‘ক্লার্ক’ পদোন্নতিতে ঘুসের দর ৭ লাখ টাকা

প্রকাশিতঃ জুলাই ১১, ২০২৩ | ৮:১০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সমবায় অধিদপ্তরে ‘অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর’ পদে পদোন্নতি দিতে ঘুসের দর উঠেছে ৭ লাখ টাকা। ফেল করার ছয় মাসের মধ্যেই ফের পরীক্ষার আয়োজন করে ৩৩১ জনকে পদোন্নতি দেওয়ার তোড়জোড় চলছে। প্রতিজনের কাছ থেকে ঘুস নেওয়া হয়েছে ৪ থেকে ৭ লাখ টাকা। সমবায় অধিদপ্তরে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যে বেপরোয়া ‘পঞ্চপাণ্ডব’ সিন্ডিকেট এ খাত থেকে অন্তত ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার টার্গেট করেছে। তাদের নেটওয়ার্ক মন্ত্রণালয় থেকে অধিদপ্তর পর্যন্ত বিস্তৃত। দুর্নীতি দমন কমিশন থেকে পাওয়া তথ্য ও নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে চাঞ্চল্যকর এসব তথ্য। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ বিধিমালা অনুযায়ী চলতি বছরের জানুয়ারিতে অফিস সহায়ক থেকে অফিস সহকারী (ক্লার্ক) পদে পদোন্নতির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেয় ৩৩১ জন। ফল প্রকাশের পর দেখা যায়, তাদের মধ্যে মাত্র একজন পাশ করেছেন। ১৮ জানুয়ারি পদোন্নতি কমিটি পরীক্ষার ফলাফলসহ রেজুলেশন করে উত্তীর্ণ প্রার্থীর অনুকূলে আদেশ জারির সিদ্ধান্ত দেয়। কিন্তু অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদার দীর্ঘদিন ফাইলটি আটকে রাখেন। তিনি ওই কর্মচারীর পদোন্নতির আদেশ জারি না করে ‘আলোচনা করুন’ লিখে ফাইলটি ফেরত দেন। পরবর্তী সময়ে ৬ জুন উত্তীর্ণ একমাত্র প্রার্থীর পদোন্নতির আদেশ জারি করা হয়। ওই আদেশে তারিখ দেওয়া হয় ১৩ এপ্রিল ২০২৩। আদেশ নম্বর ৩৯১-এ/ও। এর পাশাপাশি ফেল করা সবার পুনরায় পরীক্ষা নেওয়ার আদেশ দেন। ১৭ ও ১৮ জুলাই পরীক্ষার দিন ঠিক করে নোটিশ দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, এটা সমবায় অধিদপ্তরের নিয়োগ বিধিমালা ২০১০-এর পরিপন্থি। এই বিধিমালার তফশিল (৪৪নং ক্রমিক) অনুযায়ী যোগ্য প্রার্থী না পাওয়া গেলে সরাসরি নিয়োগের নিয়ম রয়েছে। জানতে চাইলে নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির প্রধান যুগ্মনিবন্ধক হাফিজুল হায়দার বলেন, ‘অনেক পদ খালি থাকায় পদোন্নতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এতে নিয়মের কোনো ব্যত্যয় হচ্ছে না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘ঘুস লেনদেনের অভিযোগে প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্তকে বদলি করা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলাও হয়েছে। দুদকের ভালো রিসোর্স আছে, তারা অবশ্যই দোষীদের শনাক্ত করতে পারবে।’ আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বাবলা দাশ গুপ্তের রাজবাড়ীতে অফিস না করার বিষয়টি আমার জানা নেই। এরকম হলে অবশ্যই তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বদলির পর তাকে অধিদপ্তরে কোনো কাজে ডাকা হয়নি।’ এদিকে প্রায় তিন বছর ধরে অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ শূন্য। যোগ্য প্রার্থী থাকার পরও এসব পদে পদোন্নতি দেওয়া হচ্ছে না। একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, মহাপরিচালক ও এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলে মিলে এসব পদে পদোন্নতির পথ বন্ধ করে রেখেছেন। কারণ, ঊর্ধ্বতন পদগুলোয় কাউকে পদোন্নতি দিলে সিন্ডিকেটের ইচ্ছামতো বাণিজ্য করা সম্ভব হবে না। জানতে চাইলে সমবায় অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদার বলেন, ‘অভিযোগকারীরা কখন আবার বলে ফেলবে বাবলা দাশ আমার ভগ্নীপতি কিংবা আমি বাবলা দাশের ভগ্নীপতি। বাবলা দাশের চেহারাও আমি দেখিনি। দুর্নীতিসহ নানা অভিযোগের কারণে তাকে বদলি করে দেওয়া হয়েছে। এখন মানুষের টাকা দেওয়ার যদি এত শখ হয়, দিক না বাবলা দাশকে, আমি কী করব। আমি যথেষ্ট সততার সঙ্গে কাজ করছি। আমি তো আর কমিটি না। কমিটির সভাপতি বা সদস্য যারা আছেন, তাদের নির্দেশনা দিয়েছি। তারা যথেষ্ট সতর্কতার সঙ্গে কাজ করছেন।’ জানা যায়, ঢাকার উপকণ্ঠের একটি উপজেলার এক নারী অফিস সহায়ক পদোন্নতির জন্য বাবলা দাশ গুপ্তের মাধ্যমে অগ্রিম ঘুস দিয়েছেন চার লাখ টাকা। পদোন্নতির পর চুক্তির বাকি তিন লাখ টাকা দেওয়ার কথা। সিলেট অঞ্চলের আরেক অফিস সহায়কের সঙ্গে পরিচয় গোপন করে আলাপ করেছেন এ প্রতিবেদক। আলাপকালে তিনি সরাসরি অধিদপ্তরে এসে বাবলার হাতে ঘুসের চার লাখ টাকা পৌঁছে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এরই মধ্যে এ ধরনের অন্তত ১৭১ জনের কাছ থেকে ঘুসের টাকা আদায় করা হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। অন্যদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে দরকষাকষি চলছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, অফিস সহকারী পদে পদোন্নতির জন্য যারা আবেদন করেছেন, তাদের অন্তত ২০০ জন গত ২ মাসে জিপিএফ (জেনারেল প্রভিডেন্ট ফান্ড) থেকে গৃহনির্মাণের কথা বলে ৩-৫ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন। যারা ঋণ নিয়েছেন, তাদের বেশ কয়েকজনের বাড়িতে গিয়ে নতুন ঘর নির্মাণের চিত্র দেখা যায়নি। প্রকৃতপক্ষে এই ঋণের টাকা ঘুস হিসাবে সিন্ডিকেটের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এত টাকা ঘুস দিয়ে অফিস সহকারী (পিওন) পদে পদোন্নতি নিয়ে কী লাভ-এমন প্রশ্নের জবাবে এক কর্মকর্তা বলেন, ‘একজন অফিস সহায়ক ২০তম গ্রেডে বেতন পেয়ে থাকেন। এ পদের একজন যে বেতন পান তাতে ঘুসের ৫/৭ লাখ টাকা তুলতে অন্তত ৫ বছর লেগে যাবে। তবে যারা ঘুস নেন, তারা কর্মচারীদের সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি ও ভবিষ্যতে কর্মকর্তা পদে পদোন্নতি পাইয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখান। এই লোভে পড়েই অফিস সহকারী পদে পদোন্নতির জন্য এত টাকা ঘুস দেন তারা।’ জানা যায়, সমবায় অধিদপ্তরে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্যে গড়ে ওঠা ‘পঞ্চপাণ্ডব’ সিন্ডিকেটের পেছনে থেকে কলকাঠি নাড়েন এক মন্ত্রীর ছেলে। সিন্ডিকেট প্রধান হিসাবে অভিযোগের তির খোদ মহাপরিচালক ড. তরুণ কান্তি শিকদারের দিকে। তার ‘কালেক্টর’ হিসাবে আছেন অধিদপ্তরের বহুল আলোচিত প্রশাসনিক কর্মকর্তা বাবলা দাশ গুপ্ত। নানা বিতর্কিত কর্মকাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পর দায় এড়াতে গত ফেব্রুয়ারিতে তাকে রাজবাড়ীতে বদলি করা হয়েছে। কাগজে-কলমে তিনি সেখানে যোগদান করলেও অফিসে যান না। অফিস না করার অপরাধে তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থাও নেওয়া হচ্ছে না। জানতে চাইলে রাজবাড়ী জেলা সমবায় অফিসার সেলিনা পারভীন বলেন, ‘উনি (বাবলা) দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মকর্তা। রাজবাড়ী জেলায় প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ নেই। তাকে এখানে সংযুক্তি দিয়েছে।’ তার হাজিরা সইয়ের তথ্য চাইলে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এখানে প্রশাসনিক কর্মকর্তার পদ নেই, সেহেতু হাজিরা খাতায় তার সই থাকে না। তবে অফিস করেন। সংযুক্তিতে থাকার কারণে অধিদপ্তর থেকেও ডাক পড়ে। মাঝেমধ্যে তিনি ঢাকার অফিসে যান, বসেন।’ জানা যায়, সিন্ডিকেটের অন্য সদস্যরা হলেন যুগ্মনিবন্ধক (প্রশাসন) রিক্তা দত্ত, চট্টগ্রামের যুগ্মনিবন্ধক আশীষ বড়ুয়া ও রংপুরের যুগ্মনিবন্ধক মৃণাল কান্তি বিশ্বাস। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ সিন্ডিকেটের নানা অনৈতিক বাণিজ্যে সহযোগিতা করেন অধিদপ্তরে ‘ত্রীরত্ন’ হিসাবে পরিচিত নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির প্রধান যুগ্মনিবন্ধক হাফিজুল হায়দার, খুলনার যুগ্মনিবন্ধক মিজানুর রহমান এবং নিয়োগ ও পদোন্নতি কমিটির সদস্যসচিব উপনিবন্ধক আতিকুল ইসলাম। অভিযোগ আছে, সহযোগীদের মাধ্যমে মাঠ পর্যায় থেকে নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতির ঘুসের টাকা প্রথমে আসে বাবলা দাশ গুপ্তের কাছে। তার কাছ থেকে রিক্তা দত্তের মাধ্যমে পাঠানো হয় মহাপরিচালকের কাছে। এরপর সেখান থেকে কমিশন পৌঁছে যায় এক প্রতিমন্ত্রীর ছেলের কাছে। বক্তব্য নেওয়ার জন্য মিজানুর রহমান ও আতিকুল ইসলামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তাদের পাওয়া যায়নি। জানতে চাইলে যুগ্মনিবন্ধক (প্রশাসন) রিক্তা দত্ত বলেন, ‘আমি কোনো সিন্ডিকেটের সদস্য নই। কেউ বলতে পারবে না আমার হাতে কোনোদিন একটা টাকা দিয়েছে। পদোন্নতির জন্য টাকা লেনদেন হতে পারে। কিন্তু অবৈধ টাকা আমি কোনোদিন হাত দিয়ে ধরিনি। এই যে আমি এত বদলি করি। বদলি হয়ে যায়। কেউ বলতে পারবে না আমাকে টাকা দিয়ে বদলি হচ্ছে।’