শেয়ারবাজারে বহুল আলোচিত ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলে নয়ছয়ের অভিযোগ উঠেছে। এ ব্যাপারে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে (বিএসইসি) একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে ডিএসই। বিএসইসিতে দেওয়া ডিএসইর সর্বশেষ চিঠিতে বলা হয়, দুটি উৎস থেকে পাওয়া হিসাব অনুসারে তহবিলের আকার ৫২ কোটি টাকার মতো হবে। তবে কমিশন মনে করছে, ঠিকমতো হিসাব করলে এই অর্থ শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এছাড়াও দীর্ঘদিন পড়ে থাকা তহবিলের সুদ-আয়ের যে তথ্য দেওয়া হচ্ছে, তাও গ্রহণযোগ্য নয়। আবার তহবিলের অর্থ বেআইনিভাবে তথ্যপ্রযুক্তি (আইটি) খাতে ব্যবহারের জন্য অনুমতি চায় ডিএসই। ফলে বিস্তারিত খতিয়ে দেখতে এ ব্যাপারে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে কমিশন। কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে বলা হয়েছে। কমিশন মনে করছে, এই তহবিলের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের অর্থ হাতিয়ে নেওয়া তিনটি ব্রোকারেজ হাউজ-বানকো, তামহা ও ক্রেস্ট সিকিউরিটিজের ক্ষতিগ্রস্ত বিনিয়োগকারীদের ক্ষতিপূরণ কিছুটা হলেও সম্ভব। পরবর্তী সময়ে হাউজগুলোর সম্পদ বিক্রি করে টাকা পেলে তা ওই তহবিলে সমন্বয় করা হবে। বিএসইসি সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। জানতে চাইলে বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম শনিবার বলেন, বিনিয়োগকারীদের স্বার্থরক্ষায় বিএসইসি সব সময় তৎপর। এজন্য বিভিন্ন কাজ করছে কমিশন। আর এরই অংশ হিসাবে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের বিধিমালা অনুসারে এই তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই তহবিলে যেসব উৎস থেকে অর্থ আসার কথা, সেখান থেকে আসছে কি না, তা খতিয়ে দেখা হবে। এছাড়াও বিএসইসির এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনাও ছিল। সেই নির্দেশনা পরিপালন হচ্ছে না। সার্বিকভাবে বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে এই তহবিল কীভাবে ব্যবহার করা যায়, তার সবকিছুই খতিয়ে দেখবে কমিটি। তবে এ ব্যাপারে ডিএসইর ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. সাইফুর রহমান মজুমদার শনিবার বলেন, তহবিল পরিচালনার জন্য আলাদা একটি ট্রাস্টি রয়েছে। সেখানে ডিএসইর প্রতিনিধি থাকে। তবে ডিএসইর চেয়ে সেখানে বাইরের লোকজন বেশি। ফলে এখানে অস্বচ্ছতার কিছু নেই। জানতে চাইলে বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি মো. আবদুস সামাদ শনিবার বলেন, ‘তহবিলে কত টাকা রয়েছে, তা নথিপত্র দেখে বলতে হবে।’ সুদ-আয়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘মূলত তহবিলের অর্থ ব্যাংকে জমা রাখা হয়। তবে সুদ-আয় কত বেশি হলো, এর চেয়ে বড় প্রশ্ন হলো নিরাপত্তা। যেখানে টাকা রাখলে নিরাপদ থাকবে, সেখানেই টাকা রাখা হয়। তিনি আরও বলেন, একটি প্রতিষ্ঠান বেশি হারে মুনাফা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিল, কিন্তু হতে পারে পরবর্তী সময়ে মূল টাকাই পাওয়া গেল না। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ প্রতিষ্ঠানে না রেখে, মুনাফা কম হলেও নিরাপদ প্রতিষ্ঠানে রাখা উচিত। জানা যায়, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগকারীদের বড় ধরনের ক্ষতি হলে তাদের রক্ষা করতে ‘বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল’ গঠন করা হয়। দুই স্টক এক্সচেঞ্জেরই এই তহবিল রয়েছে। মূলত তিনভাবে অর্থ আসে। প্রথমত, ব্রোকারেজ হাউজ প্রতিবছর এই তহবিলে কিছু অর্থ দেয়। দ্বিতীয়ত, স্টক এক্সচেঞ্জ থেকেও কিছু টাকা দেওয়া হয়। তৃতীয়ত, এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন (মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা