খরার কবলে দেশ

প্রকাশিতঃ জুলাই ২৩, ২০২৩ | ৯:৫৬ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বদলে যাচ্ছে ঋতুচক্রের স্বাভাবিক নিয়ম, পরিবেশে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব। বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, লবণাক্ততাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের এ মিছিলে কয়েক বছর ধরে নতুন করে যোগ দিয়েছে খরা। ভরা বর্ষায় নেই বর্ষণ, মাঠ ফেটে চৌচির। এর বড় প্রভাব পড়ছে কৃষিতে। এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, দেশে বছরে খরায় ক্ষতি হচ্ছে প্রায় ৩৫ লাখ ২০ হাজার হেক্টর জমি। টাকার অঙ্কে তা ২ হাজার ৭৩৪ কোটি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অত্যধিক তাপমাত্রা, জলাধার শুকিয়ে যাওয়া, বন উজাড় এবং অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। তবে আগামী দিনগুলোতে আরও বড় খরা অপেক্ষা করছে বলেও সতর্ক করেছেন আবহাওয়াবিদরা। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলীয় খরার প্রভাব আগামী ৫০ বছরের মধ্যে দক্ষিণ ও মধ্য-পূর্বাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে শঙ্কা তাদের। ভরা বর্ষায়ও নেই বৃষ্টি পঞ্জিকার পাতায় এখন ভরা বর্ষা। আষাঢ় শেষে শ্রাবণের প্রথম সপ্তাহও পার। তবে আকাশে নেই মেঘ, ঝরছে না বারিধারা। ঋতুচক্রের নিয়ম ভেঙে সেই আকাশ এখন শরতের মতো শুভ্র। সূর্য ঢেলে দিচ্ছে তাপদাহ। গতকাল শনিবারও রংপুর, রাজশাহী, পাবনা, চুয়াডাঙ্গা, কিশোরগঞ্জের ওপর দিয়ে তাপপ্রবাহ বয়ে গেছে। আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক বলেন, আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত গরম এ রকমই থাকবে। মাঝেমধ্যে তাপমাত্রা কম থাকতে পারে, তবে গরমের অনুভূতি কম থাকবে না। এর কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি বলেন, বাতাসে এখন জলীয় বাষ্পের মাত্রা বেশি, বৃষ্টি কমে গেছে। এখন তাপমাত্রা যদি ৩২ থেকে ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মাঝেও থাকে, আর্দ্রতার কারণে গরম অনুভূত হবে বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. মনোয়ার হোসেন বলেন, এই জুলাইয়ের প্রথম ২০ দিনে এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। শেষ ৩০ বছরে জুলাইয়ে এত কম বৃষ্টি দেখা যায়নি। ২০২২ সালে স্বাভাবিকের চেয়ে ৫৮ শতাংশ ও ২০২১ সালের জুলাইয়ে ৫ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য-উপাত্ত পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত এপ্রিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৬৬.৪ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছিল। সেই ধারাবাহিকতায় মে মাসে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪৪.১ শতাংশ এবং জুনে স্বাভাবিকের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম বৃষ্টি হয়েছে। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে তাপপ্রবাহের মতিগতিও বদলাচ্ছে, সেই সঙ্গে বদলাচ্ছে এর প্রভাবের এলাকা। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) বন্যা ও পানি ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, জলবায়ুর এমন বিরূপ প্রভাবের কারণে প্রকৃতিতে শৈত্যপ্রবাহ, খরা ও অতিবৃষ্টি বা অনাবৃষ্টির মতো নানা বৈরিতা এখন বাস্তবতা। এ পটভূমিতে খালবিল, নদীনালা, জলাশয় সংরক্ষণ করতে হবে। শহর-গ্রামে বাড়াতে হবে সবুজ। গ্রিনহাউস নিঃসরণ কমানো না গেলে অপেক্ষা করছে বিপদ। আমনে বাড়বে খরচ, সোনালি আঁশ গলার ফাঁস আমন আবাদ সম্পূর্ণ বৃষ্টির ওপর নির্ভরশীল। এবার বর্ষায় পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন চাষিরা। কৃষি-সংশ্লিষ্টরা জানান, উৎপাদিত চালের ৩৮ শতাংশ আসে আমন থেকে। বৃষ্টিনির্ভর এ ফসল রোপণ হয় শ্রাবণে (মধ্য জুলাই-মধ্য আগস্ট)। জুন থেকে প্রস্তুত হয় বীজতলা। আবহাওয়াবিদরা বলছেন, আগস্টেও একই ধরনের তাপপ্রবাহ দেশজুড়ে বয়ে যেতে পারে। ফলে আমন উৎপাদন ঝুঁকিতে পড়তে পারে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে যে ক’টি জেলায় প্রকৃতির নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে, এর মধ্যে অন্যতম সাতক্ষীরা। গত তিন বছর সাতক্ষীরায় ঠিকমতো মৌসুমি বৃষ্টি না হওয়ায় প্রভাব পড়ছে