সংকট উত্তরণ কোন পথে

প্রকাশিতঃ জুলাই ১৪, ২০২৩ | ৮:২৮ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

কোন পথে যাচ্ছে রাজনীতি? জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে চলমান রাজনৈতিক সংকট উত্তরণের পথ বের হবে, নাকি আরও জটিল হবে? অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে বিদেশিদের চাপের মুখে– এমন প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। অবশ্য গত বুধবার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিরোধী দল বিএনপির সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হলেও ‘এক দফার জবাবে এক দফা’ ঘোষণায় আরও অস্বস্তি বেড়েছে জনমনে। এ পরিস্থিতিতে নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘ তিন দশকের চলমান মতবিরোধ নিরসনের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে পড়ছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বিদেশি কূটনীতিকদের চাপে দু’পক্ষই আপাতত রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে নিজেদের বিরত রেখেছে। কিন্তু আগামী সংসদ নির্বাচনের আগে দু’পক্ষ ন্যূনতম সমঝোতায় পৌঁছাতে না পারলে সংঘাত অনিবার্য। রাজনীতিতে এক দফা বলে কিছু নেই, জনকল্যাণে থাকতে হবে সমঝোতা। বুধবার ঢাকায় মাত্র এক কিলোমিটার দূরত্বে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সমাবেশ হলেও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনার খবর মেলেনি। দীর্ঘদিন ধরেই রাজপথের বিরোধী দল বিএনপি রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনে প্রশাসনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুললেও এবারের পরিস্থিতি ছিল ভিন্ন। তবে এই সমাবেশ থেকে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে বলেছেন, শেখ হাসিনাকে পদত্যাগ করে নির্বাচন দিতে হবে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, শেখ হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী রেখেই তারা সংবিধান মেনে আগামী নির্বাচন করতে চান। এটাই তাদের এক দফা। প্রকাশ্যে দু’পক্ষ অনড় থাকলেও বিশ্লেষকরা মনে করেন, রাজনীতিতে অনড় অবস্থানের কোনো জায়গা নেই। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সমাধান বের করাই আসলে রাজনীতি। পর্দার আড়ালে আলোচনা করে হলেও সমাধানের ন্যূনতম পথ খুঁজে বের করতে হবে। অন্যথায় সৃষ্ট পরিস্থিতি উভয় পক্ষের জন্য অশুভ বার্তা বয়ে আনতে পারে। অনেকেই বলছেন, ঢাকায় পশ্চিমা কূটনীতিকদের অবস্থানের মধ্যে বড় দু’দলের পাল্টাপাল্টি সমাবেশ ছিল নিজেদের শক্তি প্রদর্শন। তাই দু’পক্ষই সংঘাত এড়িয়ে চলছে। তবে এই পরিস্থিতি নির্বাচন পর্যন্ত বহাল থাকবে, তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল অব বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বড় দুই দলের এমন শান্তিপূর্ণ সমাবেশ অব্যাহত থাকবে– এমন প্রত্যাশা ব্যক্ত করে বলেন, পাল্টাপাল্টি সমাবেশের প্রতিযোগিতা আমাদের রাজনীতির সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। কিন্তু রাজনীতিতে অনড় অবস্থানের কোনো সুযোগ নেই। আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়েই সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। তিনি বলেন, ‘জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস’– এটা শুধু সংবিধানে থাকলে চলবে না। প্রকৃতপক্ষে মানুষের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জনগণকে ক্ষমতায়িত করতে হবে। বিদেশিদের দিকে তাকিয়ে থাকার সুযোগ নেই। কারণ, নির্বাচন আমাদের জাতীয় ইস্যু। জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হলে দীর্ঘ মেয়াদে রাজনীতিতে কোনো সুফল মিলবে না। রাজনৈতিক শক্তিগুলো যখনই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে, তখনই অন্য কেউ ক্ষমতার দিকে ঝুঁকে সেটা কাজে লাগাতে চায়। এ জন্য বর্তমানে রাজনীতিবিদদের বিদেশি কূটনীতিকদের কাছে ধরনা দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন তিনি। নব্বইয়ের দশক থেকেই দেশে নির্বাচনকালীন সরকার ব্যবস্থা নিয়ে বিরোধে জড়িয়েছে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক