ভোট বন্ধের ‘ক্ষমতা’ কমানোর প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকেই আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। ওই প্রস্তাবই মঙ্গলবার জাতীয় সংসদে পাশ হয়েছে। ইসি একটি শব্দ পরিবর্তনের প্রস্তাব করে তাদের ক্ষমতা সংকোচিত করেছে। এছাড়া ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশের আগ পর্যন্ত ভোটগ্রহণে অনিয়মের প্রমাণ পেলে পুরো সংসদীয় আসনের বেসরকারি ভোটের ফল বাতিলের ক্ষমতা চেয়ে প্রস্তাব করেছিল ইসি। সরকারি দল সেখানে পরিবর্তন এনে শুধু যেসব কেন্দ্রে অনিয়ম হয়েছে, সেগুলো বন্ধের ক্ষমতা দিয়ে জাতীয় সংসদ বিল পাশ করেছে। গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২ (আরপিও)-এর ৯১(এ) উপধারায় এসব সংশোধনী আনা হয়। ইসি ও আইন মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। জাতীয় সংসদে পাশ হওয়া বিলে আরপিওর ৭, ১২, ১৫, ২৫, ৩১, ৩৬, ৪৪এএ, ৭৮, ৮৪এ, ৯০বি, ৯০ডি, ৯১ ও ৯১ই-এই ৯টি ধারা-উপধারায় সংশোধনী এসেছে। এর মধ্যে মূলত ৯০(এ) উপধারা সংশোধন নিয়ে ‘বিতর্ক’ চলছে। বাকিগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই করণিক সংশোধন। পর্যবেক্ষক মহল বলছে, ৯০(এ) উপধারা সংশোধনের মাধ্যমে ইসির ক্ষমতা কমানো হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার ক্ষমতা কমানোর ইসির ওই প্রস্তাবকেই আত্মঘাতী বলে আখ্যায়িত করেছেন। এদিকে বিতর্ক চললেও বিষয়টি নিয়ে বুধবার সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে কোনো মন্তব্য করেননি প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। বিলটি গেজেট আকারে প্রকাশের পর তার প্রতিক্রিয়া দেবেন বলেও জানান তিনি। জানা যায়, আরপিও ৯১(এ) উপধারা অনুযায়ী, নির্বাচনে ভীতি প্রদর্শন, বল প্রয়োগ, চাপ প্রয়োগ বা বিরাজমান বিভিন্ন অপকর্মের কারণে ইসি যদি মনে করে তারা আইনানুগ ও ন্যায়সংগত নির্বাচন করতে সক্ষম হবে না, তাহলে নির্বাচনের যে কোনো পর্যায়ে ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা রাখে ইসি। এখন এই ক্ষমতা সীমিত করে ইসিকে শুধু ভোটের দিন সংসদীয় আসনের (অনিয়মের কারণে) নির্দিষ্ট কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। পাশ হওয়া বিলে আরপিওর ৯১ ধারার (এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের বদলে ‘পোলিং’ শব্দ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই শব্দ পরিবর্তনের প্রস্তাব ইসি থেকেই পাঠানো হয়। এ সংশোধনীর ব্যাখ্যায় সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘ইলেকশন’ শব্দ দিয়ে পুরো নির্বাচনপ্রক্রিয়া বোঝায়। অর্থাৎ তফশিল ঘোষণা থেকে শুরু করে ফলাফল ঘোষণা পর্যন্ত সময়টা হলো ‘ইলেকশন’। আর ‘পোলিং’ হলো শুধু ভোটের দিন। এই সংশোধনী পাশ হওয়ার ফলে অনিয়মের কারণে নির্বাচন কমিশন শুধু ভোটের দিন সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্র বা পুরো সংসদীয় আসনের ভোট বন্ধ করতে পারবে। কিন্তু ‘ইলেকশন’ শব্দটি থাকলে ভোটগ্রহণের দিনের আগেও পরিস্থিতি বিবেচনা করে যে কোনো পর্যায়ে নির্বাচন বন্ধ করতে পারত। তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশনের প্রস্তাব আত্মঘাতী। নির্বাচন কমিশন কোন বিবেচনায় নিজেদের হাত-পা কেটে ফেলেছে, তা বোধগম্য নয়। তিনি আরও বলেন, পুরো নির্বাচনি প্রক্রিয়া সঠিক হতে হবে এবং তা রক্ষার দায়িত্ব ইসির। আরও জানা যায়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকেই ৯১(এ) উপধারার এ সংশোধনী আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছিল। নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ও