মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের সফরকে খুবই ইতিবাচক হিসাবে অভিহিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক উন্নয়ন এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ অভ্যন্তরীণ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া উভয় ক্ষেত্রে এই সফর গঠনমূলক। তারা অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে সহায়তা করতে চায়। বিশেষজ্ঞরা এটাও মনে করেন যে, উজরা জেয়ার প্রতিনিধিদলের বার্তাকে ক্রমাগত চর্চার মধ্যে রাখতে হবে। এতে করে বাংলাদেশের সামনে পথচলা মসৃণ হবে। যুক্তরাষ্ট্রের এখন মূল টার্গেট ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থ রক্ষা করা। সেই লক্ষ্যেই তারা কাজ করবে। বেসামরিক নিরাপত্তা, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন ছয় সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধিদলটি দক্ষিণ এশিয়ায় দুই দেশ সফরের অংশ হিসাবে প্রথমে ভারত ও পরে বাংলাদেশ সফর করেছে। প্রতিনিধিদলে অন্যান্যের মধ্যে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু এবং মার্কিন সাহায্য সংস্থা ইউএসএআইডির সহকারী প্রশাসক অঞ্জলী কৌর অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। চার দিনের সফর শেষে শুক্রবার সকালে প্রতিনিধিদলটি ঢাকা ত্যাগ করেছে। সফরকালে প্রতিনিধিদলটি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেছে। এছাড়া আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি খাতবিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিসহ বিভিন্নস্তরে বৈঠক করেছে। এছাড়া প্রতিনিধিদলটি কক্সবাজারে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সরেজমিন পরিদর্শন করেছে। রোহিঙ্গাদের উন্নয়নে অনুদান ঘোষণাসহ সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কূটনীতিক বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত দেশগুলোর কূটনীতির সঙ্গে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর কূটনীতি এক হবে না। তারা প্রযুক্তিগত দিক দিয়ে অনেক এগিয়ে। আমরা তাদের কাছ থেকে ধার করা প্রযুক্তি নিয়ে চলে থাকি। তাই আমাদের ভাষাও এক হবে না। ২০০৭ সালে ওয়ান-ইলেভেনের সময়ে তদানীন্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্যাট্রিসিয়া বিউটেনিস দৌড়ঝাঁপ করলেও ওয়ান-ইলেভেন আনতে মার্কিন নীতি কাজ করেছে নীরবে। ফলে মার্কিন প্রতিনিধিদলের সফর থেকে অনেক বেশি প্রত্যাশা, হতাশা কিংবা উৎফুল্ল হওয়ার কারণ নেই। তারা তাদের নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রাখতে বিভিন্ন দেশে কাজ করে। এই সফরের মূল বিষয়টি উজরা জেয়ার টুইটে লুকায়িত আছে। টুইটে স্পষ্ট ইঙ্গিত আছে যে, ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ এবং নিরাপত্তা এজেন্ডা বাস্তবায়ন হলো মূল টার্গেট। জানতে চাইলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির শুক্রবার বলেন, এই ধরনের সফর সব সময়ই ইতিবাচক ফলাফল নিয়ে আসে। এবারও তাই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ দায়িত্বশীল লোকজনের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পেও গিয়েছে। এছাড়া উজরা জেয়ার নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদল বাংলাদেশে অবস্থানকালে দুই বড় দল দুটি সমাবেশ করেছে। প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছেন। সাবেক এই রাষ্ট্রদূত আরও বলেন, দুই দেশের সম্পর্কের বয়স ৫০ বছর। আগামী ৫০ বছরে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন যা খুবই ইতিবাচক। এ থেকে স্পষ্ট যে, আমরাই শুধু যুক্তরাষ্ট্রকে মূল্যায়ন করি এমন নয়; বরং আমাদেরও যুক্তরাষ্ট্র মূল্যায়ন করে থাকে। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ের মধ্যে আগামী নির্বাচন যাতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক হতে পারে সেই লক্ষ্যে বাংলাদেশকে সহায়তা করার আগ্রহ ব্যক্ত করেছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন করার যে অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন; তার প্রতি যুক্তরাষ্ট্র আস্থা রাখছে। এটা সরকারের ওপর এক ধরনের চাপের সৃষ্টি করেছে। এম হুমায়ুন কবির বলেন, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, মানবাধিকার, সমঅধিকার প্রভৃতি বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন। রোহিঙ্গা ইস্যুতেও প্রতিনিধিদলটি মনোযোগী ছিল। রোহিঙ্গাদের জন্য ৭৪ মিলিয়ন ডলার অনুদান ঘোষণা করেছে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়েও তিনি কথা বলেছেন। ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলে তাদের আগ্রহের কথা ব্যক্ত করেছেন এবং বাংলাদেশের ভূমিকা কামনা করেছেন। ফলে দ্বিপক্ষীয় ও অভ্যন্তরীণ রাজনীতি উভয় বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অংশীদারত্বের সঙ্গে কাজ করতে পারবে। সফরে ভবিষ্যৎমুখী বাংলাদেশের প্রতিই অধিক গুরুত্ব লাভ করেছে। আঞ্চলিক অগ্রাধিকারের বিষয়ে বেশ গুরুত্ব লাভ করেছে। তিনি বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদলের সফর ইতিবাচক যে বার্তা নিয়ে এসেছে তা কতটা আমাদের জন্য সহায়ক হবে তা নির্ভর করবে সেই বার্তা কতটা আমরা নিজেরা ব্যবহার করার সামর্থ্য অর্জন করব তার ওপর। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে ক্রমাগত চর্চার মধ্যে অবশ্যই রাখতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাশা পূরণেও নিজেদের তৈরি করতে হবে। ফলে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সমঅধিকার প্রভৃতি ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করতে পারব। সুশীল সমাজের ভূমিকা কাজে লাগানো যাবে। জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, ‘আমার মনে হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদল বাংলাদেশের গ্রাউন্ড রিয়েলিটি বোঝার চেষ্টা করেছে। নির্বাচনে কী ভূমিকা হবে সেটাও পর্যালোচনা করবে। তারা দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ঠিক রেখে স্বার্থ হাসিলের চেষ্টা করবে বলে মনে হচ্ছে। পাশাপাশি তারা এটাও চায় যে, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিবেশ স্থিতিশীল থাকুক। ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে মার্কিন স্বার্থরক্ষাই তাদের মূল লক্ষ্য। তিনি আরও বলেন, নির্বাচনে কোনো দল অংশ নেবে কিংবা নেবে না সেটা অন্য দেশের নির্ধারণের কোনো সুযোগ নেই। বাংলাদেশের ব্যাপারে তারা ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত নেবে। বাংলাদেশের জনগণ সেটাকে কীভাবে নেবে সেটাকেও তারা বিবেচনায় নেবে। বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা আছে। যুক্তরাষ্ট্র যে সিদ্ধান্ত নিক না কেন, সেটা তারা নিজেদের স্বার্থ সমুন্নত রেখেই নেবে।