চাপ সামলাতে পারছে না মুগদা হাসপাতাল

প্রকাশিতঃ জুলাই ২৪, ২০২৩ | ৭:৩৫ পূর্বাহ্ন
অনলাইন নিউজ ডেক্স

রাজধানীর মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন এক মা। ডেঙ্গু আক্রান্ত ওই মায়ের পাশে বসে কান্না করছে শিশু সন্তান মেহরাব। জ্বরে শক সিনড্রোমে রয়েছেন। প্লাটিলেট কুড়ি হাজারের নিচে নেমে এসেছে। মায়ের জন্য, মায়ের সুস্থতার জন্য কি যে আকুতি-তার চোখ-মুখই স্পষ্ট বলে দিচ্ছিল। হাসপাতালটির ৩ তলার ১৫ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন খোদেজা বেগম নয়ন (৩৫)। পাশে থাকা স্বামী আব্দুল মালেক বলেন, এক সপ্তাহ আগে ডেঙ্গু রোগটি ধরা পড়ে। নোয়াখালী সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসার পর শুক্রবার এ হাসপাতালে আনা হয়। ছোট্ট মেহরাবের প্রশ্ন, ‘আমার তো আম্মা, ভালো হবে তো। এ সময় হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে মেহরাব। পাশে থাকা নার্স বলছিলেন, ছেলেটা মায়ের মাথার পাশে বসে থাকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে কাঁদে। বিড়বিড় করে কি যেন বলে। চিকিৎসক-নার্স সবাই তার কান্না-আকুতি দেখে আবেগতাড়িত হয়ে পড়েন। ৫০০ শয্যার মুগদা হাসপাতালে ভর্তি আছেন ২ হাজার ৯১২ জন রোগী। এর মধ্যে অর্ধেকই নারী ও শিশু। ৩ তলায় ডেঙ্গু রোগী। সিঁড়ির পাশে পর্যন্ত রোগী রয়েছে। খোদেজা বেগমের মতো বহু নারী শক সিনড্রোমে রয়েছেন। অন্তত ১৫ জন আক্রান্ত নারী ও স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চিকিৎসা পর্যাপ্ত নয়। অনেক সময় ডেকেও ডাক্তার-নার্সদের পাওয়া যায় না। মশারি নেই। দু-একজন মশারি ব্যবহার করলেও ৯৫ শতাংশ রোগী মশারিবিহীন অবস্থায় আছেন। একেকজন রোগীর সঙ্গে ২-৩ জন স্বজন বসে থাকে। অধিকাংশ রোগী মেঝেতে। কোনো কোনো শয্যায় ২ জন করে রাখা হয়েছে। জুরাইন থেকে আসা শিরিন আক্তার ৫ দিন ধরে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আক্রান্ত বোনকে সেবা দিচ্ছেন শারমিন। শিরিনের ছোট বোন। শারমিন জানান, ডেঙ্গু আক্রান্ত তার বোন দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে। কিছুই খেতে পারছে না। বোন কবে সুস্থ হবে বুঝতে পারছেন না। শাহজাহানপুর থেকে আসা জাহানারা বেলীর প্লাটিলেট ১৬ হাজারে নেমে এসেছে। মুখমণ্ডল লালচে হয়ে আছে। স্যালাইন চলছে, মুখে খেতে পারেন না। স্বামী জিল্লুর রহমান জানান, তার এক কন্যাও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে ভালো হয়েছে। এখন স্ত্রী আক্রান্ত হয়ে ৪ দিন ধরে ভর্তি। ৯ তলায় এমন ১৯০ জন আক্রান্ত নারী রয়েছেন। ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশুদের রাখা হয়েছে ৮ তলায়। পুরো তলায় শিশু। সঙ্গে মা-বাবা, স্বজনরা। ৬ মাসের শিশু রুমাইসারকে নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটছে মা ফাহমিদার। শিশুদের অধিকাংশই মেঝেতে। এখানেও মশার উৎপাত। মশারি নেই। মশারি টাঙানোর কোনো ব্যবস্থা নেই। ২ বছরের শিশু নাফিসা মনিকে নিয়ে নানা, মামা ও খালা হাসপাতালে। শিশুটির মা আইরিন খানমও ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। মা