আইন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। নাম গোপন রাখার শর্তে তারা বলেছেন, সংশোধনীর মাধ্যমে নির্বাচন কমিশনের ক্ষমতা কমেনি, উলটো বেড়েছে। ৯১(এ) উপধারার শব্দগত অস্পষ্টতা ছিল। সংশোধনী প্রস্তাবে সেগুলো স্পষ্ট করার লক্ষ্যেই প্রস্তাব পাঠানো হয়েছিল। তারা আরও বলেন, ৯১(এ) উপধারার শুরুতেই ‘স্টপ দ্য পোলস’ শব্দগুচ্ছ রয়েছে। ওই শব্দগুচ্ছের চেতনা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন যে কোনো কেন্দ্র বা পুরো আসনের ভোটগ্রহণ বন্ধ করতে পারবে। ওই চেতনার সঙ্গে সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ‘ইলেকশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘পোলিং’ প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এর অর্থ হচ্ছে-ভোটের দিন অনিয়ম হলে সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রগুলো এবং প্রয়োজন হলে পুরো আসনের নির্বাচনই বন্ধ করতে পারবে নির্বাচন কমিশন। যেসব কেন্দ্রের সঙ্গে ৯১(এ)(এএ) উপধারা যুক্ত করে অনিয়মের অভিযোগ পেলে সংশ্লিষ্ট ভোটকেন্দ্র বা কেন্দ্রগুলোর বেসরকারি ফলাফলও স্থগিত করতে পারবে। এ উপধারা যুক্তের মধ্য দিয়ে কমিশনের ক্ষমতা বেড়েছে। কিন্তু প্রস্তাবটি পুরোপুরি অনুমোদন হয়নি। আরপিও সংশোধন নিয়ে মন্ত্রিসভায় ও আইন মন্ত্রণালয়ের একাধিক বৈঠকে অংশ নেন ইসি সচিব মো. জাহাংগীর আলম। ৯১(এ) উপধারায় ‘ইলেকশন’ শব্দের পরিবর্তে ‘পোলিং’ প্রতিস্থাপনের প্রস্তাব নির্বাচন কমিশন সচিবালয় থেকে পাঠানো হয়েছে কি না-এমন প্রশ্নের সরাসরি জবাব দেননি তিনি। সচিব বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার মহোদয় নিজেই আরপিও সংশোধনের বিষয়ে ব্যাখ্যা দেবেন বলে সাংবাদিকদের বলেছেন। তার ওই বক্তব্যের পর আমি কোনো মন্তব্য করতে পারি না। জাতীয় সংসদে আইনমন্ত্রী মহোদয় আরপিও সংশোধনের প্রেক্ষাপট জানিয়েছেন। ইসির একাধিক কর্মকর্তা নাম গোপন রাখার শর্তে জানান, আরপিও সংশোধনের কয়েকটি প্রস্তাব নিয়ে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে আইন মন্ত্রণালয়ের মতপার্থক্য ছিল। নির্বাচন কমিশনার মো. আনিছুর রহমান আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে অন্তত দুই দফায় বৈঠক করে ইসির পক্ষে সংশোধনী চূড়ান্ত করেন। যদিও আইন সংস্কার কমিটির প্রধান আরেক নির্বাচন কমিশনার বেগম রাশেদা সুলতানা। তারা আরও জানান, অনিয়ম হলে ভোটকেন্দ্রের বেসরকারি ফল প্রকাশের পরও পুরো আসনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ স্থগিত করার ক্ষমতা ইসির হাতে রাখার প্রস্তাব করা হয়। এজন্য ৯১(এ)-এর পর (এএ) উপধারা যুক্ত করা হয়। কিন্তু মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসির ওই প্রস্তাব আংশিক রাখা হয়েছে। পুরো আসনের ফল স্থগিতের ক্ষমতা আইনে ইসিকে দেওয়া হয়নি। শুধু যেসব কেন্দ্রের ফলাফলে অনিয়মের প্রমাণ পাওয়া যাবে, সেগুলো বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রিসভা বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত এসেছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইসির এ প্রস্তাব পরিবর্তন করা উচিত হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. শাহদীন মালিক। তিনি বলেন, ইসির প্রস্তাব সংশোধনের ক্ষমতা মন্ত্রিসভার নেই। কারণ, মন্ত্রিসভা নির্বাহী বিভাগের অন্তর্ভুক্ত। সংবিধানের ১২৬ অনুচ্ছেদে ইসিকে সহায়তা করা নির্বাহী বিভাগের দায়িত্ব। তবে ইসির প্রস্তাব রাখবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত সংসদ নিতে পারে। কারণ, সংসদের সেই এখতিয়ার আছে।