এক দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে আরও ১ হাজার ২৩৯ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। এ নিয়ে টানা তিন দিন হাজারের বেশি মানুষের শরীরে ডেঙ্গু শনাক্ত হলো। আক্রান্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মৃত্যুও। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। ডেঙ্গুর এমন পরিস্থিতিতে রোগীদের মানসম্মত চিকিৎসা নিশ্চিত এবং অব্যবস্থাপনা বন্ধে সব বেসরকারি হাসপাতালে পাঁচ দফা নির্দেশনা দেয় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তবে সরকারের এমন নির্দেশনা কোনো চিকিৎসাকেন্দ্রেই পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন হতে দেখা যাচ্ছে না। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের ইচ্ছে মতো চলছে সেবা কার্যক্রম। রাজধানীর একাধিক সরকারি চিকিৎসাকেন্দ্র ঘুরে মিলেছে এমন তথ্য। জনস্বাস্থ্যবিদরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের নজরদারি না থাকায় এমনটা হচ্ছে। রোগীর সঠিক ব্যবস্থাপনার সংকটের কারণে যত দিন যাচ্ছে, ডেঙ্গু তত বাড়ছে। সঠিকভাবে রোগী ব্যবস্থাপনা ও যথাযথ মশা নিধন অভিযান না হলে ডেঙ্গুর লাগাম টানা চ্যালেঞ্জ হবে। এদিকে ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষ চালু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। গতকাল বৃহস্পতিবার সকালে করপোরেশনের প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের শীতলক্ষ্যা হলে ডিএসসিসি মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস এই কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ কক্ষের উদ্বোধন করেন। এ ছাড়া ডেঙ্গু পরিস্থিতিকে ‘জাতীয় দুর্যোগ’ ঘোষণা করে সারাদেশে সমন্বিত উদ্যোগ ও আক্রান্তদের সেবা দেওয়ার প্রয়োজনীয় উদ্যোগের দাবি জানিয়েছে বিএনপি সমর্থক চিকিৎসকদের সংগঠন ডক্টরস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ড্যাব)। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, গত রোববার থেকে গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ছয় দিনে দেশে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন যথাক্রমে ৮২০, ৮৩৬, ৮৮৯, ১ হাজার ৫৪, ১ হাজার ২৪৬ এবং ১ হাজার ২৩৯ জন। এ বছর গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৯৩ জন। এর মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম ১৩ দিনে মৃত্যু হয়েছে ৪৬ জনের। ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে সর্বশেষ ২৪ ঘণ্টায় ভর্তি হয়েছেন ৭৫৬ জন। আর ঢাকার বাইরের বিভিন্ন হাসপাতালে আরও ৪৮৩ জন। জুলাইয়ের এখন পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৯ হাজার ৪০৪ জন। সব মিলিয়ে এ বছর ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা ১৭ হাজার ৩৮২। গতকাল পর্যন্ত হিসাবে দেশের সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন ৪ হাজার ৫৯ জন। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার ৫৩ হাসপাতালে এখন ডেঙ্গু রোগী রয়েছেন ২ হাজার ৭০৮ জন। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ডেঙ্গু রোগী ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা গাইডলাইন করে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে দেওয়া হয়েছে। চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণও চলছে। রোগীর চিকিৎসা নিশ্চিতে সরকারি হাসপাতালে সেবার পরিধি বাড়ানো হয়েছে। সর্বশেষ গত বুধবার অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক ডা. দাউদ আদনান স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে প্রত্যেক সরকারি স্বাস্থকেন্দ্রে আলাদা জনবল