সুস্থ হয়ে বাড়িতে ফিরলেও ছোট্ট শিশুটি এখনো ফিরতে পারেনি। খিলগাঁও থেকে আসা শাকিলা বেগম আক্রান্ত দুই শিশুকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। জানালেন, কন্যাসন্তান মার্জিয়া (১০) ও মাসুমা (৫) দুই জনই আক্রান্ত। একই শয্যায় রেখে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। ৮ তলায় ১০৯ জন শিশুর চিকিৎসা চলছে। অভিভাবকদের উৎকণ্ঠা চোখে-মুখে স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ১০ এবং ১১ তলায় ডেঙ্গু আক্রান্ত পুরুষদের ভর্তি করানো হয়েছে। ১০ তলায় একটি বেডে চিকিৎসা নেওয়া ওসমান গণির প্লাটিলেট ১৫ হাজারের নিচে নেমে এসেছে। স্ত্রী সুমি আক্তার জানান, এদের নতুন বিয়ে হয়েছে। রাত-দিন স্বামীর সঙ্গে আছেন। প্লাটিলেট কমে যাওয়ায় ভয়ে আছেন। আরও ৩০ জন রোগীর স্বজন জানান, প্লাটিলেট কমে ২০ হাজারের নিচে নেমে গেছে। সরেজমিন দেখা যায়, ডেঙ্গু ওয়ার্ডের ভেতরে ঠাঁই মিলছে না রোগীর। সামনের বারান্দা, সিঁড়ির দুপাশে ও খোলা জায়গা দিয়ে সারি করে বিছানা পাতা হয়েছে। ইচ্ছে থাকলেও মশারি টাঙাতে পারছেন না। মুগদা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামান বললেন, প্রতিদিন ডেঙ্গু রোগীর চাপ বাড়ছে। রোববার ১ জন মারা গেছেন। এ নিয়ে এ হাসপাতালে জুলাই মাসেই ২৭ জন মারা গেছেন। জুন মাসে মারা গেছেন ১৫ জন। নতুন করে আরও ৪টি ইউনিট প্রস্তুত করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, রোববার পর্যন্ত ৪৯৩ জন ভর্তি রয়েছে। নতুন করে ভর্তি হয়েছে ১৫৩ জন। তিনি বলেন, হাসপাতালে ২৫ জন অতিরিক্ত চিকিৎসক ও ৩০ জন প্রশিক্ষিত নার্স আনা হয়েছে। তাছাড়া রোগীদের চিকিৎসার জন্য আলাদা কোনো ওয়ার্ড নেই। বাড়তি রোগীর চাপ সামলানোর জন্য চারটি তলায় সুবিধামতো জায়গায় ডেঙ্গু রোগীদের শয্যা দেওয়া হয়েছে। ৩ বছরের শিশুকে নিয়ে হাহুতাশ করছিল জনৈক এক মা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই মা জানান, সন্তানের বাবা খোঁজ নেয় না। আমাকেই সব দেখতে হয়। হাতে টাকা-পয়সাও নেই। বাইরে থেকে তরল খাবার কিনে আনারও পয়সা নেই। অন্য কোথাও চিকিৎসা করানোর মতো আর্থিক সামর্থ্য নেই। এই সরকারি হাসপাতাল শেষ ভরসা। এদিকে হাসপাতালটির প্যাথলজি বিভাগের সামনে রক্তের নমুনা দিতে আসা মানুষের ভিড় তীব্র হচ্ছে। গুরুতর রোগীদের ওয়ার্ডে গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করা হলেও অধিকাংশ রোগী নিজেরাই কিংবা স্বজনদের সহযোগিতায় দোতলায় এসে লাইন ধরতে দেখা গেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে রোগীদের। এ বিষয়ে হাসপাতালের পরিচালক মো. নিয়াতুজ্জামানের ভাষ্য, হাসপাতালের ধারণক্ষমতা ও লোকবলের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি রোগী ভর্তি রয়েছে। ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসার জন্য নতুন করে কোনো লোকবল পাননি। সম্প্রতি অতিরিক্ত চিকিৎসক ও নার্স এলেও তা যথেষ্ট নয়। প্যাথলজিতে প্রতিদিন ৩০০ জনের পরীক্ষার সক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু এখন হাজারেরও বেশি রোগীর নমুনা পরীক্ষা করতে হচ্ছে।