নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে খেলাপি ঋণের লাগাম টানা যাচ্ছে না। বেড়েই চলেছে মন্দ ঋণ। চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার (১৭ হাজার ৮৫৫) কোটি টাকা, যা বিতরণ করা ঋণের ২৫ শতাংশ। বছরের প্রথম প্রান্তিকে ৩৫ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ২৬টিতেই খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এরমধ্যে ৬টির প্রায় দেউলিয়া অবস্থা। যেগুলোর খেলাপি ৮০ থেকে ৯৯.৬২ শতাংশ। বাকি তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি অপরিবর্তিত আছে এবং কমেছে ৬টিতে। বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে উঠে এসেছে এসব তথ্য। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, এসব প্রতিষ্ঠান রাখবে নাকি বন্ধ করবে সে বিষয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কারণ এখানে অনেক আমানতকারীর আমানত আছে। আর আমানতরে সুরাক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। তা না হলে আমানতকারীরা কোথায় যাবেন। এ বিষয়ে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এভাবে একটা খাত চলতে পারে না। এটা নিয়ে বিশদ গবেষণা বা পর্যালোচনা হওয়া দরকার। গভীরভাবে ভাবতে হবে। প্রয়োজনে বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করতে পারে। কিন্তু কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অন্যদিকে আমানতকারীরা পথে বসে যাচ্ছেন। এটা কিছুতেই হতে পারে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণস্থিতি ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ ৩ মাসে ঋণ বেড়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা। মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণস্থিতি ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত খেলাপি ঋণস্থিতি ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চ পর্যন্ত খেলাপি ঋণস্থিতি ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে ১ বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা। ২৬টি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ফনিক্স ফাইন্যান্সের। ৩ মাসে প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি বেড়েছে ৩৬০ কোটি টাকা। এরপরই অবস্থান ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের। প্রতিষ্ঠানটির খেলাপি বেড়েছে ১৫৫ কোটি টাকা। খেলাপি বৃদ্ধির দিক থেকে তৃতীয় অবস্থানে থাকা প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ফাইন্যান্সের বেড়েছে ১০৪ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, সরকারি প্রতিষ্ঠান ইডকলের খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৯৪ কোটি টাকা, বে লিজিংয়ের ৯৩ কোটি টাকা, বিআইএফএফএলের ৭১ কোটি টাকা, লংকাবাংলার ৬৭ কোটি টাকা, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সের ৫২ কোটি টাকা, আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ৪৩ কোটি টাকা, ফার্¯¡ ফাইন্যান্সের ৩৭ কোটি টাকা, মাইডাস ফাইন্যান্সের ৩০ কোটি টাকা, আইআইডিএফসি’র ২৯ কোটি টাকা, পিপলস লিজিংয়ের ২৫ কোটি টাকা, মেরিডিয়ান ফাইন্যান্সের ২৫ কোটি টাকা খেলাপি বেড়েছে। এছাড়া খেলাপি বাড়ার তালিকায় আরও রয়েছে অগ্রণী এসএমই, আভিভা ফাইন্যান্স, বিআইএফসি, সিভিসি ফাইন্যান্স, ডেল্টা ব্র্যাক হাউজিং, জিএসপি ফাইন্যান্স, ইসলামিক ফাইন্যান্স, লংকান অ্যালায়েন্স, ন্যাশনাল ফাইন্যান্স, ন্যাশনাল হাউজিং, প্রাইম ফাইন্যান্স এবং ইউনাইটেড ফাইন্যান্স। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৬টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি কমেছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কমেছে এফএএস ফাইন্যান্সের। প্রতিষ্ঠানটির ৩ মাসে খেলাপি কমেছে ৯১ কোটি টাকা। উত্তরা ফাইন্যান্সের খেলাপি কমেছে ৮৯ কোটি টাকা। প্রিমিয়ার লিজিংয়ের খেলাপি কমেছে ৪৭ কোটি টাকা। এছাড়া হজ ফাইন্যান্সের প্রায় ১৯ কোটি টাকা, ফারইস্ট ফাইন্যান্সের ৪ কোটি টাকা এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটালের খেলাপি কমেছে ১ কোটি টাকার বেশি। তবে এ সময়ে তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি অপরিবর্তিত ছিল। এগুলো হচ্ছে-সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড অ্যাগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি, স্ট্র্যাটেজিক ফাইন্যান্স এবং দ্য ইউএই-বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি। জানা গেছে, আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য টানা ৩ বছর ডেফারেল সুবিধা ছিল। ডেফারেল বা বিশেষ সুবিধা নিয়ে অনেকে খেলাপি থেকে মুক্ত ছিল। এ সুবিধা তুলে নেওয়ার কারণে আবার তারা খেলাপি হয়ে গেছে। ফলে জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এছাড়া গত ডিসেম্বর শেষে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খেলাপি ঋণের যে তথ্য দিয়েছিল, তা নিরীক্ষিত ছিল না। তাই পরে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিদর্শনে কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণখেলাপি করে দেওয়া হয়। এ কারণেও খেলাপি ঋণ বেড়েছে বলে খাতসংশ্লিষ্টরা জানান। একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বলেন, গত ৩ বছর ডেফারেল সুবিধা ভোগ করেছেন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকরা। সে সুবিধা নিয়ে অনেকে খেলাপিমুক্ত ছিলেন। হঠাৎ সুবিধা তুলে নেওয়ায় আবার খেলাপি হয়ে গেছেন সুবিধাভোগীরা। ফলে মার্চ প্রান্তিকে পুরো খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এছাড়া ব্যবসা-বাণিজ্য খারাপ থাকার কারণে অনেকে ঋণ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি। তবে সর্বোপরি ঋণ দেওয়ার সময় যাচাই-বাছাই না করার কারণেই এ খাতে খেলাপি ঋণের হার বেশি।