পক্ষ। মাঝখানে জাতীয় সংসদের চারটি নির্বাচন নির্দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হলেও বাকিগুলো অনুষ্ঠিত হয় দলীয় সরকারের অধীনে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পাল্টাপাল্টি অবস্থানের মধ্যেই ২০০৭ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত সরকার ক্ষমতা দখল করে রাখে। ২০১১ সালে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতি বিলুপ্ত হওয়ার পরে আবারও নির্বাচন নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ রাজপথে চলে আসে। সাবেক নির্বাচন কমিশনার ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, নির্বাচন এলেই রাজনৈতিক অস্থিরতার বিষয়টি সামনে চলে আসে। সংঘাতময় পরিস্থিতির আশঙ্কা তৈরি হয়। এর কারণ ক্ষমতায় যাওয়া এবং ক্ষমতায় টিকে থাকাকেই রাজনীতিবিদরা একমাত্র লক্ষ্য নির্ধারণ করে ফেলেছেন। রাজনৈতিক দলগুলো নিজেরা আলোচনার টেবিলে বসে সংকটের সমাধান করতে পারলে এ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব বলে মন্তব্য করেন তিনি। নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করে বিএনপি। ২০১৮ সালে একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলেও কারচুপির অভিযোগ তুলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেয় দলটি। শুরু থেকেই এই বিরোধে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে জাতিসংঘসহ নানা বিদেশি শক্তি ভূমিকা রেখেছে; কিন্তু স্থায়ী কোনো সমাধান মেলেনি। সর্বশেষ ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে দু’পক্ষের সমঝোতায় ঢাকা এসেছিলেন জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো। এবার নির্বাচনের আগে পশ্চিমা দেশগুলোর কূটনীতিকদের তৎপরতা রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়াচ্ছে। সবচেয়ে আলোচনায় রয়েছে বাংলাদেশিদের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি। বুধবার দু’দলের সমাবেশ শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হওয়ার পেছনে মার্কিন ভিসা নীতি যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছে বলে দাবি করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি মনে করেন, ভবিষ্যতেও এ ধারা অব্যাহত থাকবে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসা নীতি বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত যে কোনো ব্যক্তির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে। অন্য অনেকের সঙ্গে বাংলাদেশের বর্তমান বা সাবেক কর্মকর্তা-কর্মচারী, সরকারের সমর্থক এবং বিরোধী দলের সদস্যরা এর অন্তর্ভুক্ত। এ ধরনের ব্যক্তিদের নিকটতম পরিবারের সদস্যরাও এর অন্তর্ভুক্ত থাকবেন। এই ভিসা নীতির কারণে হয়তো কেউ আর আগের মতো সংঘাত বা ধ্বংসাত্মক কর্মসূচিতে যাবে না। দু’পক্ষের অনড় অবস্থান ঘোষণার বিষয়ে বদিউল আলম মজুমদার আরও বলেন, রাজনীতি হচ্ছে আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময়ের মাধ্যমে সমস্যার সমাধান করা। এর জন্যই কিছু নিয়মনীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা রয়েছে। দু’পক্ষের এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থান অপরাজনীতি এবং চর দখল প্রচেষ্টার শামিল। ব্রতীর প্রধান নির্বাহী শারমিন মুর্শিদ বলেন, দু’পক্ষের এমন অনড় অবস্থানে নাগরিক সমাজ আতঙ্কিত না হয়ে পারে না। এমন পাল্টাপাল্টি অবস্থানের কারণে আগামী সংসদ নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে কিনা, তা নিয়ে মানুষের মধ্যে সংশয় বাড়ছে। তিনি বলেন, কয়েক মাস পরই নির্বাচন। এ মুহূর্তে অনড় অবস্থান ঘোষণা কেন হবে? এক দফা বলে কিছু নেই রাজনীতিতে। রাজনীতিতে থাকতে হবে সমঝোতা। এত তাড়াতাড়ি এক দফা ঘোষণা দেওয়া এক ধরনের অকালপক্বতা। তিনি বলেন, দুই দলকেই নিজ উদ্যোগে জনগণের কথা ভেবে আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় আসতে হবে। এ ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বড় ভূমিকা নেওয়া উচিত এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, দুই দল গোঁ ধরলে তার মাশুল সাধারণ মানুষকে দিতে হতে পারে।