একটি সরেজমিন মূল্যায়ন

প্রকাশিতঃ জুলাই ২১, ২০২৩ | ৫:০২ অপরাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

ঈদের পরে একদিন ছোট একটা কাজ নিয়ে যেতে হলো খুলনার সোনাডাঙ্গা বাস টার্মিনালের অদূরে অবস্থিত একটি অটোমোবাইল ডেন্টিং ও পেইন্টিং কারখানায়। রাস্তার পাশের কমার্শিয়াল খালি প্লট ভাড়া নিয়ে তার ওপরে অস্থায়ী শেড তৈরি করে ওয়ার্কশপটি কাজ করছে। সেদিন দেখা গেল, তিনটি গাড়ির কাজ চলছে। কারখানায় যে ক’জন মিস্ত্রি কাজ করে তাতে এরা একসঙ্গে পাঁচটি গাড়ির কাজ করতে পারে। দেখে বোঝা গেল, ছোট আকারের পুঁজি নিয়ে গড়ে ওঠা কারখানাটি মাঝারি মাপের একটি ব্যক্তিগত খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। তখন টিপটিপ করে বৃষ্টি হচ্ছিল। শেডের নিচে প্লাস্টিকের চেয়ারে বসে একজন মিস্ত্রির সঙ্গে গল্পচ্ছলে অনেক কথা হলো। পথের দিকে তাকিয়ে দেখছিলাম, ঝাঁকে ঝাঁকে ইজিবাইক যাচ্ছে আর আসছে। পেছনে ৪০০ বেডের হাসপাতাল, যদিও মানুষ এটাকে ‘২৫০ শয্যার হাসপাতাল’ বলে চেনে। হাসপাতাল থেকে পূর্বদিকে রূপসা ঘাট পর্যন্ত ইজিবাইক চলাচল করে। দেখলাম, কোনো বাইকে এক-দুজন, আবার কোনোটায় বেশি প্যাসেঞ্জার রয়েছে। কিন্তু ধারণক্ষমতা অনুযায়ী কোনোটাই পরিপূর্ণ নয়। পাবলিক বাসের অভাবে এটাই এখন সাশ্রয়ী পরিবহণ। তবে এত ইজিবাইক নেমেছে যে, প্যাসেঞ্জার পাওয়াই কষ্ট। মফস্বল কিংবা বিভাগীয় শহরগুলো এখন ইজিবাইকের কারণে যানজট-আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। নগরবাসী আগের মতো দ্রুত এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার সুবিধা হারিয়ে ফেলছে। সড়কের প্রতিটি তেমাথা বা চৌমাথা পার হতে গেলে চেনা শহরগুলোকে অচেনা মনে হয়। তবু অন্য পেশায় ভাগ্য পরীক্ষা না করেই বেকার যুবকরা ইজিবাইক চালানোর কাজে নেমে পড়ছে। দেশে যদি টেকনিক্যাল এবং পেশাগত শিক্ষা পাওয়ার কাজ আরও সহজলভ্য করা যেত, তাহলে এসব ইজিবাইক চালকের অনেকেই এ অটোমোবাইল কারখানার মিস্ত্রিদের মতো নানারূপ বৃত্তিমূলক পেশার কাজে অন্তর্ভুক্ত হতে পারত। আমাদের বর্তমান নিবন্ধে আলোচিত কারখানাটিতে কাজ করে পাঁচ জন মিস্ত্রি এবং দুজন হেলপার। শ্রাবণের আকাশ জুড়ে তখন ঘনকালো মেঘের আনাগোনা। তাদের একঝাঁক উড়ে এসে মুষলধারে বৃষ্টি নামিয়ে দিল। টিনের চালের ওপরে টপ টপ বৃষ্টি ঝরে এক ধরনের শব্দের মাদকতা উপহার দিচ্ছিল। এমন সময়ে কি কাজ করতে মন চায়? তবু শেডের নিচে দুজন মিস্ত্রি দুটো গাড়িতে হাত লাগিয়ে পালিশের কাজ করে যাচ্ছিল। যাদের গাড়ি, কাজ শেষ করতে তাদের পক্ষ থেকে তাগিদ আসে। আর কারখানার লোকদের পরে আরেকটা কাজ ধরতে আগের গাড়ি সময়মতো ডেলিভারি দিতে হয়। তাই এসব সেক্টরে বসে থাকার অবকাশ নেই। জানা গেল, এ কারখানায় কাজ করে তিন সহোদর। এদের মধ্যে জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা মধ্যপ্রাচ্য থেকে আয় করে যে টাকা জমিয়েছিলেন, তাই ইনভেস্ট করেছেন এখানে। ডেন্টিং-পেইন্টিংয়ের কাজে যেসব যন্ত্রপাতি লাগে, তা কিনতে তিন লাখ টাকার মতো লেগেছিল। জায়গাটার জন্য কিছু টাকা অ্যাডভান্স দিতে হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় পাঁচ লাখ টাকা ইনভেস্টমেন্ট রয়েছে এদের। খালি জায়গার ভাড়া হিসাবে জমির মালিককে প্রতি মাসে ২০ হাজার টাকা দিতে হয়। তিন সহোদর ছাড়া এ কারখানায় কাজ করে আরও দুজন মেকানিক। জিজ্ঞেস করলাম, কেমন আয় হয়? একজন মেকানিক জানালেন, সব মাসে একরকম আয় হয় না। তবে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী যে চাকরি তারা পেত, এখনকার আয় তার চেয়ে খারাপ নয়। দেশে মানুষ বেড়েছে, মানুষের আয় বেড়েছে, সেইসঙ্গে বেড়েছে গাড়ি। কাজেই এরকম ছোট পুঁজির ব্যবসা হিসাবে গাড়ি মেরামত কারখানা কর্মসংস্থানের জন্য ভালো অবদান রাখছে। কিন্তু এ সেক্টরে কাজ করার উপযুক্ত টেকনিক্যাল শিক্ষালাভের দরকার হয়। তার জন্য সাধারণ শিক্ষার তুলনায় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এখানে খুব কম। এরা অন্যের কারখানায় কাজ করে শেখে। প্রথম দুই-এক বছর স্বল্প বেতনে কাজ করতে হয়। ফলে প্রথম প্রথম অনেকে ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। অন্য অনেক দেশেই যে কোনো বৃত্তিমূলক পেশায় নিয়োজিত হতে সার্টিফিকেট কোর্স পাশ করতে হয় এবং সে শিক্ষাটা অনেক দেশে ফ্রি অথবা বিনিময়ে আর্থিক প্রণোদনা পাওয়া যায়। তাতে লাভ হলো, বেকার যুবকরা একটা পৃষ্ঠপোষকতা পেয়ে সার্টিফিকেট কোর্স বা ডিপ্লোমা কোর্সের প্রতি আগ্রহী হয়। আমাদের দেশে ষাটের দশকে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউটগুলো প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ দেশের মানুষ ডিপ্লোমা ডিগ্রি সম্পর্কে ধারণা পেয়েছে। কিন্তু বৃত্তিমূলক কাজের ক্ষেত্রে কাজের স্তরভেদে সার্টিফিকেট-১ থেকে সার্টিফিকেট-৪ পর্যন্ত যে কোর্সগুলো আছে (আমাদের দেশে এগুলো এনটিভিকিউএফ ১-৪) সে সম্পর্কে অনেকেরই ধারণা নেই। এসব সার্টিফিকেট ছাড়া উন্নত দেশে কোনো বৃত্তিমূলক পেশায় মেকানিক বা দক্ষ মেকানিকের কাজে নিয়োজিত হওয়া যায় না। সার্টিফিকেট-১ অর্জনকারী একজন মেকানিক সাধারণ জ্ঞানসমৃদ্ধ কারিগর এবং সার্টিফিকেট-৪ অর্জনকারী একজন ব্যক্তি দক্ষ কারিগর হিসাবে স্বীকৃত। ডিপ্লোমা ডিগ্রিধারীকে সার্টিফিকেট-৬ এর সমমান হিসাবে ধরা হয়। দেশে যোগ্যতার স্বীকৃতিমূলক সার্টিফিকেট দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়েছে অল্প কিছুদিন আগে, ২০১৯ সাল থেকে। জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ নামের সংস্থাটি সৃষ্টি হওয়ার পর এর আওতায় সরকারি বা বেসরকারি প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানকে নিবন্ধনের আওতায় আনা এবং এসেসর প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হয়েছে। এখানে পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করে বিভিন্ন ধাপের সার্টিফিকেট পাওয়ার ব্যবস্থা আছে; কিন্তু কর্তৃপক্ষের সদর দপ্তর একমাত্র ঢাকাতে হওয়ায় এবং প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা অপ্রতুল হওয়ায় বৃত্তিমূলক শিক্ষার সার্টিফিকেট পাওয়ার বিষয়ে প্রচার-প্রচারণা সেভাবে গড়ে ওঠেনি। আবার ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য