্জশিট দেওয়া হয় আরও পরে। তিনি বলেন, এত বড় ঘটনা এই মুহূর্তে আমার নলেজে নেই। আমার সময়ের ঘটনা হতে পারে। তবে আমি জানি না। আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, একজন এসআই তদন্ত কর্মকর্তা মামলার তদন্ত করেন। তদন্তের ওপর ভিত্তি করে দায়রা জজ আদালতে বিচার হয়। এরপর মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত করার জন্য উচ্চ আদালতে যায়। উচ্চ আদালতের পর আপিল বিভাগে যায়। একজন এসআই কিন্তু ফেরেশতা নন যে তার ভুল হবে না। দায়রা জজ আদালত, উচ্চ আদালত মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন। অবশ্যই সবদিক বিবেচনা করে আদালত রায় দিয়েছেন। অনেক সময় নিরপরাধ লোকও এমন পরিস্থিতির শিকার হচ্ছেন বলেও তিনি জানান। মুক্ত হওয়ার পর বাড়ি গিয়ে কৃষিকাজে মনোযোগ দেন ইসমাইল। দিনমজুর হিসাবে অন্যের জমিতে বোরো ধান কাটছিলেন ইসমাইল। এ মামলায় ফেঁসে যাওয়ার গল্প বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন। বলেন, মামলায় মোট আসামি ছিলেন চারজন। এর মধ্যে মুক্তার নামের একজন ঘটনার পর থেকেই পলাতক। হত্যাকাণ্ডের পর পুলিশ তরিকুল ইসলাম নামের একজনকে গ্রেফতার করে। এই তরিকুলই ফাঁসিয়ে দেওয়ার জন্য পুলিশকে ম্যানেজ করেছিলেন। বলেছিলেন, ইসমাইল ও সোনারুদ্দি ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। ইসমাইল জানান, তরিকুলের ভাগনিকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বনিবনা না হওয়ায় পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এরপর একদিন তরিকুলের সঙ্গে তার হাতাহাতি হয়। তার সঙ্গে সেদিন ইসমাইলও ছিলেন। এটুকু ঘটনার কারণে তরিকুল তাদের দুজনকে ফাঁসিয়ে দিয়েছিলেন। সোনারুদ্দি বলেন, যে সেলে থাকতাম, সেখান থেকে দেখা যেত ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার দৃশ্য। ফাঁসিতে ঝুলানোর জন্য কনডেম সেল থেকে অনেক আসামিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে দেখেছি। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. সারওয়ার হোসেন বাপ্পী বলেন, আদালত অনেক দিক বিবেচনা করে রায় দেন। এর অনেক ব্যাখ্যা আছে। তিনি বলেন, এই ক্ষেত্রে কেউ যদি মনে করেন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তিনি সিভিল আদালতে ক্ষতিপূরণ মামলা করতে পারেন। উচ্চ আদালতেও রিটের সুযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, মামলার তদন্তে দুর্বলতার কারণে অনেক মামলায় নিরপরাধ ব্যক্তি দণ্ডিত হচ্ছেন। পরে সুপ্রিমকোর্টে এসে নির্দোষ প্রমাণিত হচ্ছেন। এসব নির্দোষ ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিরা রাষ্ট্রের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারেন। এটা তাদের রাইট। এসব ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাইকে আরও সতর্কতার সঙ্গে স্পর্শকাতর মামলার বিচারকার্য শেষ করার পরামর্শ দেন তিনি।