বিভিন্ন ফসলে। প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে রোপা আমন চাষ তো দূরের কথা, অধিকাংশ কৃষক এখনও বীজতলা তৈরি করতেই পারেননি। আশাশুনির বিছট গ্রামের রুহুল আমিন মোড়ল বলেন, বীজ ধান কিনে এনে রেখেছি অনেক আগে। বৃষ্টির অভাবে এবার এখনও বীজতলা তৈরি করতে পারিনি। এদিকে পর্যাপ্ত বৃষ্টি না হওয়ায় গ্রামের নদনদী, খাল-বিল, পুকুর ও ডোবায় পানি নেই। ফলে এবার পাটের ভালো ফলন হলেও জাগ দেওয়া যাচ্ছে না। সোনালি আঁশ নিয়ে বিপাকে পড়েছেন কৃষক। ক্ষেতেই পাট ফেলে রেখেছেন তারা। রাজশাহীতে ভারী বৃষ্টি না হওয়ায় পবা উপজেলার বাঘসারা এলাকায় জাগ দিতে না পেরে পাট কেটে জমিতেই ফেলে রেখেছেন চাষিরা - শরিফুল ইসলাম তোতা ফরিদপুরের সালথার সোনাপুর ইউনিয়নের কৃষক খালেক মাতুবর বলেন, পুকুর ভাড়া করে পাট জাগ দিতে হচ্ছে। সোনালি আঁশ যেন এখন আমাদের গলার ফাঁস। কৃষি অর্থনীতিবিদ ড. মো. জাহাঙ্গীর আলম খান বলেন, বোরোর পর সবচেয়ে বেশি ধান আসে আমন থেকে, যা দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় অন্যতম ভূমিকা রাখছে। বৃষ্টিনির্ভর আমনে সেচ দেওয়ায় খরচ বেড়েছে। সরকার সব ধরনের সারের দাম ৫ টাকা করে বাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে ৪০ শতাংশের বেশি খরচ বেড়েছে। আমন উৎপাদন স্বাভাবিক রাখতে ডিজেলে ভর্তুকির বিকল্প নেই। এ ছাড়া খরাসহিষ্ণু জাত উদ্ভাবন ও সম্প্রসারণ করতে হবে। এ ব্যাপারে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আব্দুর রাজ্জাক বলেন, এ বছর আমনের আবাদ ও উৎপাদন বাড়াতে ৩৩ কোটি ২০ লাখ টাকার প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। সারাদেশের ৪ লাখ ৯০ হাজার ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক এ প্রণোদনার আওতায় বিনামূল্যে বীজ ও সার পাবেন। পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকার সিদ্ধান্ত নেবে। উদ্বেগজনক তথ্য খরা সম্মেলনে খরা নিয়ে জনমত তৈরি ও সংকট উত্তরণে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণের লক্ষ্যে গতকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট হলে জাতীয় খরা সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে জানানো হয়, উত্তর-পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের ২২ জেলা খরার ঝুঁকিতে। ৩০ লাখ শিশু প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে খরার প্রভাবের শিকার। খরাপ্রবণ জেলাগুলোয় মোট জমির পরিমাণ প্রায় ৫০ লাখ ৬০ হাজার হেক্টর, যার ৭৭ শতাংশ জমি মাঝারি থেকে চরমভাবে খরার ঝুঁকিতে আছে। খরার কারণে প্রতিবছর এ অঞ্চলে প্রায় ২ হাজার ৭৩৪ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে। ১৯৯১ সালে উঁচু বরেন্দ্র এলাকায় পানির স্তর ছিল ২৭ ফুট, ২০০০ সালে তা নামে ৪০ ফুটে। নিচু বরেন্দ্র এলাকায় ১৯৯১ সালে পানির স্তর ছিল ২০ ফুট, ২০০০ সালে তা নামে ২৯ ফুটে। গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ প্রায় ২০ বার খরার কবলে পড়ে। তবু খরা মোকাবিলায় যথেষ্ট পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। সম্মেলনে জানানো হয়, খরার কারণে এলাকাভেদে ২০-৭০ শতাংশ পর্যন্ত কৃষি উৎপাদন কমতে পারে। তীব্র খরার কারণে আউশ ফসলের প্রায় ৪০ শতাংশ ক্ষতি হয়। খরিফ মৌসুমের খরার কারণে প্রতিবছর প্রায় ২৩ লাখ হেক্টর জমির আমন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রবি মৌসুমে ১২ লাখ হেক্টর জমি বিভিন্ন মাত্রার খরার কারণে আক্রান্ত হয়। খরা মৌসুমে কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে ৮১ শতাংশ মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় বিঘ্ন ঘটে। এভাবে চলতে থাকলে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশে ৮০ লাখ মানুষ খরার কারণে উদ্বাস্তু হবে। সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, খরা মোকাবিলায় ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবহারের ক্ষতি নিয়ে গবেষণা দরকার। এতে ব্যবস্থা নিতে সহজ হবে। জাতীয় খরা সম্মেলন আয়োজক কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুরুল আলম মাসুদ বলেন, খরা এ দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এমন পরিস্থিতিতে এ সমস্যাকে বাংলাদেশের উন্নয়ন আলোচনায় অগ্রাধিকার বিবেচনায় নিতে হবে।