বিতর্কিত এনজিও এইচসিআই’র কার্যক্রম রোহিঙ্গা ক্যাম্পে

প্রকাশিতঃ জুলাই ১১, ২০২৩ | ৮:০৮ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

দেশীয় এনজিও ‘প্রান্তিক উন্নয়ন সোসাইটির’ মাধ্যমে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবাধে কার্যক্রম চালাচ্ছে বিতর্কিত দাতব্য সংস্থা হিউম্যান কনসার্ন ইন্টারন্যাশনাল (এইচসিআই)। যদিও জঙ্গি অর্থায়ন সন্দেহে এই সংস্থাটিকে কানাডা থেকে বহিষ্কারের পাশাপাশি বিপুল পরিমাণ অর্থ জরিমানা করা হয়েছিল। উখিয়ার অনেকে জানান, এইচসিআই-এর মতো বেশকিছু সংস্থা রোহিঙ্গাদের মধ্যে জঙ্গিবাদের বীজ রোপণের চেষ্টা করছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করে দেশের অভ্যন্তরে অশান্তি সৃষ্টি করতে চাচ্ছে তারা। জানা যায়, জঙ্গি অর্থায়ন ও আয়কর আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়ায় ২০২১ সালের ৭ জুলাই আন্তর্জাতিক এনজিও এইচসিআইকে এক বছরের বহিষ্কারাদেশ দেওয়ার পাশাপাশি ৩ লাখ ৮৪ হাজার ৮০১ ডলার জরিমানা করে কানাডা রেভিনিউ এজেন্সি (সিআরএ)। এছাড়া ১৯৯৫ সালে পাকিস্তানের মিসর দূতাবাসে বোমা হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে গ্রেফতার হন সংস্থাটির পাকিস্তান শাখার তৎকালীন প্রধান আহমেদ কাদির। কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রের তালিকাভুক্ত আল কায়দার সদস্য কাদির সেসময় পাকিস্তানে এইচসিআই-এর অর্থায়নে একটি এতিমখানা পরিচালনা করতেন। ওই এতিমখানার অনেক ছাত্র আফগানিস্তান ও পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনে সম্পৃক্ত হয় বলে জানা গেছে। তবে সেই সময় এইচসিআই বিবৃতিতে জানায়, ‘কাদির শুধু আঞ্চলিক স্বেচ্ছাসেবক ছিলেন এবং তার কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংস্থার সম্পৃক্ততা নেই।’ সর্বশেষ ২০১৯ সালের জুলাইয়ে আল কায়দার জন্য তহবিল সংগ্রহের অভিযোগে এইচসিআই-এর পাকিস্তানপ্রধান আলী নেওয়াজকে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে গ্রেফতার করে দেশটির কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট। জানা যায়, ২০১৮ সাল থেকে উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রকল্প পরিচালনার জন্য বাংলাদেশি সংস্থা প্রান্তিককে অনুমোদন ছাড়াই নিয়মিত অর্থায়ন করে আসছে এইচসিআই। যদিও এনজিও ব্যুরো থেকে এইচসিআই-এর নামে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিকদের (এফডিএমএন) জন্য গৃহীত কোনো প্রকল্পের (এফডি-৭) অনুমোদন নেই। প্রান্তিক তাদের পরিচালিত শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও জীবিকায়ন প্রকল্পে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক এনজিও ওব্যাট হেলপারসকে দাতা সংস্থা হিসাবে এফডি-৭-এ উল্লেখ করছে। সরেজমিন ক্যাম্প ঘুরে দেখা যায়, ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ‘ডি’ ব্লকে প্রান্তিক পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রের নামফলকে দাতা সংস্থা হিসাবে ওব্যাট হেলপারসের লোগো থাকলেও নিচে সহযোগী হিসাবে এইচসিআই-এর লোগো আছে। একইভাবে এই ক্যাম্পে প্রান্তিক পরিচালিত একটি লার্নিং সেন্টারের দেওয়ালে অঙ্কন করা আছে এইচসিআই-এর লোগো। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২৫ জুন চাইল্ড সাপোর্ট প্রোগ্রাম (সিএসপি) নামে এইচসিআই-এর অর্থায়ন করা একটি প্রকল্পের মাধ্যমে ‘প্রান্তিক’ উখিয়ার একটি মাদ্রাসার ৫০ জন এতিম ছাত্র এবং ৪নং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ৩৫৩ জন রোহিঙ্গা শিশুর মাঝে কুরবানির ঈদ উপলক্ষ্যে খাদ্য, পোশাক, শিক্ষাসামগ্রী বিতরণ করে। রোজার ঈদেও তাদের খাদ্য সহায়তা দেয় প্রান্তিক। