২৩ বছরের রেকর্ড ভাঙার দৌড়ে ডেঙ্গু। গত ২৩ বছরের মধ্যে মাঝে একবার ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয়েছিল ১৮১ জনের। কিন্তু চলতি বছর ২২ জুলাই পর্যন্ত প্রথম ৬ মাস ২২ দিনেই সরকারি তথ্যে ডেঙ্গুতে মৃত্যু ছাড়িয়েছে ১৬৭ জনে। হিসাবের বাইরে রয়ে গেছে অনেক আক্রান্ত এবং মৃত্যুর খবর। সরকারিভাবে যে হিসাব সবার সামনে আসছে, তা অত্যন্ত ভয়ানক। কারণ দিনকে দিন যেভাবে অবনতি ঘটছে তাতে আর এক-দুদিনের মধ্যেই ২০২২ সালের রেকর্ডও ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। এদিকে গত ২৪ ঘণ্টায় এই বছরের রেকর্ডসংখ্যক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন দেশের হাসপাতালগুলোতে। ২ হাজার ২৪২ জন রোগী ভর্তি হন এরমধ্যে শুধু ঢাকাতেই ভর্তি হয়েছেন ১ হাজার ২৩৯ জন। ঢাকার বাইরে ভর্তি হন ১ হাজার ৩ জন রোগী। ২৪ ঘণ্টায় মৃত্যু হয়েছে ১১ জনের। মৃত্যুর পাশাপাশি আক্রান্ত রোগীর এই সংখ্যা অতীতের বছরগুলোর অন্যান্য সব দিনের রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। দেশে এই যে ডেঙ্গু পরিস্থিতির চরম অবনতি ঘটছে; কিন্তু টনক নড়ছে না কারও। গত সপ্তাহে আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠকে দেশের ডেঙ্গু পরিস্থিতি উদ্বেগজনক উল্লেখ করে এডিস মশার লার্ভা যেখানে বেশি পাওয়া যায় এমন জায়গা চিহ্নিত করে অভিযান পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়। একই সঙ্গে থানা পুলিশের কার্যালয়, সরকারি-বেসরকারি অফিস, ব্যাংক ও হাসপাতালের আশপাশে পরিষ্কার-পরিচ্ছন রাখতে চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও চিঠি দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শনিবার পর্যন্ত কোনো ব্যাংক বা সরকারি দপ্তর সিটি করপোরেশন থেকে কোনো চিঠি পায়নি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি হচ্ছে সমন্বয়হীনতার অভাবে। বিড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? পরিস্থিতি যেন এই পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। ঢাকায় ডেঙ্গু রোধে যে কটি সংস্থা কাজ করছে তার মধ্যে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও সিটি করপোরেশন অন্যতম। কিন্তু এই দুটি প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালে হতাশ হতে হয়। মশা নির্মূলে গবেষণার কাজে একজন মেডিকেল কীটত্ত্ববিদও নেই স্বাস্থ্য বিভাগে। অপরদিকে দুটি সিটি করপোরেশনের অবস্থাও একই। তারা শুধু লার্ভা ঠেকাতে জরিমানার অভিযান করছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরবাসীর স্বাস্থ্য সুরক্ষা কিংবা বর্তমানে মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়া ডেঙ্গুর ভয়াবহ বিস্তার ঠেকাতে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। এদিকে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বিগত বছরগুলোতে বর্ষা মৌসুমে বিশেষ করে জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত এডিস মশাবাহী ক্ষুদ্র প্রাণী ডেঙ্গু মানুষকে বেশি আক্রান্ত করেছে। এরমধ্যে ২০১৯ সালে সর্বোচ্চ ১ লাখ ৩৫৪ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে ইতিহাসের সর্বোচ্চ ১৮১ জন মারা যান। অন্যদিকে চলতি বছরের ২২ জুলাই পর্যন্ত ৩০ হাজার ৬৮৫ জন হাসপাতালে ভর্তি ও ১৬৭ জনের মৃত্যু হয়েছে, যা বছরের প্রতি মাসে যে পরিমাণ ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছেন, তা গত ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জুলাই পর্যন্ত এত রোগী আর কখনও হাসপাতালে ভর্তি হননি। এমন প্রেক্ষাপটে বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, দেশে ২৩ বছর ধরে ডেঙ্গুর উত্থান চলছে। কিন্তু কোনো সরকারের সময়কালে মশাবাহী রোগটি মোকাবিলায় আন্তঃমন্ত্রণালয়ের সমন্বিত ভূমিকা দেখা যায়নি। জেলা-উপজেলা পর্যায়ে মশা নির্মূল ও রোগ চিকিৎসায় কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। এবার যেভাবে লাগামহীন সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে মনে হচ্ছে আগামী দু-এক মাসের মধ্যেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সব রেকর্ড অতিক্রম করবে। সরকারের রোগতত্ত্ব রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইডিসিআর) মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অধ্যাপক ডা. জাকির হোসেন হাবিব বলেন, দিন যত যাচ্ছে ডেঙ্গু রোগী ততই বাড়ছে। হাসপাতালগুলোতে রোগী ব্যবস্থাপনা সামাল দেওয়া কঠিন হচ্ছে। এরপরও এটি প্রতিরোধে দীর্ঘমেয়াদি মডেল পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে না। মশা নিধনে সব স্টেকহোল্ডারদের মাঠে নামানো যাচ্ছে না। মশা গবেষণায় এন্টোমলোজিস্ট নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে এন্টোমলোজিস্ট পদও তেমন নেই। রূপ বদলকারী এডিস মশা নিধনে যে ওষুধ ছিটানো হচ্ছে, তার দীর্ঘমেয়াদি প্রয়োগ মশার বিরুদ্ধে রেজিস্ট্যান্স হচ্ছে কিনা তাও মনিটরিং হচ্ছে না। ফলে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আক্রান্ত ও মৃত্যু বাড়ছে। এবার বিগত বছরগুলোর সব রেকর্ড অতিক্রম করবে সব পক্ষ থেকে আশঙ্কা করা হচ্ছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে তাপমাত্রা বৃদ্ধি, অনিয়ন্ত্রিত বৃষ্টিপাত, মনুষ্য সৃষ্ট অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাড়ছে। এডিস মশাও প্রতিকূল পরিবেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে টিকে থাকার সক্ষমতা অর্জন করতে শিখেছে। এসব কারণে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ছে। এবার এখনও ডেঙ্গুর মূল মৌসুম আসেনি। সংক্রমণের (পিক পর্যায়) সর্বোচ্চ হয়নি। আগস্ট মাসে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে। ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা ২০২২ সালকে ছাড়িয়ে যাওয়ার একটা আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, মশা সারা বছরই ছিল। বৃষ্টিপাত বাড়ায় মশার ঘনত্ব আরও বেড়েছে। আর মানুষের শরীরে ভাইরাসের লোড ছিল। সেটাও ডেঙ্গু ছড়ানোর সুযোগ পেয়েছে। এদিকে দেশজুড়ে ডেঙ্গুর বিস্তারের মধ্যে গত একদিনে হাসপাতালে রেকর্ড ২ হাজার ২৪২ জন রোগী ভর্তি হওয়ার খবর দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। শনিবার সকাল ৮টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় এই বিপুলসংখ্যক রোগী ভর্তি হওয়ার কথা বলা হলেও আগের দিনের রোগীর সংখ্যাও তাতে যোগ হয়েছে। কারণ শুক্রবার দেশের বেশিরভাগ হাসপাতাল তথ্য না দেওয়ায় তা শনিবারের তথ্যে সন্নিবেশ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে এ বছর হাসপাতালে ভর্তি ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ৬৮৫ জনে। এর মধ্যে ঢাকায় ভর্তি হন ১৮ হাজার ৮৮৫ জন এবং ঢাকার বাইরে ১১ হাজার ৮০০ জন। আর শুধু জুলাইয়ের ২১ দিনেই ভর্তি হয়েছেন ২২ হাজার ৭০৭ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ১১ জন মারা গেছেন। তাতে এডিস মশাবাহিত রোগে এ বছর মোট মৃতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৬৭ জনে। তাদের মধ্যে ১২০ জনের মৃত্যুই হয়েছে চলতি মাসের প্রথম তিন সপ্তাহে। গত একদিনে যে ১১ জনের মৃত্যুর কথা জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তাদের মধ্যে ৯ জন মারা গেছেন ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে, বাকি দুজন ঢাকার বাইরে। বর্তমানে বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৬ হাজার ৬৫৬ জন রোগী। তাদের মধ্যে ঢাকায় চিকিৎসাধীন ৩৮৩৯ জন এবং ঢাকার বাইরে ২৮১৭ জন। এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ দ্রুত বাড়ছে। জুন মাসে যেখানে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। জুলাইয়ের প্রথম ২১ দিনেই সেই সংখ্যা বেড়ে সাড়ে তিনগুণ হয়েছে। আক্রান্তের পাশাপাশি মৃত্যুও বেড়েছে। গত মাসে ৩৪ জনের মৃত্যু হলেও চলতি মাসের তিন সপ্তাহে প্রাণ গেছে ১২০ জনের। মাসের হিসাবে জানুয়ারিতে ৫৬৬ জন, ফেব্রুয়ারিতে ১৬৬ জন, মার্চে ১১১ জন, এপ্রিলে ১৪৩ জন এবং মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে জানুয়ারিতে ছয়জন, ফেব্রুয়ারিতে তিনজন, এপ্রিলে দুজন এবং মে মাসে দুজনের মৃত্যু হয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরে তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০০ সালে সারা দেশে ৫ হাজার ৫৫১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন, মারা যান ৯৩ জন। ২০০১ সালে ২ হাজার ৪৩০ জন, ২০০২ সালে ৬ হাজার ২৩২ এবং ২০০৩ সালে ৪৮৬ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। ওই ৩ বছরে যথাক্রমে ৪৪, ৫৮ এবং ১০ জনের মৃত্যু হয়। এরপর ২০১৬ সাল পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কখনোই ৪ হাজারের ঘর পার হয়নি। কোনো বছরেই ১৪ জনের বেশি মানুষের মৃত্যু হয়নি। ২০১৩ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর মাসভিত্তিক তথ্য মেলেনি। তবে এই ছয় বছরে দেশে প্রকোপ অতটা বেশি ছিল না। মাসভিত্তিক রোগী ভর্তি : স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া মাসভিত্তিক তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালের জুলাইয়ে ১৬ হাজার ২৫৩ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি হন। এ বছর জুলাইয়ের প্রথম ১৮ দিনেই সংখ্যাটি ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৯ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ ৫২ হাজার ৬৩৬ রোগী ভর্তি হয়েছিলেন। এ বছর জানুয়ারিতে হাসপাতালে ৫৬৬ রোগী ভর্তি ছিলেন। এর আগে সর্বোচ্চ ১৯৯ জন রোগী ভর্তি ছিলেন ২০২০ সালে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বলছে, চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে ভর্তি রোগীর সংখ্যা ছিল ১৬৬ জন। এটিও ছিল রেকর্ড। এর আগে ২০১৭ সালে ফেব্রুয়ারিতে সর্বোচ্চ ৫৮ জন রোগী ভর্তি হন। সেটিও ছিল আগের ১০ বছরের সর্বোচ্চ সংখ্যা। চলতি বছরের মার্চে ১১১ জন রোগী হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই মাসে এর আগে সর্বোচ্চ ৩৬ জন রোগী দেখা গেছে ২০১৭ সালে। গ্রীষ্মের প্রথম মাস এপ্রিলে এবার ১৪৩ জন, মে মাসে ১ হাজার ৩৬ জন এবং জুনে ৫ হাজার ৯৫৬ জন ভর্তি হন হাসপাতালে। ২০১৭ সালের মে মাসে ৭৩ জন, ২০১৯ সালের মে মাসে ১৯৩ জন এবং ২০১৯ সালের জুনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৮৮৪ জনের ভর্তি হওয়ার রেকর্ড ছিল। চলতি বছর যে ১৫৫ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর, তার মধ্যে ১০৮ জনের মৃত্যু হয়েছে জুলাইয়ের প্রথম ২০ দিনে। বাংলাদেশে এর আগে বছরজুড়েই এরচেয়ে বেশি মৃত্যু হয়েছিল মাত্র তিনবার। ২০১৯ সালে ১৭৯ জন, ২০২১ সালে ১০৫ জন এবং ২০২২ সালে ১৮১ জন। ২০১৯ সাল থেকে চলতি চলতি বছরের জুন পর্যন্ত মাসভিত্তিক যে হিসাব তাতে কোনো মাসে এত রোগী মারা যায়নি। ২০১৯ সালের জুলাইয়ে মৃত্যু হয়েছিল ৩৫ জনের। ওই বছর এক মাসে সর্বোচ্চ ৮৩ জনের মৃত্যু হয় আগস্টে। ২০২০ সালে আক্রান্ত এবং মৃত্যুর সংখ্যা ছিল কম। সে বছর ১ হাজার ৪০৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হন তাদের মধ্যে ৭ জন মারা যান। ২০২১ সালের জুলাইয়ে ১২ জন এবং ২০২২ সালের জুলাইয়ে ৯ জনের মৃত্যুর তথ্য দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।