প্রণোদনাও খুবই কম। সরকারি/বেসরকারি ট্রেনিং প্রতিষ্ঠানে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় জনপ্রতি প্রশিক্ষণের বিপরীতে প্রণোদনা দেওয়া গেলে এবং কম খরচে প্রশিক্ষণের সুবিধা পেলে যুবক সম্প্রদায় আরও বেশি আগ্রহী হতো। প্রশিক্ষণের পর সার্টিফিকেট প্রাপ্তিতে যেমন আত্মবিশ্বাস বাড়ে, তেমনি সার্টিফিকেটধারীদের মূলধন সরবরাহের জন্য ব্যাংক লোনের ব্যবস্থা করা যায়। আমাদের বিবেচ্য কারখানাটির মালিক সহোদর তিন ভাইয়ের পরিবারের বড় ভাইয়ের বিদেশ থেকে আয় করে আনা টাকা না থাকলে তাদের জন্য কারখানা প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হতো। কারণ জামানত ছাড়া ক্ষুদ্র কারখানার বিপরীতে লোন দিতে খুব কম ব্যাংকই এগিয়ে আসে। সরকারি কয়েকটি বিভাগ কিছু ঋণ দেয়, যা অপ্রতুল। কাগজ-কলমে হয়তো অনেকে বলেন, আমাদের ডিপার্টমেন্ট এমন লোন দেয়, ট্রেনিং দেয়, মূলধন দেয়। কিন্তু এসব ক্ষেত্রে পদে পদে এত বেশি অসম্ভাবনার দরজা রয়েছে যে, তা আটকাতে পারা একটা অলৌকিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়। আমাদের বিবেচ্য কারখানার তিন ভাই নিজেরা কাজ করছে এবং আরও চারজনের কর্মসংস্থান দিয়েছে। যদি ইজিবাইক নিয়ে নামত, তাহলে একজন শুধু নিজের কর্মের ব্যবস্থা করতে পারত। সেসঙ্গে সড়কে আরও তিনটে প্রয়োজনের অতিরিক্ত স্থানীয় যানবাহন বাড়ত। প্রয়োজনের বেশি যানবাহন যানজট সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখে। তাই তো সব মফস্বল শহরে এখন যানজট নামের উৎপাত এসে হাজির হয়েছে। শুধু অটোমোবাইল খাতের ডেন্টিং বা পেইন্টিং কাজ নয়, সব সেক্টরের সব ট্রেডে টেকনিক্যাল কাজের চাহিদা রয়েছে। বাসা-বাড়ির ইলেক্ট্রিফিকেশন, স্যানিটারি, এসি বা এয়ারকন্ডিশনিং, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজ করাতে গেলে দেখা যায়, মেকানিকদের শিডিউল পেতে কষ্ট হয়। অর্থাৎ এ খাতে যোগ্য ব্যক্তির যথেষ্ট চাহিদা আছে; কিন্তু এখানে কর্মসংস্থানের সুযোগ থাকা সত্ত্বেও টেকনিক্যাল প্রশিক্ষণের প্রশ্ন জড়িত বলে কাজ শিখতে টেকনিক্যাল স্কুল-কলেজে পড়তে হয়, নয়তো গুরু ধরতে হয়। টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার অপ্রতুল এবং খরচ বেশি বিধায় বেশিরভাগ যুবক গুরু ধরে কাজ শেখে। তাদের কোনো সার্টিফিকেট নেই, কাগজ-কলমে অভিজ্ঞতার স্বীকৃতি নেই। আত্মসম্মান ও আত্মবিশ্বাস গড়ে ওঠার পক্ষে এটা একটা বড় অন্তরায়। তাই জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন অথরিটির অফিস কমপক্ষে বিভাগীয় সদর পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া দরকার। নতুন করে এতদবিষয়ক কার্যক্রম চালু হয়েছে বিধায় পরিকল্পনাগুলোকে জনপ্রিয় করে তুলতে প্রথম প্রথম কিছুটা নমনীয় মনোভাব নিয়ে প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন কাজ পরিচালনা করা সমীচীন হবে, যাতে অধিক সংখ্যক প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে। প্রচারে যেমন প্রসার, তেমনি প্রসারেও প্রচার কাজ হয়। গাজী মিজানুর রহমান : সাবেক সরকারি কর্মকর্তা ও লেখক