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এই সংস্থার (প্রান্তিক) শিক্ষা প্রকল্পে কর্মরত এক শিক্ষক জানান, সিএসপি প্রকল্পের আওতায় সহায়তাপ্রাপ্ত ৩৫৩ রোহিঙ্গা শিশুর একটি অনলাইন ডেটাবেজ রয়েছে, যা নিয়মিত হালনাগাদের মাধ্যমে এইচসিআইকে পাঠায় প্রান্তিক। এছাড়া প্রতিমাসে ওই শিশুদের সঙ্গে এইচসিআই-এর দাতাদের ভার্চুয়াল কনফারেন্স হয়। এভাবে সহায়তার নামে মাদ্রাসার এতিম ছাত্র ও রোহিঙ্গা শিশুদের মাঝে এইচসিআইসহ বিতর্কিত সংস্থাগুলো জঙ্গিবাদের বীজ রোপণ করছে কি না, সেই প্রশ্নই উঠেছে। শুধু তাই নয়, রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাস ঠেকাতে বেশ কয়েকটি আন্তর্জাতিক দাতব্য সংস্থা কাজ করছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী কার্যক্রমে সহায়তা করছে যাতে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী হিসাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরে আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের গণহত্যা ও জাতিগত নিপীড়নের বিচার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করা যায়। তাই দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে ওঠার আগে সন্দেজনক ও বিতর্কিত এসব সংস্থাকে ক্যাম্প থেকে বের করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছে সচেতন মহল। ২০১৯ সালের আগস্টে গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনের ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো তালিকা ধরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ওব্যাট হেলপারসসহ বিতর্কিত ৪১টি এনজিওর কার্যক্রম সাময়িক নিষিদ্ধ করে এনজিওবিষয়ক ব্যুরো। এরপরও বিভিন্নভাবে এসব এনজিও কার্যক্রম পরিচালনা করছে। চলতি বছর ৭ ও ৯ মার্চ এইচসিআই-এর বর্তমান প্রধান ড. ইরফান শেখের নেতৃত্বে ১২ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল কানাডা থেকে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রান্তিকের কার্যক্রম পরিদর্শনে এসেছিল বলে জানা গেছে। জানতে চাইলে প্রান্তিকের প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর অনিমেষ বিশ্বাস অটল বলেন, ‘যেহেতু এইচসিআইকে সরকার কাজ করার সুযোগ দিচ্ছে, তাই এ ব্যাপারে সরকারই ভালো বলতে পারবে। আমাদের এখানে যখন কোনো ফান্ড আসে, সেটা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে অনুমোদন হয়ে আসে।’ তিনি বলেন, ‘এটা সরকার জেনেশুনে বুঝে অনুমোদন দিয়েছে এবং অনুমোদন দেওয়ার আগে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ বিষয়ে তদন্ত করে। আমারা তো শুধু বাস্তবায়ন অংশীদার। জঙ্গিবাদে অর্থায়নের অভিযোগ প্রসঙ্গে অনিমেষ বিশ্বাস অটল বলেন, ‘এটা অনেক বড় ও কঠিন প্রশ্ন। এর উত্তর দেওয়ার এখতিয়ার আমার নেই। আমার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এ প্রশ্নের জবাব ভালো দিতে পারবে।’ বিতর্কিত দাতব্য সংস্থাটির বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসক মো. শাহীন ইমরান বলেন, ‘ক্যাম্পে কার্যক্রম করতে গেলে এনজিও ব্যুরোর অনুমোদনের প্রয়োজন হয়। সংস্থাটির যদি অনুমোদনও থাকে; কিন্তু বিদেশে জঙ্গি অর্থায়নের দায়ে যদি নিষিদ্ধ হয়ে থাকে, তাহলে এনজিও ব্যুরোর মাধ্যমে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এইচসিআই-এর কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, ‘সংস্থাটি ক্যাম্পে সরাসরি কাজ করছে না। আমাদের দেশের এনজিওর সঙ্গে পার্টনারে কাজ করছে। সংস্থাটির প্রতিনিধিরা শুধু তাদের কার্যক্রম ঠিকমতো হচ্ছে কি না, তা দেখার জন্য হয়তো মাঝেমধ্যে পরির্দশনে আসেন।’ এ প্রসঙ্গে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর (অব.) এমদাদুল ইসলাম বলেন, সত্যিকার অর্থেই যদি দাতব্য সংস্থা বা এনজিওর কার্যক্রম বিতর্কিত হয় বা তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদের অভিযোগ থাকে, তাহলে ক্যাম্প থেকে দ্রুত বের করে দেওয়া উচিত। কারণ, এ ধরনের সংস্থা দেশের জন্য একদিন হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে।