পূর্ণশক্তি নিয়েই এবার রাজপথে বিএনপি

প্রকাশিতঃ জুলাই ২২, ২০২৩ | ৭:৪০ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

সরকার পতন আন্দোলনে রাজপথে ভিন্ন রূপে দেখা যাচ্ছে বিএনপিকে। প্রায় এক যুগের বেশি ক্ষমতায় বাইরে থাকা দলটি মামলা, হামলা, নির্যাতন, গ্রেফতার, অভ্যন্তরীণ কোন্দলসহ নানা কারণে ছিল বিপর্যস্ত। সেই প্রতিকূলতা কাটিয়ে সাংগঠনিকভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দলটি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীদের মধ্যে একটা নবজাগরণ তৈরি হয়েছে। রাজপথে সিনিয়র নেতাসহ বিশাল উপস্থিতি সবার নজর কাড়ছে। যে কোনা বাধা, ভয়ভীতি উপেক্ষা করে আন্দোলন সফলে তাদের মধ্যে দৃঢ় মনোবল লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পূর্ণশক্তি নিয়েই এবার রাজপথে নামছে দলটি। রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও দলটির বিভিন্ন স্তরের নেতাকর্মীর মতে, বিএনপির এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর পেছনে বেশকিছু কারণ রয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে-সাংগঠনিকভাবে দলকে ঢেলে সাজানো। ত্যাগী ও তরুণদের বিভিন্ন পর্যায়ে নেতৃত্বে আনা, সিন্ডিকেট ভেঙে দলে ঐক্য ফিরিয়ে সব স্তরে সমন্বয়, নেতাদের জবাবদিহিতার আওতায় এনে তাদের কর্মকাণ্ড মনিটরিং। এছাড়া রাজপথের আন্দোলনে নিহত ও আহতদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানোয় হাইকমান্ডের প্রতি আস্থা তৈরি হওয়া, মানসিকভাবে ভেঙে পড়া নেতাকর্মীদের মধ্যে সাহস ও আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া। পাশাপাশি সিনিয়র থেকে জুনিয়র প্রত্যেক নেতার রাজপথে থাকার অঙ্গীকার এবং সর্বোপরি সরকারবিরোধী আন্দোলনসহ যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হঠকারিতা বাদ দিয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্তের কারণে দলটির এমন প্রত্যাবর্তন। এভাবে ঘুরে দাঁড়ানোয় সরকারবিরোধী আন্দোলনে সাধারণ মানুষের সমর্থনের পাশাপাশি দলটির প্রতি তাদের আস্থা বাড়বে বলেই মনে করছেন তারা। জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড দেখে মনে হচ্ছে সাংগঠনিকভাবে বিএনপি অনেকটাই ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রাজপথে তাদের উপস্থিতি সরকারও সমীহ করছে। বিগত সময়ে বিএনপির আন্দোলন নিয়ে ক্ষমতাসীনদের নানা টিটকারী ও ব্যঙ্গ করতে দেখা গেছে। তাদের আন্দোলনের মুরোদ নেই বলেও কেউ কেউ বলেছেন। বিভিন্ন আলোচনা এমনকি টেলিভিশনের টকশোতেও বিএনপিকে নিয়ে অনেককে রসিকতা করতে দেখা যায়। কিন্তু এবার রাজপথে দলটির উপস্থিতিতে সমলোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে গেছে। বিএনপি করবে আন্দোলন-ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এখন আর এমন কথা বলেন না। উলটো বিএনপিকে মোকাবিলায় তারা পালটা কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে নেমেছে। তিনি আরও বলেন-মামলা, হামলা, নির্যাতনসহ নানা কারণে দলটি সাংগঠনিকভাবে বিপর্যস্ত ছিল। এজন্য তাদের নিজেদের কর্মকাণ্ড অনেকটা দায়ী। সবমিলে দলটির দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যায়। সেখান থেকে তারা ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে এবং বর্তমানে দলটি বেশ ভালোভাবেই ফিরে এসেছে। তাদের এমন উত্থানে রাজনীতিতে ভারসাম্য তৈরি হবে। বদিউল আলম মজুমদার মনে করেন, সরকারবিরোধী আন্দোলনে নেতাকর্মীদের ব্যাপক উপস্থিতি সাধারণ মানুষের মধ্যেও প্রভাব পড়েছে। তাদের কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষও অংশ নিচ্ছেন। তবে এর পেছনে সরকারের আংশিক দায় রয়েছে। তাদের নানা কর্মকাণ্ডে সাধারণ মানুষ ক্ষুব্ধ। সাংগঠনিকভাবে বিএনপির এমন ঘুরে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, বিএনপিকে নিয়ে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে কিন্তু দলটিকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেনি। নানা প্রতিকূলতার পরও বারবার এ দলটি ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান সরকারের নানা নির্যাতনের পরও ফিনিক্স পাখির মতো জেগে উঠেছে বিএনপি। এবার আমাদের বিজয় আসবেই। তিনি বলেন, নানা প্রতিকূলতার কারণে বিগত সময়ে আমরা সরকারবিরোধী আন্দোলনে সফলতা পাইনি। এর পেছনে সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সমন্বয়ের অভাব যে কিছুটা ছিল না সেটা অস্বীকার করছি না। দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঠিক নেতৃত্ব এবং সিনিয়র নেতাদের সক্রিয় ভূমিকার কারণেই দলে সবস্তরে গতি আনা সম্ভব হয়েছে। যোগ্য ও ত্যাগীদের মূল্যায়ন করায় সবাই সক্রিয় হচ্ছেন। নেতাকর্মীর বিপদে তাৎক্ষণিক পাশে দাঁড়ানোয় শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সবার একটা আস্থা তৈরি হয়েছে। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অভিমত ও দলটির অতীত কর্মকাণ্ড পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বিগত ওয়ান-ইলেভেনে সাংগঠনিকভাবে বড় ধাক্কা খায় দলটি। নেতৃত্বে বিভক্তিসহ নানা প্রতিকূলতায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে ঘটে ফল বিপর্যয়। এরপর বারবার চেষ্টা করেও দলটি ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে কোথাও ছিল না চেইন অব কমান্ড। নেতায় নেতায় বিভক্তি, বিভিন্ন জেলায় সিন্ডিকেটে আরও টালমাটাল অবস্থা তৈরি হয়। দলকে সাংগঠনিকভাবে না গুছিয়েই ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে শুরু করে সরকারবিরোধী আন্দোলন। নির্বাচনে না গিয়ে তা প্রতিহতের ডাক দেওয়া হয়। কিন্তু সরকারের কঠোর অবস্থান এবং সাংগঠনিক ব্যর্থতার কারণে আন্দোলন সফলতা পায়নি। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে দুর্নীতির মামলায় সাজা দিয়ে কারাগারে পাঠানো হয়। নেতৃত্বের ক্ষেত্রে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ে দলটি। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পান লন্ডনে অবস্থানরত দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। দায়িত্ব পেয়ে দলকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নেন তিনি। কিন্তু দলের সিনিয়রসহ একটি অংশ তার নেতৃত্বকে মেনে নিতে পারেননি। নেতৃত্বের নানা দুর্বলতার মধ্যেই ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগে ফের সরকারবিরোধী আন্দোলনে মাঠে নামে দলটি। কিন্তু সেবারও ব্যর্থ। রাজপথ ছেড়ে সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে নির্বাচনে যায় বিএনপি। দলটির ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ফল বিপর্যয় ঘটে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জনগণের ভোটাধিকার রক্ষায় দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে নবজাগরণ তৈরি হয়েছে। ৭১ সালের মতো তাদের চোখেমুখে মুক্তির নেশা। সঠিক নেতৃত্বের কারণেই দল এবার দুর্বার গতিতে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দলকে ঢেলে সাজানোর পরিকল্পনা নেন তারেক রহমান। শুরুতেই দলে তার একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। যারা তার নেতৃত্ব নিয়ে সমালোচনা করতেন তাদের নানা কৌশলে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। আস্থাভাজনদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে আনা হয়। দলকে ঢেলে সাজানোর পাশাপাশি রাজপথের আন্দোলনে প্রস্তুত করতে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের মতামত নেওয়া হয়। তার ভিত্তিতেই শুরু পরিকল্পনা বাস্তবায়ন। একইসঙ্গে বিগত আন্দোলনের ব্যর্থতাগুলো চিহ্নিত করে আগামীতে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সংশ্লিষ্টরা জানান, পুনর্গঠনের মাধ্যমে দলে গতি আনতে শুরুতেই ভেঙে দেওয়া হয় সিন্ডিকেট। বিভিন্ন জেলায় দীর্ঘদিন ধরে যারা দায়িত্বে ছিলেন তাদের সরিয়ে নতুন নেতৃত্ব আনা হয়। কেন্দ্র থেকে সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে কমিটি করার চিরাচরিত নিয়ম থেকে সরে সব জায়গায় কাউন্সিলের মাধ্যমে নেতৃত্ব তৈরির সিদ্ধান্ত হয়। এক্ষেত্রে কেন্দ্রের পাশাপাশি তৃণমূলের সব স্তরের শীর্ষ নেতৃত্বে ত্যাগী ও তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। মূল দলের পাশাপাশি অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনকে সক্রিয় করতে নেওয়া হয় বিশেষ উদ্যোগ। বিগত সময়ে নেতারা