আলাদাকরণ) স্কিম অনুসারে যেসব সদস্যপদের মালিক খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেসব পদের লভ্যাংশ এবং পুঞ্জীভূত সব অর্থ এই তহবিলে জমা করার আইনি বাধ্যবাদকতা রয়েছে। কিন্তু এসব আমলে নিচ্ছে না ডিএসই। সূত্র বলছে, এই তহবিলের ব্যাপারে বিএসইসিকে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য দিচ্ছে না স্টক এক্সচেঞ্জ। এ ব্যাপারে একেক সময় একেক তথ্য দিচ্ছে। সর্বশেষ ডিএসইর পক্ষ থেকে জানানো হয়, ২০২৩ সালের ১৩ জুলাই পর্যন্ত তহবিলে ২১ কোটি টাকা জমা হবে। এছাড়াও মালিকানাহীন পাঁচ সদস্যপদের বিপরীতে ৩২ কোটি টাকা রয়েছে। ফলে তহবিলের আকার দাঁড়াবে ৫২ কোটি টাকা। সেখানে ২১ কোটি টাকার বিপরীতে ২০ বছরে সুদ-আয় দেখানো হয়েছে ১৩ লাখ টাকা। কিন্তু কমিশন মনে করছে এই তথ্য সঠিক নয়। কারণ, সুদের তথ্য একেবারেই অবিশ্বাস্য। তাদের মতে, সঠিক হিসাব করলে তহবিলের অর্থের অঙ্ক শতকোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। বিষয়টি নিয়ে ২৬ জুন বৈঠক করে বিএসইসি। ওই বৈঠকে তহবিলের অর্থ কোথায় কীভাবে রয়েছে, তা খতিয়ে দেখতে ৫ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কমিটির আহ্বায়ক বিএসইসির পরিচালক মো. মনসুর রহমান, অতিরিক্ত পরিচালক আবুল কালাম আজাদ, উপপরিচালক বনি আমিন খান, সহকারী পরিচালক অমিত কুমার সাহা এবং ইলেকট্রনিক পদ্ধতিতে শেয়ার সংরক্ষণকারী কোম্পানি সিডিবিএলের মহাব্যবস্থাপক রাকিবুল ইসলাম চৌধুরী। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, পুঁজিবাজার এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের বৃহত্তর স্বার্থে ডিএসইর বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিল (ইনভেস্টর প্রটেকশন ফান্ড) অনুসন্ধান প্রয়োজন। ইনভেস্টর প্রটেকশন ফান্ড রেগুলেশন ২০১৪ অনুসারে যেসব উৎস থেকে এই তহবিলে অর্থ জমা হওয়ার বিধান রয়েছে, তা জমা এবং বছরভিত্তিক সুদসহ কী পরিমাণ অর্থ রয়েছে, তা যাচাই করা জরুরি। এছাড়াও ২০১৩ সালের অক্টোবরে স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিম প্রকাশিত হয়। ওই সময়ে মালিকানাহীন ৪টি সদস্যপদকে স্কিমের আওতায় নেওয়া হয়। নিয়ম অনুসারে ৫ বছরের মধ্যে এই সদস্যপদের মালিক না পেলে এই পদগুলোর পুঞ্জীভূত অর্থ বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের আওতায় আসবে। সে হিসাবে ২০১৮ সালের অক্টোবরের পর এই অর্থ সুরক্ষা তহবিলে আসার কথা। কিন্তু কেন তা আসেনি, এজন্য কারা দায়ী, তা শনাক্ত করা জরুরি। এসব কারণেই কমিটি গঠন করা হলো। কমিটিকে ৬০ দিনের মধ্যে রিপোর্ট দিতে হবে। তবে সূত্র জানায়, ডিমিউচুয়ালাইজেশন স্কিমের বাইরেও আরও একটি সদস্যপদের সন্ধান মিলেছে। ফলে ৫টি সদস্যপদের অর্থ তহবিলে আসার কথা। তবে ডিএসইর পক্ষ থেকে ভিন্ন একটি প্রস্তাব দেওয়া হয়। ওই প্রস্তাবে বলা হয়, ৫টি সদস্যপদের বিপরীতে কিছু টাকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত যে টাকা জমা হয়েছে, তা বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলে যাবে। আবার ২০১৯ সাল থেকে জমা হওয়া অর্থ ডিএসইর আইটি বিভাগের উন্নয়নে ব্যবহার হবে। তবে ওই প্রস্তাব আমলে নেয়নি কমিশন। এদিকে করোনাকালীন জালিয়াতির মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের টাকা আÍসাৎ করেছে ৩টি ব্রোকারেজ হাউজ। সর্বশেষ তিন ব্রোকারেজ হাউজে সম্মিলিত হিসাবে ঘাটতি ৩৯৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে তামহা সিকিউরিটিজ ১৪০ কোটি, ক্রেস্ট ১২৮ কোটি এবং বাংকো সিকিউরিটিজের ১২৬ কোটি টাকা ঘাটতি রয়েছে। কমিশন মনে করছে, বিনিয়োগকারী সুরক্ষা তহবিলের এই অর্থ দিয়ে তিন ব্রোকারেজ হাউজের ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের কিছুটা হলেও সহায়তা দেওয়া সম্ভব। পরবর্তী সময়ে তিন হাউজের সম্পদ বিক্রি করে তহবিলের টাকা সমন্বয় করা হবে।