রাজধানীর রামপুরা-প্রগতি সরণিতে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রতিক সময় এই সড়কে বাসে পিষ্ট হয়ে প্রাণ দিয়েছেন আবরার আহমেদ চৌধুরী, নাদিয়া এবং মইনুদ্দিনসহ অনেক শিক্ষার্থী। সবশেষ যুক্ত হলো জাহিদ হাসানের (২৪) নাম; যিনি চীনের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছিলেন। এ কারণে প্রশ্ন উঠেছে, এই রাস্তা কি শিক্ষার্থী নিধনের ফাঁদে পরিণত হয়েছে? তবে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগ জানিয়েছে, সড়কটি দিয়ে শিক্ষার্থীদের চলাচল বেশি। তাই শিক্ষার্থীরাই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। পথচারীদের সচেতনতার অভার, ওভারটেকিং এবং চালকদের অসচেতনতার কারণেই এখানে দুর্ঘটনা বেশি ঘটছে। জানা যায়, ২০১৯ সালের ১৯ মার্চ সকালে প্রগতি সরণিতে সুপ্রভাত পরিবহণের একটি বাসের চাপায় নিহত হন বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালের (বিইউপির) ছাত্র আবরার আহমেদ চৌধুরী (২০)। এই আবরারই ছিলেন সড়ক দুর্ঘটনার বিরুদ্ধে সোচ্চার কণ্ঠ। ২০১৮ সালের ২৯ জুলাই কুর্মিটোলায় রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের দুই শিক্ষার্থী দিয়া আক্তার মিম ও আব্দুল করিম সজীব নিহত হওয়ার পর গড়ে ওঠা ছাত্র আন্দোলনের সামনের কাতারে ছিলেন আবরার। নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের দাবিতে প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে দাঁড়ানো তার একটি ছবি ওই সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এতে লেখা ছিল-‘হ্যালো/হানি বানি/ চলো/আইন মানি।’ এর সাত মাসের মাথায় প্রগতি সরণির বসুন্ধরা গেটের সামনে বাসচাপায় নিহত হন তিনি। আবরারের মৃত্যুর পর বসুন্ধরা আবাসিক গেট এলাকায় প্রধান রাস্তা অবরোধ করেন বিইউপির শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনে যোগ দেন নর্থ সাউথ, ইস্টওয়েস্ট, ইনডিপেনডেন্ট ও আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিসহ বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও। তাদের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে রাজধানী। বেশ কয়েকদিন আন্দোলন চলার পর বসুন্ধরার গেটে আবরারের নামে একটি ফুট ওভারব্রিজ তৈরিসহ শিক্ষার্থীদের ১২ দফা দাবি মেনে নেওয়ায় আন্দোলন প্রত্যাহার হয়। পরে আবরারের নামে ঘটনাস্থলে একটি ফুট ওভারব্রিজ তৈরি হলেও অন্যান্য দাবি পূরণ হয়নি। এ কারণে একটির পর একটি দুর্ঘটনা বাড়ছেই। গত বছরের ২৯ নভেম্বর রাতে রাজধানীর রামপুরায় বাসচাপায় মইনুদ্দিন নামে এক শিক্ষার্থী নিহত হন। এ কারণে বিক্ষুব্ধ জনতা সড়ক অবরোধ করে ব্যাপক ভাঙচুর ও বাসে অগ্নিসংযোগ করে। আট থেকে ১০টি বাসে অগ্নিসংযোগসহ অর্ধশত গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। এ সময় মালিবাগের আবুল হোটেলের সামনে থেকে রামপুরা পর্যন্ত রাস্তা বন্ধ হয়ে যায়। চলতি বছরের ২২ জানুয়ারি প্রগতি সরণিতে ভিক্টর বাসের ধাক্কায় নাদিয়া নামের এক শিক্ষার্থী প্রাণ হারান। তিনি একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন। প্রগতি সরণিতে বন্ধুর সঙ্গে মোটরসাইকেলে করে যাচ্ছিলেন ওই শিক্ষার্থী। ভিক্টর পরিবহণের একটি বাস পেছন থেকে ধাক্কা দিলে ছিটকে বাসের নিচে পড়ে যান নাদিয়া। বাসের পেছনের চাকায় পিষ্ট হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান তিনি। গত বৃহস্পতিবার বিকালে ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহণের একটি বাসের ধাক্কায় রামপুরা ইউলুপের নিচে নিহত হন শিক্ষার্থী জাহিদ হাসান (২৪)। তিনি চীনের নর্থ চায়না ইলেকট্রিক পাওয়ার ইউনিভার্সিটির বিএসসি ইঞ্জনিয়ারিংয়ের ছাত্র ছিলেন। জাহিদকে পিষ্ট করার পর ঘাতক বাসটি পালানোর জন্য হাতিরঝিলের রাস্তায় ঢুকে পড়ে। সেখানে চাপা দেয় মেহেদী হাসান পারভেজ নামের এক প্রতিবন্ধী শিশুকে। এতে ঘটনাস্থলেই মারা যায় শিশুটি। আর ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিলে মৃত ঘোষণা করা হয় শিক্ষার্থী জাহিদকে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এএইচএম আজিমুল হক বলেন, সড়ক দুর্ঘটনায় শিক্ষার্থী ও শিশু নিহতের ঘটনায় গাড়িটি জব্দ করা হয়েছে। চালক ও হেলপারকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানায় মামলা হয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। জানতে চাইলে ট্রাফিক বিভাগের প্রধান ও ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মুনিবুর রহমান বলেন, গাড়ির ব্রেক ফেল করার কারণে বৃহস্পতিবারের দুর্ঘটনাটি ঘটে। যে কোনো স্থানে যে কোনো সময় এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতেই পারে। ট্রাফিক ম্যানেজমেন্টের ত্রুটির কারণে ঘটছে তা বলার অবকাশ নেই। তিনি বলেন, বৃহস্পতিবার শিক্ষার্থীকে চাপা দেওয়ার পর গাড়িটি কন্ট্রোল করতে পারছিল না চালক। ওই ঘটনায় যে শিশু মারা যায় সে প্রতিবন্ধী ছিল। সুস্থ শিশু হলে সে হয়তো প্রাণে রক্ষা পেত। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘রামপুরা-প্রগতি সরণির এলাকায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বেশি। তাই অন্য এলাকার তুলনায় এই এলাকায় শিক্ষার্থীরা বেশি সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন।’ ট্রাফিক প্রধান মুনিবুর রহমান বলেন, ‘সড়ক দুর্ঘটনা রোধে আমাদের সচেতনতামূলক কার্যক্রম অব্যাহত আছে। যেসব জায়গায় আগে বেশি দুর্ঘটনা ঘটত ওইসব এলাকায় এখন ফুট ওভারব্রিজের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তারপরও মানুষ একটু কষ্ট করে ফুট ওভারব্রিজে না উঠে নিচ দিয়ে রাস্তা পারাপারে চেষ্টা করছে। এটাও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। এছাড়া চালকদের অসচেতনতা এবং ওভারটেকিং প্রবণতা আছেই। ওভারটেকিংয়ের কারণেই আবরার হত্যাকাণ্ড ঘটে। নাদিয়া নিহতের ঘটনায় মোটরসাইকেল চালকের অসাবধানতা ছিল।’