আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আন্দোলনের চূড়ান্ত ধাপে মাঠের বিরোধী দল বিএনপি। ১২ জুলাই ঢাকায় সমাবেশ থেকে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করবে দলটি। নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠেয় ওই সমাবেশে বিশাল শোডাউনের প্রস্তুতি শুরু করেছে দলটি। একদফার ঘোষণার দিনই নিজেদের সাংগঠনিক শক্তি জানান দিতে চান তারা। অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে দল গোছানো ও নেতাকর্মীরা সংঘবদ্ধ সেই বার্তাও দেওয়া হবে। একই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকার ইস্যুতে সৃষ্ট সংকট বিদেশিদের কাছে ফলাও করে তুলে ধরতে চায় বিএনপি। তাই ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি দলের ঢাকা সফরকালেই ব্যাপক শোডাউনের মাধ্যমে একদফার ঘোষণা দিতে যাচ্ছে দলটি। সরকার পতনে ৩৬টি দল রাজপথে নেমেছে সেই বার্তাও তাদের দিতে চায়। সমাবেশকে জনসমুদ্রে রূপ দিতে ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে প্রস্তুতিসভা। ঢাকা বিভাগের অন্তর্গত জেলাগুলোর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক এবং বিগত নির্বাচনে ঢাকা বিভাগের অধীন প্রতিটি সংসদীয় আসনে ধানের শীষের প্রাথমিক মনোনয়ন পাওয়া প্রথম দুজন প্রার্থীকে নিয়ে রোববার বৈঠক করেছে বিএনপির হাইকমান্ড। সেখানে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ঢাকার সমাবেশে সর্বোচ্চ লোক সমাগমের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া বিএনপি ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণের যৌথসভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে মহানগরের প্রতিটি থানাকে সমাবেশে সর্বোচ্চ উপস্থিতি ঘটানোর নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনকেও প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। অন্যান্য জেলায় নির্দেশ না দিলেও অনেকেই সমাবেশে যোগ দেবেন। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নেতাকর্মীরা কর্মসূচিতে অংশ নিতে ঢাকায় আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এদিকে একইদিন যুগপৎ আন্দোলনে থাকা সমমনা দল ও জোট আলাদা আলাদা মঞ্চ থেকে সরকার পতনের একদফার ঘোষণা দেবে। তাদের অনেকেই ইতোমধ্যে সমাবেশের স্থান ও সময় চূড়ান্ত করেছে। বিগত সময়ে সমমনা দলগুলো যেখানে কর্মসূচি পালন করেছে এবারও তারা প্রায় একই স্থান থেকেই একদফার ঘোষণা দেবেন। তবে জামায়াতে ইসলামী ওইদিন একদফা ঘোষণা দেবেন কিনা তা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। দলটির এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ওইদিন ঘোষণা না দিলেও তারা একদফাকে সমর্থন জানাবে। একইদিন না হলেও দাবি আদায়ে কর্মসূচি নিয়ে মাঠে থাকবে তারা। জানতে চাইলে জাতীয়তাবাদী সমমনা ১১ দলীয় জোটের সমন্বয়ক এনপিপির চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, বুধবার বিজয়নগর কালভার্ট রোডে সমাবেশ থেকে একদফার ঘোষণা করা হবে। এরপর তাৎক্ষণিকভাবে বিক্ষোভ মিছিল করে কর্মসূচি শেষ করা হবে। একদফা ঘোষণার আগে আজ গণতন্ত্র মঞ্চ, এলডিপি ও লেবার পার্টির সঙ্গে মতবিনিময় করবে বিএনপি। সেখানে একদফার পাশাপাশি রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হবে। এরপর বিএনপির নীতিনির্ধারকরা বসে একদফার কর্মসূচি চূড়ান্ত করবেন। কর্মসূচি নিয়ে দুই ধরনের মত রয়েছে। কেউ কেউ বলছেন, বিদেশিরা দেশে থাকতে ঘেরাওয়ের মতো বড় ধরনের কর্মসূচি দেওয়া উচিত। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে অনেকে বলছেন, শুরুতে কঠোর কর্মসূচি দেওয়ার পর আবার বিক্ষোভ সমাবেশ কিংবা অনশন দেওয়া হলে তা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বর্তমান সংকট সমাধানের একমাত্র পথ হচ্ছে এ সরকারের পতন। সেই লক্ষ্যে কয়েকদিনের মধ্যে একদফার আন্দোলন ঘোষণা করা হবে। সাধারণ জনগণ এবার সেই আন্দোলনে অংশ নেবে। ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বর্তমান অবৈধ সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। সংসদ বিলুপ্ত করে একটা নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে সরকারকে জনগণ বাধ্য করবে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ব্যাপক শোডাউনের মধ্য দিয়ে সরকার পতনের একদফা ঘোষণা করা হবে। সমাবেশ সফলে সংশ্লিষ্ট নেতারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন। শুধু নেতাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও যাতে ওই সমাবেশে যোগ দেয় সেই লক্ষ্যেও কাজ করা হচ্ছে। তিনি বলেন, জনগণ যেমন সব ক্ষমতার উৎস, তেমনি গণআন্দোলনের মুখে কোনো স্বৈরাচার সরকার টিকতে পারেনি। গণআন্দোলনের মুখে সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করা হবে। সরকারের পতন না হওয়া পর্যন্ত কেউ ঘরে ফিরে যাব না-ওইদিন সবাই এমন শপথই নেবেন। মহানগরের বিভিন্ন স্তরের নেতারা জানান, বুধবারের সমাবেশ ঢাকা মহানগর বিএনপির দুই ইউনিটের জন্য অগ্নিপরীক্ষা। একদফার আন্দোলনে এবার ঢাকাকেই গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কর্মসূচি সফলে মহানগর বিএনপিকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। একদফার আন্দোলন ঘোষণার দিন সেই রিহার্সেলের প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। সমাবেশে ব্যাপক শোডাউনে মহানগর বিএনপি দফায় দফায় প্রস্তুতি সভা করছে। রোববার প্রতিটি থানা, ওয়ার্ড ও ইউনিটের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপি। বুধবারের সমাবেশে সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে দেওয়া হয় নানা পরামর্শ। আজ থেকে থানা ও ওয়ার্ড পর্যায়ে প্রস্তুতি সভা করবে মহানগর নেতারা। সমাবেশ শেষ না হওয়া পর্যন্ত সবাইকে উপস্থিত থাকতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় রিকশা ও সিএনজিযোগে মাইক ব্যবহারের অনুমতি চেয়ে পুলিশের কাছে আবেদন করা হয়েছে। জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সদস্য সচিব আমিনুল হক বলেন, বুধবারের সমাবেশে ঢাকা উত্তর থেকে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ উপস্থিতি নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি। সবাই যাতে সমাবেশে আসে তা কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে। বুধবারের সমাবেশ ঘিরে শুধু রাজধানী নয়, সারা দেশের নেতাকর্মীদের মধ্যে উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে। তাই সমাবেশে যোগ দিতে বিভিন্ন জেলা থেকে নেতাকর্মীরা স্বেচ্ছায় ঢাকা আসার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। যারা ঢাকায় ছিলেন তারা সমাবেশ শেষ করে বাড়ি ফিরবেন। জানতে চাইলে কুষ্টিয়া জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাবউদ্দিন সন্ধ্যায় বলেন, সমাবেশে অংশ নিতে রাতেই ঢাকার উদ্দেশে রওয়ানা দিচ্ছি। এ জেলা থেকে আরও অনেকেই ব্যক্তি উদ্যোগে ঢাকার সমাবেশে অংশ নেবে। সরকারের নানা অনিয়ম, দুর্নীতি, মামলা-হামলার প্রতিবাদে কয়েক বছর ধরে রাজপথে নিয়মতান্ত্রিক কর্মসূচি পালন করে আসছে বিএনপি। স্থানীয় সরকার ও উপনির্বাচনে নানা অনিয়মের অভিযোগ তুলে দেড় বছর ধরে সব ধরনের ভোট বর্জন করে আসছে দলটি। দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয় এমনটা জানিয়ে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের দাবি জানিয়ে আসছে দলটি। দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ না নেওয়া, এমনকি তা প্রতিহতের ঘোষণা দেওয়া হয়। সরকার দাবি মেনে না নিলে রাজপথে ফয়সালার হুঁশিয়ারি দেন তারা। সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করতে ২০ দলীয় জোট ভেঙে দিয়ে ডান-বাম ও ইসলামপন্থি দলগুলো নিয়ে বৃহত্তর ঐক্য গড়া ও যুগপৎ আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নেয়। ১০ ডিসেম্বর ঢাকার গোলাপবাগ মাঠে ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ থেকে ১০ দফা দাবিতে যুগপৎ আন্দোলন কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি। ২৪ ডিসেম্বর প্রথম কর্মসূচি নিয়ে মাঠে নামে সমমনা দলগুলো। এরপর ধারাবাহিকভাবে নানা কর্মসূচি পালন করে আসছেন তারা। এখন পর্যন্ত ৩৬টি দল বিএনপির সঙ্গে রাজপথে যুগপৎ আন্দোলনে রয়েছে।