দিয়ে ডেঙ্গু ইউনিট খুলতে বলা হয়েছে। পাশাপাশি মেডিকেল কলেজ ও বিশেষায়িত হাসপাতালে ডেঙ্গু ওয়ার্ড চালু, নতুন গাইডলাইন অনুসারে রোগী ব্যবস্থাপনা, শতভাগ রোগীকে মশারির মধ্যে রেখে চিকিৎসা দেওয়া এবং প্রয়োজনী পরীক্ষার ব্যাপারে সহায়তার কথা বলা হয়েছে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে গিয়ে দেখা গেছে, আগের মতোই অন্য রোগীর সঙ্গে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসাসেবা দেওয়া হচ্ছে। চাপ সামাল দিতে রোগীদের মেঝেতেও রাখতে হচ্ছে। রোগীর এত চাপের পরও করা হয়নি আলাদা ইউনিট বা ওয়ার্ড। অন্য রোগীর সঙ্গে চলছে ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসা। একজন রোগীর শয্যায়ও মশারি নেই। অধিদপ্তর থেকে যেসব মশারি দেওয়া হয়েছে তারও হদিস নেই। মানা হচ্ছে না রোগী ব্যবস্থাপনার গাইডলাইন। হাসপাতালের চারটি মেডিসিন ওয়ার্ডেরই একই অবস্থা। সব মিলে ঢামেক হাসপাতালে ২৩০ জন ভর্তি আছেন। যাদের কেউ কেউ ঢাকার বাইরে থেকে এসেছেন। ৬০২ নম্বর ওয়ার্ডে দায়িত্বরত এক চিকিৎসক বলেন, হাসপাতালে এ ধরনের কোনো নির্দেশনা আসেনি। ঢামেক হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নাজমুল হককে ফোন দেওয়া হলে তিনি ছুটিতে থাকায় এ বিষয়ে কেনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালেও ডেঙ্গুর জন্য আলাদা কোনো ইউনিট করা হয়নি। মানা হচ্ছে না গাইডলাইন। হাসপাতালের মেডিসিনের আট ইউনিটের সবগুলোতেই অন্য রোগীর সঙ্গে ডেঙ্গু আক্রান্তরা ভর্তি। পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী মো. রশিদ-উন-নবী বলেন, অন্য রোগীর চাপ ও স্থান সংকটে মিটফোর্ড হাসপাতালে ডেঙ্গুর আলাদা ইউনিট করা সম্ভব নয়। অন্য নির্দেশনাগুলো মানার চেষ্টা করছি। রোগীর চাপ বাড়ছে বিশেষায়িত ডেঙ্গু হাসপাতালে মহাখালী ডিএনসিসি করোনা হাসপাতালকে ডেঙ্গু বিশেষায়িত করার পর সেখানে প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে । গতকাল এক দিনে ৪২ জন ভর্তি হয়েছেন। এখন ৫৯ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালের পরিচালক কর্নেল এ কে এম জহিরুল হোসাইন খান বলেন, ডেঙ্গু বিশেষায়িত ঘোষণার পর থেকেই রোগীর চাপ বাড়ছে। রোগীর চাহিদা অনুযায়ী শয্যা প্রস্তুত করা হয়েছে। বাড়তি রোগীর চাপ সামলাতে ৩৬ জন চিকিৎসক এবং ৮০ জন নার্স নিয়োগে চাহিদাপত্র দেওয়া হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব হেলথ সায়েন্সেসের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী বলেন, সতর্ক করা না গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। গতবারের চেয়ে যেভাবে সংক্রমণ ও মৃত্যু বেড়েছে, সেভাবে সতর্কতা ও প্রস্তুতি নিতে দেখা যাচ্ছে না। এখানে সংশ্লিষ্টদের মাঝে মতদ্বৈততার সমস্যা দেখা যাচ্ছে। নগর স্বাস্থ্যে এটি একটি মারাত্মক সমস্যা সৃষ্টি করবে। সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা মেনে রোগী ব্যবস্থাপনা দরকার। সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে ডেঙ্গু পরীক্ষা করা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। জটিল রোগী ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়িত হাসপাতালগুলোকে প্রস্তুত করা না গেলে সামনে পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আহমেদুল কবির বলেন, পরীক্ষাসহ ডেঙ্গু চিকিৎসায় আমরা সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন করে দিয়েছি। সেই গাইডলাইন অনুযায়ী সবাইকে চিকিৎসা দিতে হবে। প্লাটিলেট ব্যবহার নিয়েও নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। নির্দেশনা অনুযায়ী রোগী ব্যবস্থাপনা না হলে প্রতিষ্ঠানের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।