কে কি করতেন তা কেন্দ্র মনিটর করেনি। জবাবদিহিতা না থাকায় অনেকেই ফ্রি স্টাইলে দল চালাতেন। কিন্তু এখন কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের প্রতিটি নেতার কর্মকাণ্ড মনিটরিং করা হচ্ছে। দলীয় কর্মকাণ্ডে সক্রিয় না থাকলে তাদের আনা হচ্ছে জবাবদিহিতার আওতায়। দলটির এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়নের সঙ্গে যুক্ত দুজন নেতা বলেন, দলের পাশাপাশি বিগত আন্দোলনের ব্যর্থতা চিহ্নিত করে তা সমাধানের উদ্যোগ নেওয়া হয়। আন্দোলনের ব্যর্থতার মধ্যে দেখা যায়, হরতাল-অবরোধসহ কঠোর কর্মসূচি বাস্তবায়নে সিনিয়র কোনো নেতাকে মাঠে পাওয়া যায়নি। মাঝারি ও নিচের সারির নেতারা রাজপথে নামলেও সিনিয়ররা না থাকায় মানসিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েন। আগামীদিনের আন্দোলনে সিনিয়র নেতাদের রাজপথে থাকতে উদ্যোগ নেওয়া হয়। দলের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে সবার উপস্থিতিতে সিনিয়র নেতাদের রাজপথে থাকার প্রতিশ্রুতি নেওয়া হয়। যার প্রতিফলন ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। সরকারবিরোধী প্রতিটি কর্মসূচিতে স্থায়ী কমিটির সদস্যসহ কেন্দ্রীয় নেতাদের সরব উপস্থিতি। সরকারের পদত্যাগে একদফা দাবি আদায়ের প্রথম কর্মসূচি পদযাত্রায় তীব্র গরম উপেক্ষা করে দলের মহাসচিবসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যরা সামনের সারিতে থেকে নেতৃত্ব দেন। যা নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত করে। এ প্রসঙ্গে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, জনগণ ও নেতাকর্মীদের চাহিদার কারণে সিনিয়রদের মধ্যে মাঠে থাকার তাগিদ তৈরি হয়েছে। সিনিয়ররা মাঠে থাকলে পুরো আন্দোলনেই ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। যোগ্য ও ত্যাগীদের নেতৃত্বে আনা, বিপদে কর্মীদের পাশে দাঁড়ানোসহ সাম্প্রতিক দলের সিদ্ধান্তে শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি সবার আস্থা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। ফলে হাইকমান্ডের যে কোনো নির্দেশ নেতাকর্মীরা স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করছেন। অতীতে দেখা গেছে, রাজপথের কর্মসূচি বাস্তবায়নে বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না। কারা কোথায় দায়িত্ব পালন করবেন সে ব্যাপারেও ছিল না কোনো পরিকল্পনা। এবার আন্দোলনে সফলতায় সব স্তরের নেতাদের মধ্যে ঐক্য ও সমন্বয় তৈরিতে গুরুত্ব দেওয়া হয়। যে কোনো কর্মসূচি এককভাবে পালন না করে সম্মিলিতভাবে করার সিদ্ধান্ত হয়। যেমন ছাত্রদল এককভাবে কোনো কর্মসূচির ডাক দিলে তাতে বিএনপির পাশাপাশি যুবদল, শ্রমিক দলসহ সবাইকে উপস্থিত থাকতে হবে। সরকার পতনের কর্মসূচি বাস্তবায়নে সমন্বয়ের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কর্মসূচির দিন কারা কোথায় অবস্থান করবেন, কাদের ভূমিকা কি হবে তা আগে থেকেই জানিয়ে দেওয়া হয়। সমন্বয়ে থাকে একাধিক টিমও। কর্মসূচিতে কেউ বাধা দিলে সবাই মিলে তা প্রতিহত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিগত সময়ে কর্মসূচি পালনকালে নিহত ও আহত নেতাকর্মীদের পরিবারের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের সহায়তা করা হয়নি। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়। তাই নেতাকর্মীদের উজ্জীবিত ও নেতৃত্বের প্রতি আস্থা তৈরিতে যে কোনো বিপদে তাদের পাশে দাঁড়ানো হচ্ছে। বিএনপির একাধিক নীতিনির্ধারক বলেন, কিছু হঠকারী সিদ্ধান্তের কারণেও বিগত আন্দোলন ব্যর্থ হয়। তাই এবার হঠকারিতা এড়িয়ে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেওয়া আন্দোলনে গতি এসেছে। সরকার পদত্যাগের দাবিতে অনেকেই হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। সরকারও নানা কৌশলে উসকানি দিয়েছে। কিন্তু হাইকমান্ড সেই ফাঁদে পা দেয়নি। হরতাল ও অবরোধে জানমালের ক্ষতির পাশাপাশি সাধারণ মানুষও আর এমনটা চান না। তাই আন্দোলনে সাধারণ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচিকেই অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। তাতে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।